বিশেষ প্রতিবেদন

নিজেই অকার্যকর ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’

>> ১০০৪ জনবলের বিপরীতে অনুমোদন মিলেছে ৩৬৫>> বাদ দেয়া হয়েছে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের পদটি >> নিজস্ব কোনো ল্যাবরেটরি নেই কর্তৃপক্ষের 

Advertisement

প্রতিষ্ঠার তিন বছর পার হলেও জনবল ও সরঞ্জাম সংকটে কার্যকর হতে পারছে না বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এতদিনে সারাদেশের জন্য মাত্র ৩৬৫ জনবলের অনুমোদন পেয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া ল্যাবরেটরিসহ অন্যান্য সহায়ক সরঞ্জামও নেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাটির।

সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, সারাদেশে কর্তৃপক্ষের জন্য এক হাজার চারজন জনবল চেয়ে আবেদন করা হয়। কিন্তু অনুমোদন মিলেছে ৩৬৫ জনের। কর্তৃপক্ষের আইনে থাকা নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের পদটি বাদ দিয়ে জনবল কাঠামোর অনুমোদন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সাংগঠনিক কাঠামোতে সাতটি বিভাগের প্রস্তাব করা হলেও তিন বিভাগের অনুমোদন মিলেছে। ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ এ থাকা জনবলের সম্মতিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যায়নি। আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের অভাবে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।

Advertisement

আরও পড়ুন >> অপরিশোধিত পানি দিয়ে রান্না : কেএফসিকে ১ লাখ টাকা জরিমানা

২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এবং এজন্য একটি দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এ আইন করা হয়েছে।

২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। একদিন পর ২ ফেব্রুয়ারি ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে গেজেট জারি করা হয়।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। আমরা সবাই এটি চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি তাদের যেভাবে কাজ করার কথা তারা সেভাবে কাজ করতে পারছে না। কারণ তাদের লোকবল নেই, নেই লজিস্টিক সাপোর্টও।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে বিজ্ঞপ্তি দেয়াসহ বিভিন্ন কাজ তারা (কর্তৃপক্ষ) করছে। আমরা মনে করি কর্তৃপক্ষকে ইফেক্টিভ (কার্যকর) করতে যত ধরনের সাপোর্ট আছে সরকার তা দেবে।’

আরও পড়ুন >> নিউ মার্কেটে ফাস্টফুডের নামে বিক্রি হচ্ছে ‘বিষফুড’

নিরাপদ খাদ্য আইনের অধীনে ২৩টি বিভিন্ন অপরাধে এক থেকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা চার থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ ভবনে ভাড়া করা ফ্লোরে কর্তৃপক্ষের অফিস চলছে।

বর্তমানে কর্তৃপক্ষের জনবলের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান, চারজন সদস্য, একজন সচিব, চারজন পরিচালক, চারজন উপ-সচিবসহ মোট ১৬ সদস্য রয়েছেন। কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয়, আটটি মেট্রোপলিটন ও ৬৪টি জেলা কার্যালয়ের জন্য যে জনবল অনুমোদন দেয়া হয়েছে, তাতে এটি আইনের উদ্দেশ্য পূরণে ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ৩৬৫ জনবলের একটি প্রস্তাব সরকার অনুমোদন দিয়েছে। আমরা এক হাজার চারজন জনবল চেয়েছিলাম। এখন আমরা নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন করছি। বিধিমালাটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ে (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) আছে। ভেটিং হয়ে আসলে আমরা নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করব।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকবল অপর্যাপ্ত। আমরা সরকারের কাছে পুনরায় আবেদন করছি যাতে আমাদের (পদ সৃষ্টি সংক্রান্ত) প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা হয়। আমরা শিগগিরই একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দেব। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি কমিটিও করা হয়েছে, তারা আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোটা পর্যালোচনা করবে, সুপারিশ করবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন করা জনবল কাঠামোতে খাদ্য পরিদর্শকের পদটিও নেই জানিয়ে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, ‘নিজস্ব খাদ্য পরিদর্শক ছাড়া কীভাবে কাজ চলবে? এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কোনো ল্যাবরেটরি নেই জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিজস্ব রেফারেন্স ল্যাবরেটরি করার জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব আমরা তৈরি করছি। এটি সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে করা হবে।’

আরও পড়ুন >> তেলাপোকায় খাওয়া আপেল, ফাঙ্গাসযুক্ত কাবাব

নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতায় কর্তৃপক্ষ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছে। এছাড়া কর্তৃপক্ষ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান মাহফুজুল হক।

