“জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়; হিটলার মুসোলিনির মতো একনায়কেরাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, অগ্নিগিরিতে পরিণত করেছিলো, যার পরিণতি হয়েছিলো ভয়াবহ। তারা জনগণকে উন্মাদ আর মগজহীন প্রাণিতে পরিণত করেছিলো। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলো শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।" --হুমায়ুন আজাদবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বৃহৎ বাঙালি। প্রকৃত বৃহত্ত্বের পরিচয় নিহিত থাকে মানসিকতায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে মানসিকতায় বৃহৎ ছিলেন, কখনো ক্ষুদ্রের সাধনা করেননি। চিন্তায় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র এক মানুষ তার জনগণকে দিতে চেয়েছিলেন তার মতোই এক বৃহতের আবাহন। তার বক্তৃতার বিভিন্ন অংশে একটি কথা পাওয়া যায়, বারবার তিনি বলছেন, আমার বাঙালি, আমার মানুষ, আমার কৃষক, আমার শ্রমিক। সেই মানুষকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দেয়া কেবলমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। চিন্তা ও কর্ম বাস্তবায়নের পথ সহজ ছিল না। দেশভাগলাঞ্ছিত স্বাধীনতার অভিঘাত বাঙালির মানসলোকের পক্ষে শুভ হয়নি। শুরু থেকেই এ ভূখণ্ডের মানুষ বুঝতে শুরু করে তারা চতুর্দিক থেকে নানা ভাবে পর্যুদস্ত। বাঙালি ক্রমশ আহত হয়ে প্রতিবাদের পথকেই বেছে নেয় বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে। মানুষের সংগ্রামে সবসময় সামনের কাতারে থেকে তিনি কর্মি হয়েছেন, আবার নেতৃত্ব দিয়েছেন। বৃহৎ মানুষদের মতো স্বাধীন স্বতন্ত্র চিন্তার স্ব-ভাব হতে আপন শক্তি সংগ্রহ করে উৎকর্ষের সাধনায় অবিচল ছিলেন আজীবন। প্রতিবছর আগস্ট এলে বিশেষ করে সবাই স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদিনের চিন্তায় কখনো আলাদা করা যায় না। তাকে আমাদের মনে করতেই হয়। বাংলাদেশ নিয়ে কথা হলে, এদেশের স্বপ্ন নিয়ে কথা হলে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে হয় আর এসব আলোচনায় বঙ্গবন্ধু অবধারিত নাম। আসলে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু এই তিনটি শব্দই সমার্থক৷ এই তিনটির যে কোনো একটিকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করার কোনো সুযোগ নেই৷ জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করে যারা এদেশে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা ২১টি বছর শুধু তার নামে, তার পরিবারের নামে কুৎসা রটিয়েছে, মিথ্যা ছড়িয়েছে। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। আসলে ক্ষুদ্র পরজীবী প্রকৃতির মানুষ যত চেষ্টা করুক, বড় হৃদয় সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। যারা বাংলাদেশকে ভালবাসে, তারা বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসে। যারা বাংলাদেশ চায়নি, কেবল তারাই তার হত্যাকারীদের দর্শনকে, ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তির দর্শনকে মূল্য দিতে গিয়ে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করে উল্লাস করতে পারে। জনগণের শক্তির ওপর তার ছিল অপার আস্থা-বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসা, মমত্ববোধ। তার বিশ্বাসের মর্যাদা দেয়নি গুটিকয়েক ঘাতক, যাদের আজ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ও ঠাঁই দেয়নি। খুনিরা আজ দেশে বিদেশে ধিকৃত, ঘৃণিত। বড়র সাধক এই মানুষকে খুন করেছিল ক্ষুদ্রতার পরিসরে বেড়ে উঠা ভৃত্যরা। ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তার স্বপ্ন শোষণমুক্ত সমাজ গড়া। শুরুই করেছিলেন কাজ অত্যন্ত প্রতিকূল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যখন উন্নয়নের পথে নিয়ে আসলেন সব ঝড় মোকাবেলা করে, তখন বাংলাদেশের উপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি হানে ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি, তারা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যা করে এই মানুষটিকে। বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন৷ এ দর্শনের ভিত্তিমূলে ছিল এক ঐতিহাসিক বিশ্বাস যে, কেবল জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে৷ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী, গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী` বাংলাদেশ, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন হলো তার স্বপ্ন– সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন৷আজ তার কন্যার হাতে এদেশের দায়িত্ব। ইতোমধ্যে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নের এক নতুন দিগন্তে। কিন্তু আমরা দেখছি তার এই সংগ্রামে স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোট যেমন সক্রিয়, তেমনি তার দলের কোনো কোনো অঙ্গ সংগঠনের ও ব্যক্তি বিশেষের কর্মকাণ্ড নানাভাবে তার ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্দ করছে। স্বাধীনতার পরও আমরা দেখেছিলাম নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের কত কীর্তি। ১৫ই আগস্টের পর একটা দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধু শব্দটি বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত ছিল৷ ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে রঞ্জিত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল মৌলবাদী আর সাম্প্রদায়িক হায়েনাদের উচ্ছিষ্ট ভাগাড়ে৷ দীর্ঘ সংগ্রাম আর ত্যাগ তিতিক্ষার পর আবার যখন রক্তাক্ত, পরিত্যক্ত বাংলাদেশকে উদ্ধার করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, এবার যেন সেইসব ভুল আর না ঘটে। টাউট-বাটপার, দখলদার, ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা আর ভাড়াটে মাস্তানদের হাত থেকে আওয়ামীগকে দূরে রাখতে পারলেই প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি। আশা থাকবে পরিপার্শ্বের ক্ষুদ্রতা শেখ হাসিনার দৃষ্টিকে আবিল করতে পারবে না, তার স্বপথ হতে বিচ্যুত করতে পারবে না। এইচআর/এমএস
Advertisement