নিপুন সূক্ষ্ম হাতের সুচ সুতার সেলাইয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছে ইতিহাস ঐতিহ্যের রেপ্লিকা। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কালো, সাদা বাহারি রঙের সুতো আর কাপড়ে যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে নকশি কাঁথা। একেবারে গ্রামের মেয়েরা সেসব কাজের প্রশিক্ষণ পেয়ে দক্ষ হয়ে উঠছেন। গত ২৪ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত একটানা হয়েছে নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের যাদুঘরে ওই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। দেশের পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, বাগেরহাট, কান্তজিউ মন্দির এই চারটি প্রত্নতত্ত্ব এলাকার প্রায় ১২ জন কারুশিল্পী চারজন প্রশিক্ষকের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফাস্টট্রাকচারাল ডেভলোপমেন্ট প্রজেক্ট (SATIDP) শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ঐতিহ্য অন্বেষণের এ আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় অধিনস্থ ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক।পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার এলাকার প্রশিক্ষণার্থী নাজমা খাতুন জাগো নিউজকে জানান, প্রথমে কাপড়ের উপর পেন্সিল দিয়ে ড্রয়িং করতে হয়। এরপর বিভিন্ন রংয়ের সুতা ও সুচ দিয়ে ড্রয়িংয়ের উপর নিপুন হাতে সেলাই করে নকশা তৈরি করা হয়। তিনি আশা করছেন এই নকশা বাজারে বিক্রি করে ভালো দাম পাবেন। এখান থেকে ভালো আয় করাও সম্ভব। এরকম যদি আরো প্রশিক্ষণ নিতে পারতেন তাহলে সুবিধা হতো বলে জানান তিনি। প্রশিক্ষণ নিতে আসা সুমি খাতুন জাগো নিউজকে জানান, আগে তেমন কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। বাড়িতে কামিজ, নকশি কাঁথা, বালিশের কভারে ফুল তোলার কাজ করা হয়। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আরো ভালো কাজ করতে পারবো। এছাড়াও শান্তনা, শারমিন, কামরুন নাহার পলি, জুঁই ও লিপি জানান, বাড়িতে নিজ উদ্যোগে নকশার কিছু কাজ করতেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পেরেছেন। এখন থেকে নকশি কাঁথায় বিভিন্ন রেপ্লিকা তৈরি করতে পারবেন। বাড়িতে কাজের পাশাপাশি নকশি কাঁথার কাজ করে আয় করতে পারবেন। দিনাজপুর কান্তজিউ মন্দির থেকে জয়ন্তি রায় এবং খুলনা বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে আসা প্রশিক্ষণার্থী শামিমা আক্তার জাগো নিউজকে জানান, নকশি কাঁথার উপর প্রথম প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ পেয়ে যেমন দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ে জানতে পেরেছেন, তেমনিভাবে এ নকশি কাঁথায় বিভিন্ন রেপ্লিকা তৈরি করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বাড়তি কিছু আয় এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হতে পারবেন। এরকম বিভিন্ন বিষয়ের উপর যদি প্রশিক্ষণ করানো হয় তাহলে ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে রাখা সম্ভব হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান খান এবং তাহমিদুন নবী জাগো নিউজকে জানান, পর্যটকরা যখন আসেন তখন তারা সে স্থানের ঐতিহ্য হিসেবে কিছু জিনিস কিনে নিয়ে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে সুন্দর কিছু তৈরি করবো, যাতে পর্যটকদের দৃষ্টি আর্কষণ করা যায়। মূলত, টেরাকোটা, নকশি কাঁথার মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। পরিচালক ঐতিহ্য অন্বেষন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলোজি বিভাগের প্রফেসর ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য সুরক্ষায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অংশগ্রহণ অর্থবহ করতে হলে ইতিহাস ঐতিহ্য সচেতনতার পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা অবশ্যাম্ভাবি। বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ, মহাস্থানগড়, কান্তজিউ মন্দির বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। ওই স্থানগুলো থেকে গবেষণার মাধ্যমে নির্বাচিত তাৎপর্যপূর্ণ মোটিফ নিয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহি সূচি শিল্পের নকশিকাঁথা, দেয়াল চাদর, হাত ব্যাগ, সোফা কাভার প্রভৃতি তৈরি করা হচ্ছে। এ পণ্যগুলো দেশি পর্যটকদের আকাঙ্খিত স্যূভেনির চাহিদা পূরণসহ আমাদের ঐতিহ্য দেশ-বিদেশে প্রচার লাভ করবে।আব্বাস আলী/এমজেড/এমএস
Advertisement