বার্সেলোনায় যোগ দেয়া নিয়ে বিশ্বকাপের আগেই বাজার গরম করে তুলেছেন ফরাসি তারকা আন্তোনিও গ্রিজম্যান। ফরাসি মিডিয়ার খবর, অ্যাটলেটিকো তারকার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করছেন লিওনেল মেসি। আবার মেসি নিজেও জানিয়েছেন, গ্রিজম্যান যদি ন্যু ক্যাম্পে যোগ দেন, তাহলে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন।
Advertisement
লক্ষ্মণ দেখে মনে হচ্ছে আগামী মৌসুমে ন্যু ক্যাম্পে গ্রিজম্যানের খেলাটা প্রায় নিশ্চিত। ইউরোপিয়ান দলবদলে বড় কোনো তারকা ফুটবলারের দলবদলের আগে এমনই গুঞ্জন তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ট্রান্সফার সম্পন্ন হয় সেই খেলোয়াড়ের। গ্রিজম্যানের ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটনা হয়তো ঘটতে যাচ্ছে।
তবে যাকে নিয়ে এত আলোচনা, সেই গ্রিজম্যানের মাথায় কিন্তু এখন এসবের কিছুই নেই। তার কেবলই চিন্তা বিশ্বকাপ। ফ্রান্সকে আরও একটি বিশ্বকাপ শিরোপা কিভাবে উপহার দেয়া যায় সে পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতিতেই ব্যাস্ত তিনি। দিদিয়ের দেশমের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি স্কোয়াডেও ইতিমধ্যে যোগ দিয়েছেন গ্রিজম্যান।
রাশিয়া বিশ্বকাপে এবারের সেরা যে কয়টি দেশ ফেবারিট, তার মধ্যে অন্যতম ফ্রান্স। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয়ের পর ২০০৬ সালে একবার সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন জিনেদিন জিদানরা। ফাইনালে ইতালির কাছে হেরে না গেলে, দুটি বিশ্বকাপ লেখা হতো ফ্রান্সের নামের পাশে। তবে এবার সে কাজের ভার পড়েছে আন্তোনিও গ্রিজম্যানদের কাঁধে। জিদানদের অসমাপ্ত কাজকে কতদুর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার।
Advertisement
ফরাসি দলটির দিকে তাকালে যে কারও ঈর্ষা হওয়ার কথা। স্পেন, ব্রাজিল কিংবা জার্মানিরও এতটা ভালো কম্বিনেশন নেই। ডিফেন্সে রাফায়েল ভারানে, স্যামুয়েল উমতিতি, জিব্রিল সিদিব, আদিল র্যামির মত তারকা রয়েছেন। মিডফিল্ডে পল পগবা, ব্লাইজ মাতৌদি, এনগোলো কন্তে, স্টিভেন জঞ্জি কিংবা কোরেন্তিন তোলিসোর মত তারকারা। এতটা শক্তিশালী মিডফিল্ড শুধু স্পেনেরই রয়েছে।
আক্রমণভাগকে তুলনা করা যেতে পারে আর্জেন্টিনার সঙ্গে। আন্তোনিও গ্রিজম্যানের সঙ্গে বাকি যারা রয়েছেন, তাদের দেখলে পিলে চমকে যেতে পারে অন্যদের। অলিভিয়ের জিরু, কাইলিয়ান এমবাপে, ওসমান ডেম্বেলে, ফ্লোরিয়ান থাউবিন, নাবিল ফেকির, থমাস লেমার। এদের মধ্যে গ্রিজম্যান, জিরু এবং এমবাপে নিয়মিত একাদশে থাকবেন এটা প্রায় নিশ্চিত। যেই থাকুক, এই আক্রমণভাগ দেখলে সবারই ভয় পাওয়ার কথা।
বিশ্বকাপে ফ্রান্স দলটির সবচেয়ে বড় সুবিধা দলটিতে তরুণ এবং প্রতিভাবান ফুটবলারের ছড়াছড়ি। তবে পুরো দলটি কেন্দ্রীভূত গ্রিজম্যানকে ঘিরেই। ফরাসি দলটির সেরা তারকাই হচ্ছেন তিনি। পল পগবা, কাইলিয়ান এমবাপে কিংবা রাফায়েল ভারানে থেকে শুরু করে বড় তারকারা রয়েছেন এই দলে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপে ফরাসিদের স্বপ্ন সারথি হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে কেবল গ্রিজম্যানের নামই।
বাবা জার্মান বংশোদ্ভূত আর মা হচ্ছেন পুরোপুরি পর্তুগিজ। নানার সঙ্গে ছোটবেলাতেই গ্রিজম্যানের মা চলে আসেন ফ্রান্সে, জীবিকার খোঁজে। সেখানেই থেকে যান এবং বিয়ে করেন জার্মান বংশোদ্ভূত গ্রিজম্যানের বাবা অ্যালেইনকে। মায়ের নাম ইসাবেলে। ইউরোপজুড়েই যেন শেকড় বিস্তৃত গ্রিজম্যানের। কিন্তু তিনি নিজে হয়ে গেলেন জাতীতে ফরাসি।
Advertisement
ছোটবেলা থেকে ফুটবল তার ধ্যান-জ্ঞ্যান। কিন্তু তার উচ্চতা এবং লিকলিকে হালকা শরীর বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রিজম্যানের কোনো ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে। তবে ২০০৫ সালে মন্তেপিয়ের ক্লাবে ট্রায়াল দিতে গিয়ে কপাল খুলে যায় তার। পিএসজির ইয়থ একাডেমির অসাধারণ পারফরম্যান্স করে। এরপর আর যায় কোথায় গ্রিজম্যানকে ইয়থ একাডেমিতে নেয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেশ কয়েকটি ক্লাব।
তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল সোসিয়েদাদের স্কাউট। ম্যাচ শেষেই সোসিয়েদাদের ক্লাব কর্মকর্তারা গ্রিজম্যানকে প্রস্তাব দেন সান সেবাস্তিয়ানে তাদের ক্লাবে গিয়ে সপ্তাহব্যাপি ট্রায়াল দেয়ার জন্য। এই প্রস্তাব লুফে নিলেন ফরাসি এই উঠতি তারকা। সোসিয়েদাদে চলে যান তিনি। প্রথম সপ্তাহের পর আরও এক সপ্তাহ ক্লাবের একাডেমিতে অবস্থান করার জন্য প্রস্তাব তাকে দেয়া হলো তাকে এবং সোসিয়েদাদ ক্লবের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ক্লাবের পক্ষ থেকে।
২০০৫ সালে সান সেবাস্তিায়ানে আসার পরই নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে মুগ্ধ করতে থাকেন সবাইকে। ২০০৯-১০ মৌসুমেই প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান গ্রিজম্যান। প্রাক মৌসুমের ম্যাচগুলোতে খেলার সুযোগ দেয়া হয় তাকে। ৫ ম্যাচে ৪ গোল করে এ সময় সবার নজর কাড়েন তিনি।
২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচের জার্সি ওঠে তার গায়ে। কোপা ডেল রে’র ম্যাচে রায়ো ভায়োকানোর বিপক্ষে, পরিবর্তিত হিসেবে। চারদিন পর লা লিগায় অভিষেক ঘটে তার। তাও পরিবর্তিত হিসেবে। সোসিয়েদাদের হয়ে এরপর টানা খেলে গেলেন ২০১৪ সাল পর্যন্ত। খেলেছেন মোট ১৮০টি ম্যাচ। গোল করেছেন ৪৬টি।
এরই মধ্যে ফরাসি অনুর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে খেলতে শুরু করেন গ্রিজম্যান। ইউক্রেনের বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ফ্রান্সের হয়ে জয়সূচক গোলটি করেন তিনি। ২০১০ সালেই ইউরোপিয়ান অনুর্ধ্ব-২০ দলে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। ওই টুর্নামেন্টে গ্রিজম্যানের অসাধারণ নৈপুন্যে স্পেনকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ফ্রান্সই।
ফ্রান্সের বয়সভিত্তিক দলগুলোর হয়ে একের পর এক দারুণ পারফরম্যান্স সত্বেও ২০১৪ সালের আগে জাতীয় দলে সুযোগ পাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত অনুর্ধ্ব-১৯, অনুর্ধ্ব-২০, অনুর্ধ্ব-২১ দলে খেলার পর প্রবেশ করেন জাতীয় দলে।২০১৪ বিশ্বকাপের আগে প্রথম দিদিয়ের দেশম নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে প্রথম ডেকে নেন গ্রিজম্যানকে।
এরপর ডাক পেলেন বিশ্বকাপের দলেও। ফ্রাঙ্ক রিবেরির ইনজুরির কারণে বাম উইংয়ে শুরু থেকেই জায়গা পেয়ে যান। গ্রিজম্যানের কৃতিত্বেই বলতে গেলে ফরাসিরা খেলে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। যেখানে গিয়ে তারা হেরে যায় জার্মানির কাছে। এরপর থেকে নিয়মিত ইউরো এবং বিশ্বকাপ বাছাই পর্বেও খেলতে শুরু করেন গ্রিজম্যান। গ্রিজম্যানের কল্যাণেই ২০১৬ ইউরোর ফাইনালে উঠে আসে ফরাসিরা। যদিও রোনালদোর পর্তুগালের কাছে হেরে যেতে হয় তাদের। তবে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় এবং সর্বোচ্চ স্কোরার- দুটো পুরস্কারই জেতেন তিনি।
ক্লাব ফুটবলে রিয়াল সোসিয়েদাদ থেকে ২০১৪ সালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে যোগ দেন তিনি। মূলতঃ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদই ঘুরিয়ে দেয় তার ক্যারিয়ার। পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে তাকে। অ্যাটলেটিকোতে এসে নিজের ক্যারিয়ারকে এতটাই প্রস্ফুটিত করে তুললেন যে, তার কল্যাণে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ রিয়াল এবং বার্সেলোনার সঙ্গে সমানতালে লড়াই করতে শুরু করে। এমনকি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ দু’বার খেলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল এবং একবার হলো লা লিগা চ্যাম্পিয়ন। এবার ইউরোপা লিগও গ্রিজম্যানের কল্যাণে জিতে নিয়েছে অ্যাটলেটিকো।
আইএইচএস/জেআইএম