খেলাধুলা

মেসির চাই শুধু একটি বিশ্বকাপ

দরজায় কড়া নাড়ছে আরও একটি বিশ্বকাপ। পুরো একটি মাস সারাবিশ্ব বুঁধ হয়ে থাকবে ফুটবল নিয়ে একটি সোনালি ট্রফি জয়ের জন্য। যেখানে লড়াই করবেন বিশ্বের সব নামকরা বাঘা বাঘা ফুটবলাররা। তবে, রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর আগে অন্যতম ফেবারিট আর্জেন্টিনা সমর্থকদের চোখে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে একটি ছবি।

Advertisement

২০১৪ সালে রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে সোনালি ট্রফিটার পাশ দিয়ে বিষণ্ন বদনে হেঁটে যাচ্ছেন গ্রুহের সেরা ফুটবলার, লিওনেল মেসি। অথচ, নিঃশ্বাস ফেলার দুরত্বে থাকা ট্রফিটিকে ছোঁয়ার সাধ্য তখন তার নেই। অধিকারটাই তো অর্জন করতে পারেননি। ওই মুহূর্তের খানিক আগেই তো মেসির স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন জার্মান ফুটবলার মারিও গোৎসে।

'এত কাছে, অথচ কত দুরে'- জনম জনমের দুরত্বেই হয়তো থেকে যাচ্ছে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা। যদি না শেষবারের মতো রাশিয়া থেকে সুযোগটা নিজের করে নিতে না পারেন লিওনেল মেসি। বিশ্বকাপ জয়ের সর্বশেষ এবং সেরা সুযোগটা মেসির সামনে। ১৫ জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সাজানো মঞ্চে উঠে সতীর্থদের নিয়ে শিরোপা উল্লাসে কী শেষ পর্যন্ত মেতে উঠতে পারবেন মেসি? সময়ের কাছেই তোলা থাক এই প্রশ্নের উত্তর।

বিশ্বকাপ খেলেছেন, ফেবারিটের তালিকায় ছিলেন, ছিলেন সময়ের বিশ্বসেরা ফুটবলার- এমন অনেক ফুটবলারেরই আক্ষেপ, বিশ্বকাপ ট্রফিটা হাতে তুলে নিতে না পারা। সেই ১৯৫৪ সালেই তো সেই অজানা প্রশ্নটার অবতারণা করে দিয়েছে হাঙ্গেরি। যার কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুমুল জনপ্রিয়, দুর্দান্ত শক্তিশালী আর ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি দল ছিল তখনকার হাঙ্গেরির। পুসকাস, ককসিস, হিদেকুটিদের নিয়ে গড়া দলটি তখনকার জগৎবিজয়ী। কিন্তু বিশ্বটা আর বিজয় করতে পারলেন না, ফাইনালের রহস্যময় সমীকরণ মেলাতে না পারার কারণে।

Advertisement

যে পশ্চিত জার্মানিকে গ্রুপ পর্বে ৮ গোল দিয়েছিল, তাদের কাছেই কি-না ফাইনালে হেরে যেতে হলো! ১৯৭৪ নেদারল্যান্ডস দলটিও ছিল একই রকম। টোটাল ফুটবলের জোয়ারে ভাসছে তখন পুরো ফুটবল বিশ্ব। ওয়ান টাচে কীভাবে একটি দল এতটা দুরন্ত গতির হতে পারে, তাতো কেবল দেখিয়েছে ইয়োহান ক্রুয়েফের দল।

কিন্তু ফাইনালে এসে তাদের থমকে দাঁড়াতে হলো সেই জার্মানির কাছে। ইয়োহান ক্রুয়েফ যে জগদ্বিখ্যাত হয়ে উঠলেন, সেটা আর শেষ পর্যন্ত বিশ্ব বিখ্যাত কিংবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠা হলো না। বিশ্বকাপটা চিরকালিণ আক্ষেপ হয়েই থাকলো তার কাছে। ব্রাজিলের জিকো, সক্রেটিস, ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার থেকে শুরু করে বিশ্বখ্যাত এমন অনেক ফুটবলার আছেন, যাদের কপালে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা জোটেনি।

