আমরা যারা পড়াশোনা ও জীবিকার টানে ঢাকায় থাকি সম্ভবত তাদেরকেই বেশি ভুল বোঝেন তাদের আপনজনেরা। ঢাকার এই যান্ত্রিক ব্যস্ততার সঙ্গে কোনো মিল নেই গ্রাম কিংবা জেলা শহরগুলোর ব্যস্ততার। গ্রামে যখন রাত এগারোটা মানে মধ্যরাত, ঢাকায় হয়তো তখনও রাস্তায় ভয়াবহ জ্যামে পড়ে গাড়ি এক ইঞ্চি, আধা ইঞ্চি করে নড়ছে! ঢাকার বাইরে থাকা আমাদের আপনজনেরা বুঝতেও পারেন না, নিজের জন্য একটু সময় বের করার জন্য আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনটির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়। সবেধন নীলমনি ওই একদিনও কি আর শুয়ে বসে আরামে কাটিয়ে দেয়া যায়? সারা সপ্তাহের জমে থাকা কাজ, কোনো কোনো সপ্তাহে অতিথি আপ্যায়ন করেই কেটে যায়।
Advertisement
এ শহরে আপনি মাইলে পর মাইল হেঁটে যাবেন, কেউ আপনার দিকে একবারও মায়া নিয়ে তাকাবে না। এখানে যেমন সবুজ নেই, তেমনই মায়াও নেই। আমরা জানি না, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে কারা থাকেন। অথচ মনে পড়ে গ্রামে থাকার দিনগুলো। যখন প্রতিদিন একবার হলেও বাড়ির সবগুলো ঘরে ঢুঁ না মারলে মনের ভেতর খচখচ করতো। কারো বাসায় বিশেষ কোনো খাবার রান্না হলে সবার বাসায়ই একটু একটু করে তা পৌঁছে যেতো। কোনো কারণে বাসায় রান্না হয়নি? কোনো একটি ঘরে পাত পেতে বসে পড়লেই হলো! সেখানে নিজের বলতে সবাই। গ্রামের সেই রূপও বদলাতে শুরু করেছে জানি। কিন্তু নিশ্চয়ই তা ঢাকার মতো এতটা ভয়ঙ্করভাবে নয়।
এ শহরে পাশের বাসায় কেউ মরে গেলেও আমরা তার খোঁজ রাখি না। মৃত্যুও আমাদেরকে আর স্পর্শ করে না তেমনভাবে! অন্যদের আচরণের দিকে তাকালে তাদেরকে আপনার নিষ্ঠুর মনে হতেই পারে। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই কি একই আচরণ করছি না! আমাদের অফিসের তাড়া, ক্লাসের তাড়া, বেঁচে থাকার তাড়া চারদিকে চোখ বোলানোর সময়টুকুও গিলে খায়! খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভালোবাসতে ও বিশ্বাস করতে ভুলে যাচ্ছি। মনে আছে, আমি তখন একটি পাক্ষিক পত্রিকায় রিপোর্টারের কাজ করি। তাও বছর পাঁচেক আগের কথা। বাসা বেশ খানিকটা দূরে। সেদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাস পেলাম না। সঙ্গে টাকাও ছিল কম। সিএনজি কিংবা রিকশা নিয়ে আসাও তাই সম্ভব ছিল না। তখন দেখলাম আমার বয়সী আরো দুটি মেয়ে একই এলাকায় যাওয়ার বাস খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। বাস খুঁজতে গিয়েই পরিচয় হলো আমাদের। মেয়ে দুটি নামী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আমিও আমার পরিচয় দিলাম। ওরা বেশ সহজভাবেই মিশলো। ওদের মধ্য থেকে একজন প্রস্তাব দিলো, যেহেতু আমরা একই জায়গায় যাচ্ছি, তিনজন মিলে একটি রিকশা নিলে কেমন হয়! তাতে ভাড়াও কম লাগবে আবার যাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। আর উপায় নেই দেখে রাজি হয়ে গেলাম। তিনজন মিলে পুরো পথেই গল্প করতে করতে এলাম। পূর্বা ও নুসাইবা নামের দুটি চমৎকার মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। ওরা আমার গল্প শুনলো, আমি ওদেরটা। যখন গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম, পূর্বা বললো, আমরা তো হোস্টেলে থাকি, একদিন এসো আমাদের হোস্টেলে। বললাম, যোগাযোগ কিভাবে করবো, তোমার ফোন নম্বর আমাকে দিয়ে যাও। পূর্বা আমাকে তার ফোন নম্বর বললো। আমার ফোন নম্বরটি ওকে দেবো ভেবে ওর নম্বরে ডায়াল করতেই দেখলাম তা বন্ধ। অথচ পূর্বার হাতে তখন সচল ফোন ছিল। বললাম, পূর্বা, তোমার নম্বর তো বন্ধ বলছে। পূর্বা বললো, ওই নম্বরটা বন্ধই থাকে! বুঝতে পারলাম, পূর্বা আমাকে তার ফোন নম্বর দেয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে না। না করাটাই স্বাভাবিক। আমি কবি বলে আবেগ বেশি। বাস্তবতা বুঝি কম। পূর্বারা তো আর কবি নয়।
ঢাকায় আসার পর প্রথমদিকে ভাবতাম এখানে মানুষ মানুষকে কেন বিশ্বাস করে না! আর এই এক দশকে ভাবতে শিখে গিয়েছি- কেন বিশ্বাস করবে! জীবন ধারনের চরম ব্যস্ততা, কঠোর বাস্তবতা আমাদের বিশ্বাস-ভালোবাসাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা প্রতি পদে পদে ঠেকে গিয়ে শিখছি- এখানে একমাত্র তুমিই তোমার জন্য। তোমার পকেটে টাকা নেই, পেটে খাবার নেই- সেদিকে কারো নজর দেয়ার সময়ও নেই। কারণ, তোমাকে দেখতে গেলে তাকে দেখার যে কেউ থাকবে না! প্রত্যেকেই এখানে যে যার মতো একা। বিশেষ করে যারা পরিবারের বাইরে থাকেন। পরিবারগুলোও অনেকটা এমন। যদি আপনি কঠোর পরিশ্রমী না হন, একটা সময় আপনাকে হাত ধরে তোলার কেউ থাকে না। যদি অন্যদের ওপরেই নির্ভরশীল হতে হয়, তবে সেই জীবন আপনাকে গুটিয়ে নিতেই হবে।
Advertisement
একটা সময় ভালোবাসার সমুদ্রে নাবিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই আমি এখন জ্যামে পড়ে ভাবি, কখন বাসায় যাবো! প্রচণ্ড বৃষ্টিতে, কাদা-পানিতে দাঁড়িয়ে পার হওয়ার রিকশা খুঁজি! হয়তো এটি সাময়িক। আমি আবারও একদিন ভালোবাসার মন্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়বো। দেখা যাক, কে কাকে বদলে দেয়- এ শহর আমাকে নাকি আমি এ শহরকে!
এইচআর/জেআইএম