বার্ধক্যের কারণে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না সত্তরোর্ধ্ব অসহায় মা। অনেক সময় বিছানাতেই প্রস্রাব-পায়খানা করতেন। তাই স্ত্রীর কথায় গর্ভধারিণী মাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেন একমাত্র সন্তান। কাজই শেষ বয়সে সত্তরোর্ধ্ব এই মায়ের আশ্রয় হয়েছে বাড়ির পাশে ময়লার স্তূপে।
Advertisement
অমানবিক এই ঘটনাটি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের ভজনপুর নিজবাড়ি গ্রামের।
খবর পেয়ে শুক্রবার রাতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
শুক্রবার দিবাগত গভীর রাতে সরেজমিনে ভজনপুর নিজবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ওই এলাকার মৃত সেকেত আলীর স্ত্রী নেজামন নেছা (৭০) তার বাড়ির পাশে একটি বাঁশঝাড়ের নিচে ঝুপড়ি ঘরে আহাজারি করছেন। যার পাশেই রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।
Advertisement
গায়ে জ্বর নিয়ে ১৫ দিন ধরে খেয়ে না খেয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন। ঠিকমত চোখেও দেখতে পান না তিনি। ঝুুপড়ির মধ্যে বিছানা বলতে কয়েকটি কাঠের তক্তার উপর ছেঁড়া কাঁথা আর বালিশ। ঝড়-বৃষ্টি আর মশার কামড় উপেক্ষা করে সেখানেই বসে, কখনো বা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দিনরাত পার করছেন অসহায় এই মা।
বৃদ্ধার কান্নাকাটি আর আকুতি দেখে স্থানীয়রা তার একমাত্র সন্তান নিজাম উদ্দিন ওরফে নাজিমকে (৪৫) তার মাকে ঘরে তোলার অনুরোধ জানান। কিন্তু নাজিমের সাফ কথা, ‘ওই বুড়িকে পারলে নদীতে ফেলে দাও’।
এদিকে ময়লার স্তূপ আর অস্থায়ী ঝুপড়ির খানিক দূরেই নিজামের পাঁচ রুম বিশিষ্ট পাকা বাড়ি। স্ত্রী আতিমা খাতুনের মন জোগাতে শাশুড়িকে বাড়িতে এনে রেখেছেন নাজিম। কিন্তু একমাত্র সন্তান হয়েও সেই বাড়িতে মাকে আশ্রয় দিতে পারেননি তিনি !
ঝুপড়ির কাছে মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই কান্না আর আহাজারি শুরু করেন বৃদ্ধা মা। বলতে থাকেন, ‘এই কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছে না, আমাকে বিষ এনে দাও, আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না’।
Advertisement
তবে শেষ বয়সে এই মায়ের কষ্ট দেখে চুপ থাকতে পারেননি প্রতিবেশীরা। নিজেদের উদ্যোগে তারা প্লাস্টিক আর ছালা দিয়ে সেখানে একটি ঝুপড়ি বানিয়ে দিয়েছে তাকে।
প্রতিবেশী মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ছলিম উদ্দিনের স্ত্রী শাহারা খাতুন তাকে মাঝে-মধ্যে খাবার দেন, কিছুটা দেখভালও করেন।।
অপর প্রতিবেশী সলেমান আলী বলেন, ওনার (বৃদ্ধা) বয়স সম্ভবত সত্তরের বেশি হবে। একজন মায়ের প্রতি একমাত্র ছেলের এমন অবহেলা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এটা দেখে ভবিষ্যতে আমাদের ছেলে মেয়েরা কী শিখবে? তার একমাত্র ছেলে নাজিম বলেছেন- ‘এই বুড়ি রাতে বাড়ির কাউকে ঘুমাতে দেন না। সারাক্ষণ শুধু ঘ্যান ঘ্যান আর কান্নাকাটি করে। এজন্য তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, পারলে তাকে নদীতে ফেলে দাও’।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন প্রতিবেশী সলেমান আলী।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানিউল ফেরদৌস, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শাহীন, তেঁতুলিয়া থানা পুলিশের ওসি জহুরুল ইসলাম, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মহসিনুল হকসহ স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে যান। প্রশাসনের উপস্থিতি টের পেয়ে ছেলে নিজাম উদ্দিন ওরফে নাজিম পালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে বৃদ্ধার বউমা আতিমা খাতুন ক্ষমা চেয়ে বৃদ্ধাকে বাড়িতে নিয়ে যান।
পরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য স্থানীয় ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়। স্থানীয়রাও বৃদ্ধাকে দেখভাল করার প্রতিশ্রুতি দেন।
দেবনগর ইউপি চেয়ারম্যান মহসিনুল হক বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানতাম না। শুনলাম স্থানীয় ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম অনেক চেষ্টা করেছেন বৃদ্ধাকে ঘরে তুলে দিতে। মূলত ছেলের বউয়ের কারণেই ওই বৃদ্ধাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়া হয়।’
তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শাহীন বলেন, ‘খবর পেয়েই আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। তার নামে বরাদ্দকৃত বয়স্ক ভাতার অর্থও তার ছেলে আর বউমা আত্মসাৎ করেন। বার্ধক্যের কারণে বৃদ্ধা বেশ অসুস্থ্য। তার কোনো চিকিৎসারও ব্যবস্থাও করা হয়নি। ঘটনাটি আসলেই অমানবিক।’
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানিউল ফেরদৌস বলেন, ‘স্থানীয়দের অনুরোধে আমরা আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের পরামর্শে বৃদ্ধা মায়ের চিকিৎসাসহ তদারকির জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার খবার এবং বস্ত্রের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।’
সফিকুল আলম/এমবিআর