লিওনেল মেসিও সেই কাতারে যোগ দিতে চলেছেন। বিশ্বসেরা ফুটবলার, অথচ বিশ্বকাপটা হাতে তুলে নিতে পারেননি, এমন কিংবদন্তিদের কাতারে নাম ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছেন লিওনেল মেসি। রাশিয়া বিশ্বকাপই তার সামনে শেষ সুযোগ। এরপরই, হয়তোবা শিরোপা জিততে না পারাদের তালিকায় নামটা স্থায়ীভাবে বসে যাবে তার।

পেলে না ম্যারাডোনা? কে সেরা? ফুটবলে এটা এক চিরকালীন প্রশ্ন। এই প্রশ্নটার সমাধান করার যোগ্যতা ছিল মাত্র লিওনেল মেসির। আর্জেন্টাইন এই জীবন্ত কিংবদন্তি ক্লাব ফুটবলে এমন কোনো ট্রফি নেই, যেটা জিততে পারেননি। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে এখনও কোনো কিছুই জেতা হয়নি তার। একটিমাত্র বিশ্বকাপ যদি হাতে তুলে নিতে পারতেন তাহলে, নিশ্চিত পেলে-ম্যারাডোনার শ্রেষ্ঠত্ব ম্লান হয়ে যেতো আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকরের সামনে।

Advertisement

মেসি নিজেও খুব করে চাইছেন, অন্তত তার জীবনে এই অপূর্ণতাটা ঘুচে যাক। তিনি নিজেই বার বার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলছেন, 'ফুটবলের দায় শোধ করার এখনই সময়, আমার হাতে একটি ট্রফি তুলে দিয়ে।' কিংবা এমনও বলছেন, 'ইশ্বর চান, আমার হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটা তুলে দিতে।' বিশ্বকাপ ট্রফিটা জেতার জন্য এতটাই উতালা হয়ে উঠেছেন তিনি।

এই একটিমাত্র ট্রফি মেসিকে এভারেস্টের চূড়া থেকে আসমানে তুলে দেবে, সন্দেহ নেই। এমন এক উচ্চতায় তিনি চলে যাবেন, যেটা দেখে হয়তো পেলে-ম্যারাডোনারও ঈর্ষা হতে পারে। যদিও আকারে-ইঙিতে ইতোমধ্যে সাবেক এই দুই বিশ্বসেরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন মেসি।

কিন্তু এসব তো তাকে প্রমাণ করতে হবে। ফুটবলের ইতিহাস এতটাই নির্মম যে, সেটা কোনো পারফরমার কিংবা তারকাকে চেনে না। চেনে কেবল বিজয়ীকে। পৃথিবীল ইতিহাসটাও সম্ভবত এমন। বিজয়ীর কীর্তিগাঁথাই ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকে। না হয়, ২০১৪ বিশ্বকাপে এমন অসাধারণ ফুটবল খেলে দলকে বিশ্বকাপে তুলে আনার পরও কেন মেসির নামটা ইতিহাসের পাতায় লিখা হবে না!

সেই যে ফাইনাল যুদ্ধে পরাজিত দলের নামে তারা! পরাজয়ের এই গ্লানি গ্রাস করেছে এরপর আরও দু'বার। ২০১৫ এবং ২০১৬- দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে। গ্লানিতে নিমজ্জিত মেসি শেষ পর্যন্ত ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছিলেন, জাতীয় দলের হয়ে আর খেলবেন না তিনি। যদিও এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে শেষে তিনি ফিরেও এসেছেন এবং রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে দলের উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। যে কারণে সমালোচকরা মেসির জন্য রাশিয়া বিশ্বকাপটাকে 'বোনাস; হিসেবে আখ্যায়িত করেও থাকেন।

