ব্রিটিশদের হটিয়ে এসেছিল পাকিস্তান। এরপর পাকিস্তানকে তাড়িয়ে আসে বাংলাদেশ। ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশদের সেই খচিত মানচিত্র ছিঁড়ে ফেলে স্বাধীন হবে ছিটমহল। ছেলে-মেয়েরা নতুন পরিচয়ে শুরু করবে জীবন। আর অবসান ঘটবে শোষণ ও বঞ্চনার এবং মুক্তির সূর্য দেখার অপেক্ষা। শুক্রবার মধ্যরাতে ভারতীয় ১১১ ছিটমহল মিশে যাবে বাংলাদেশে। মধ্যরাতে ছিটমহলের বাড়িতে বাড়িতে ৬৮টি করে মোমবাতি ও প্রদীপ প্রজ্বলন, মশাল ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রার্থনা, হাডুডু, লাঠিখেলাসহ গ্রামীণ খেলাধুলা, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড়, জারিসারি বাউলসহ নাচ-গান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা, বাড়িতে বাড়িতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা, আলোকসজ্জা, রাত ১২টা এক মিনিটে ৬৮ বার তোপধ্বনি। প্রশাসন থেকে ছিটমহলগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই দিনটিরই অপেক্ষা করে আছেন সবাই বছরের পর বছর ধরে। ছিটমহলে মুক্তির সূর্য দেখার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছেনা। শুক্রবার ছিটমহলের অভ্যন্তরে থাকা মসজিদগুলোতে জুম্মার নামাজের পর বিশেষ মোনাজাত করা হয়। শনিবার পহেলা আগস্ট সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলে ভারতীয় পতাকা নামিয়ে দিয়ে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হবে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। ভোরে ওইসব ছিটমহলে বাংলাদেশের সরকারি উদ্যোগে জাতীয় পতাকা উড়ানো হবে। এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরার মধ্যে স্বাক্ষরিত স্থল সীমানা চুক্তি (এলবিএ) এবং ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী উভয় দেশের ছিটমহল বিনিময় বাস্তবায়ন হচ্ছে। সে অনুযায়ী শুক্রবার (৩১ জুলাই) মধ্যরাতে দুই দেশের মধ্যে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ মধ্যরাত থেকেই মূল ভূখন্ডে অবস্থিত ভারতীয় ১১১ ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখন্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। একই সঙ্গে ভারতের ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহল ভারতের ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। উভয় দেশের অপদখলীয় জমিও ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এদিকে, বাংলাদেশে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত জমি সংযুক্ত করে এবং বহির্ভূত জমি বাদ দিয়ে একটি গেজেট নোটিফিকেশন জারি করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের ভূখন্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকার অপশন প্রদানকারীরা ছাড়া অন্যরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাবেন। আর ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন।শুক্রবার কোন ছিটমহলবাসীরা কাজের সন্ধানে কেউ কোথাও বেরুইনি। কাজের জন্য নেই কোন ব্যস্ততা। ব্যস্ততা ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির উৎসবের প্রতিক্ষা। বিভিন্ন ছিটমহল ঘুরে চোখে পড়ছে যেন তাদের মাঝে ঈদ বা পূঁজোর উৎসব লেগেছে। ছিটমহলবাসী সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সময়টির জন্য নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার অভ্যন্তরে থাকা চারটি ছিটমহলের ১১৯টি পরিবারের ৫৪৫ সদস্যরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। তারা নিজেদের বাড়ির ঘরে ঘরে নিয়ে এসে রেখেছেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাসহ ৬৮টি করে মোমবাতি। অপরদিকে, ছিটমহলের চারটি হিন্দু পরিবার তাদের বাড়িতে এনেছে ৬৮টি করে প্রদীপ বাতি। ছিটমহল জুড়ে সেই রাতটিতে বনভোজন আর আনন্দ উল্লাসের প্রস্তুতি রেখেছে ছিটমহলবাসী নিজ উদ্যোগে। এই চার ভারতীয় ছিটমহলের কোন পরিবার বা সদস্য ভারতের মূল-ভূখন্ডে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ না করে বাংলাদেশেই থাকতে চেয়ে নিবন্ধন করে। নগর জিগাবাড়ি ছিটমহলের ৪৫টি পরিবারের ২২০ জন সদস্যের মধ্যে চারটি হিন্দু পরিবার রয়েছে। মৃত অতুল চন্দ্রের তিন ছেলে রঞ্জিত চন্দ্র রায়, ভরত চন্দ্র রায় এবং সনাতন চন্দ্র রায় ও মৃত বীরেন্দ্র রাথের ছেলে অতুল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে কথা বললে তারা ছিটমহল বিনিময়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেন, `বাপ দাদাদের রেখে যাওয়া ভিটে বাড়ি রেখে কোথাও যাবনা বলেই ভারতীয় নাগরিক থেকে নাম কাটিয়ে বাংলাদেশর নাগরিক হতে নিবন্ধন করেছি।` বড়খানকিবাড়ী ছিটমহলে ২১ পরিবারে ৮৯ জন, গিদালদহ ছিটমহলে ৪৫ পরিবারে ১৯৪ জন, খারিজা গীতালদহ ছিটমহলে আটটি পরিবারের ৪২ জন তারা সকলেই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে বাংলাদেশের নাগারিক হবার সময়ের অপেক্ষার প্রহর গুণছে। শুক্রবার রাতে বহিরাগত কেউ কোন প্রকার সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজাউল করিম বলেন, শুক্রবার ছিটমহল উন্মক্ত করা উপলক্ষে সরকারিভাবে ছিটমহলে ২৯ নং বড় খানকি খারিজা গিদালদহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন ছিটমহলের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।ডিমলা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রহুল আমিন খান জানান, সন্ধ্যা থেকে ডিমলার চারটি ছিটমহলে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেয়া হবে। রাতে বহিরাগত কেউ কোন প্রকার সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। নীলফামারী প্রতিনিধি/এআরএ/পিআর
Advertisement