প্রয়োজনীয় লোকবল ও সরঞ্জাম নিশ্চিত করা হলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে যে ভূমিকা রাখার কথা, কর্তৃপক্ষ সেটা রাখতে সক্ষম হবে বলেও জানান তিনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রাথমিকভাবে জনবল নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এটি যাত্রার খুব বেশিদিন হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, নানাভাবে উদ্যোগ নিয়ে এটাকে আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়। এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। একটু সময়ও তো দিতে হবে।’

কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে তিন হাজার ৩৬৫ জনের জনবল কাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছিল। পরে উপদেষ্টাপরিষদ (খাদ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা পরিষদ) জনবল কমিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী এক হাজার চারজনের প্রস্তাব করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয়, মেট্রোপলিটন ও জেলা কার্যালয়ের জন্য ৪২২টি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনে সম্মতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরবর্তী সময়ে অর্থ বিভাগ থেকে আরও কমিয়ে ৩৬৫ জনের সম্মতি পাওয়া যায়।’

আরও জানা গেছে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে প্রস্তাবিত জনবল কাঠামোতে সাতটি বিভাগের প্রস্তাব করে সাতজন পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ এর ১৪ (৪) ধারায় পাঁচটি বিশেষায়িত বিভাগের নেতৃত্বে পাঁচজন পরিচালক নিয়োজিত থাকার কথা বলা হয়েছে। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তিনজন পরিচালকের নেতৃত্বে তিনটি বিভাগের সম্মতি দেয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ৭০ জন নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত জনবলে পরিদর্শকের পদ নেই। অথচ আইনের ৫১ ধারায় নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগ ও দায়িত্ব প্রদানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মাঠপর্যায়ে খাদ্য ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন, নমুনা সংগ্রহ, সন্দেহজনক খাদ্যদ্রব্য জব্দ বা ধ্বংস করা; এককথায় নিরাপদ খাদ্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেগুলো করলে আইনটি (নিরাপদ খাদ্য আইন) সঠিকভাবে আমরা প্রয়োগ করতে পারব, এর সিংহভাগ লজিস্টিক সাপোর্ট আমাদের দেশে নেই। আমাদের নিজস্ব ল্যাবরেটরি নেই। দেশে অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবও নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকবল নেই, এছাড়া ইন্সট্রুমেন্ট না থাকলেও তো আমরা কাজ করতে পারব না।’

‘আমাদের নিজস্ব ইন্সপেক্টর নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকারের সাড়ে ৭০০ স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ইন্সপেক্টরদের কাজ আর নিরাপদ খাদ্য ইন্সপেক্টরদের কাজ এক নয়। আমরা তাদের ট্রেনিং দিচ্ছি।’

কর্তৃপক্ষের দুটি বিধিমালা ও চারটি প্রবিধানমালা প্রকাশিত হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক ইকবাল রউফ বলেন, ‘এছাড়া আরও তিনটি প্রবিধানমালা প্রণয়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কাজ করার জন্য এগুলো জরুরি। আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে আমরা কাজ করছি।’

আরও পড়ুন >> ১৫ দিন আম না কেনার পরামর্শ

কর্তৃপক্ষের সদস্য বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে আমাদের বলতে গেলে কিছুই নেই। একটি মোবাইল ল্যাবরেটরি কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। এটা কিনতে পারলে বাজারে গিয়ে কুইক টেস্টের মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা যাবে। লজিস্টিকগুলো হাতে পেলে কাজে গতি আসবে এবং আমাদের তৎপরতা দৃশ্যমান হবে।’

আইন অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করা সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের জানিয়ে ইকবাল রউফ মামুন বলেন, ‘সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে আমরা মৎস্য অধিদফতর, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, কৃষি বিপণন অধিদফতর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছি। আরও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে এমওইউ খসড়ার পর্যায়ে রয়েছে। এতে বলা থাকবে, তারা কোন কাজগুলো করবেন এবং আমাদের কীভাবে সহযোগিতা করবেন।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, কাজের ধরন, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে জনবল অনুমোদন দেয়া হয়। সরকারের যাতে ভালো হয় সে বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনবল অনুমোদনের ক্ষেত্রে যাতে একই কাজের জন্য দুই ধরনের জনবল না হয়ে যায়, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়।

আরএমএম/এমএআর/পিআর