৫বার ফিফা বর্ষসেরা, ব্যালন ডি'অর যার হাতে ওঠে, যারা বিশ্বকাপে সবসময়ই থাকে ফেবারিটের তালিকায় তার একটি বিশ্বকাপ ট্রফি চাওয়া তো বেশি কিছু নয়। কিন্তু ২০০৬ সালে হলো না, ২০১০ সালেও নাম লেখাতে হয় ব্যর্থদের কাতারে। আর ২০১৪ সালে তো রীতিমত ট্র্যাজেডিই রচনা হয়ে গেলো আর্জেন্টিনা সমর্থকদের জন্য।

২০১৫ কোপা আমেরিকার ফাইনালেও উঠে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৯৩ সালের পর যে টানা শিরোপা খরায় ভুগছে আর্জেন্টাইনরা, সেটা বুঝি এবার নিশ্চিত কাটতে চলেছে। সামনে ছিল স্বাগতিক চিলি। কিন্তু তারাও যে শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার সামনে পরাশক্তি (!) হয়ে উঠবে, তা কে ভাবতে পেরেছিল! আর্জেন্টিনার বর্তমান কোচ হোর্হে সাম্পাওলি তখন মেসিদের শত্রু শিবিরে। শেষ পর্যন্ত তার ট্যাকটিসের কাছেই হারতে হলো মেসিদের। নির্ধারিত সময়, অতিরিক্ত সময় গোলশূন্য ড্র থাকার পর টাইব্রেকারে গিয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে মেসি শট জালে জড়াতে পারলেও মিস করে বসেন গঞ্জালো হিগুয়াইন আর এভার বানেগা।

পরেরবার কোপা আমেরিকার শতবর্ষ। আসর বসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এবারও দুর্বার আর্জেন্টিনা। মেসির ওপর ভর করে আবারও কোপার ফাইনালে লা আলবিসেলেস্তেরা। প্রতিপক্ষ সেই চিলি। এবার আর শত্রু শিবিরে নেই হোর্হে সাম্পাওলি। তবুও চিলি যেন আরো বেশি দুরন্ত, দুর্বার।

কিন্তু মেটলাইফ স্টেডিয়ামে গোলশূন্য ড্র থাকার পর খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। কী দুর্ভাগ্য, এবার মেসি নিজেই মিস করে বসলেন টাইব্রেকারের পেনাল্টি শট। মিস কলেন লুকাস বিগলিয়াও। সুতরাং, টানা তৃতীয় বছরে আরও একবার চরম হতাশায় মুষড়ে পড়তে হলো আর্জেন্টিনা এবং মেসিকে। সেই রাগ এবং ক্ষোভ থেকেই অবসরের ঘোষণা দিয়েছেলেন।

যখন তিনি নিজের প্রতিজ্ঞা ভেঙে আবার ফিরলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে, ততদিনে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে আর্জেন্টিনার তথৈবচ অবস্থা। সেই জের মেসিকে টানতে হয়েছে বাছাই পর্বের শেষদিন পর্যন্ত। ইকুয়েডরের বিপক্ষে অতি মানবীয় হ্যাটট্রিকটি করতে না পারলে আর্জেন্টিনা এবারের বিশ্বকাপেই খেলতে পারতো না।

মেসি এমনই ত্রাতা। বড় ম্যাচের খেলোয়াড়। সেটা বার্সেলোনায় তো অহরহ প্রমাণ করেই চলছেন, প্রমাণ করেছেন আর্জেন্টিনার জার্সি গায়েও। তবুও একটি শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ তার রয়ে গেছে। রাশিয়া বিশ্বকাপে না হলে রয়ে যাবে চিরদিন।

মাত্র ১০ বছর বয়সেই গ্রোথ হরমোন সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। ব্যায়বহুল চিকিৎসা করানো মেসির পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। মেসির পরিবার ওই সময় তাকে নিয়ে পড়ে যেন অথৈ সাগরে। একে তো দারুণ ফুটবল প্রতিভা, অন্যদিকে বেড়ে ওঠার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক গ্রোথ হরমোন সমস্যা। কী করবেন মেসির পরিবার?

এমনই এক পরিস্থিতিতে নিওয়েল ওল্ড বয়েজ, রিভারপ্লেটসহ আর্জেন্টিনার অনেক বড় বড় ক্লাব তার খেলা দেখে মুগ্ধ হলেও দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি হরমোন চিকিৎসা করানোর। ঘটনাচক্রে তখন মেসির চোখ পড়ে বার্সেলোনা কমকর্তা চার্লি রেক্সাশের। তিনিই প্রস্তাব দেন মেসিকে বার্সেলোনায় নিয়ে গিয়ে লা মাসিয়ায় ট্রেনিং করানোর।

নানা ঘটনার পর মেসির সঙ্গে দ্রুত চুক্তি করতে হবে। এ সময় ঘটে মজার একটি ঘটনা। চুক্তি সাক্ষরের জন্য কোনো কাগজও ছিল না রেক্সাশের হাতে। তিনি হাতের কাছে পেয়েছিলেন ন্যাপকিন পেপার। সেখানেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেন তিনি। ১২ বছর বয়সেই মেসি চলে আসেন বার্সেলোনায়।

১৩ বছর বয়সে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন বার্সার একাডেমি লা মাসিয়ায়। যেখানে সেস ফ্যাব্রেগাস এবং জেরার্ড পিকেদের মত তারকা ফুটবলারদের পেয়েছিলেন বন্ধু হিসেবে। মেসির কারণেই বার্সার 'বেবি ড্রিম টিম' তৈরি হয়ে যায়। বার্সার ইতিহাসে এর চেয়ে সেরা কিশোর দল আর তৈরি হয়নি।

২০০৩ থেকে ২০০৪ সালে ছিলেন বার্সেলোনা 'সি' দলে। ২০০৪-০৫ সালে ছিলেন বার্সেলোনা 'বি' দলে। এরপর ২০০৪ সাল থেকেই শুরু হয়ে যায় বার্সেলোনার সিনিয়র দলের হয়ে নিরন্তর অভিযাত্রা। বার্সেলোনার হয়ে খেলেই জিতেছেন ৫টি ব্যালন ডি'অর এবং ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার।

যার চারটি আবার টানা। পরিণত হয়েছেন 'ওয়ান ক্লাব ম্যান'-এ। পুরো ক্যারিয়ারই কাটালেন বার্সায়। জিতেছেন ৩০টি শিরোপা। যার মধ্যে রয়েছে ৯টি লা লিগা, চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৬টি কোপা ডেল রে শিরোপা। ৫টি রয়েছে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটের পুরস্কার।

রেকর্ড যেন মেসির কাছে ডাল-ভাত। লা লিগার সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড (৩৭৮ গোল) তার দখলে। লা লিগায় এক মৌসুমে (৫০) সর্বোচ্চ গোল, ইউরোপে সব মিলিয়ে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ (৭৩ গোল), এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ (৯১), এল ক্ল্যাসিকোয় সর্বোচ্চ (২৫) গোল করার রেকর্ড রয়েছে তার। বার্সেলোনার হয়ে তো সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড তারই দখলে। ক্লাব এবং জাতীয় দল মিলিয়ে মেসির গোল ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।

এত এত রেকর্ড আর গোল যার নামের পাশে, তার হাতে একটি বিশ্বকাপ শিরোপা নেই, এটা যেন খুবই বেমানান। মেসি নিজেই বলেছেন, ফুটবলের এবার দায় শোধ করার সময় হয়েছে। রাশিয়া বিশ্বকাপ কী পারবে, মেসির সেই দায় শোধ করতে!

আইএইচএস/আরআইপি