অর্থনীতি

নিষ্ক্রিয় আইসিবি

ধারাবাহিক দরপতন আর লেনদেনের খরায় অনেকটাই নিষ্প্রাণ দেশের শেয়ারবাজার। সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য দেয়া বিশেষ সুবিধা এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জেকে পাওয়ার মতো সুখবরও বাজারে প্রাণ ফিরছে না।

Advertisement

ক্রমগত শেয়ারের দরপতনে একটু একটু করে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমে আসছে। পুঁজি হারানোর শঙ্কার পাশাপাশি আস্থার সংকট জেঁকে বসেছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ফলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে দেশের শেয়ারবাজারে। কী কারণে শেয়ারবাজারের এমন চিত্র- তা নিয়ে জাগো নিউজের পাঁচ পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।

আরও পড়ুন >> দুরবস্থায় ব্যাংক খাত

সংকটের সময় শেয়ারবাজারে সাপোর্ট দেয়া ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) অন্যতম দায়ীত্ব হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি এ প্রতিষ্ঠান অনেকটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে বাজারের টানা দরপতন দীর্ঘ হয়েছে বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ আইসিবি বর্তমানে শেয়ারবাজারে কোনো সাপোর্ট দিচ্ছে না।

Advertisement

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অনেক বছর ধরে আইসিবির কাছে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের আড়াই হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে অতিরিক্ত আমানত হিসেবে উল্লেখ করে ডিসেম্বরের মধ্যে ফেরত দিতে আইসিবিকে নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশ পালন করতে হলে শেয়ার বিক্রি করতে হবে বলে জানায় আইসিবি। 

প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, এতে শেয়ারবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি আমলে নেয়নি। শেষে আইসিবি বাধ্য হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করলে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ব্যাপক দরপতন শুরু হয়।

এ সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, আইসিবি ডিসেম্বরের মধ্যে দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করবে। এ গুজবে পুরো ডিসেম্বরজুড়ে বাজারে দরপতন হয়। পরে এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ইউনূসুর রহমানের হস্তক্ষেপে অতিরিক্ত আমানত ফেরত দেয়ার সময় বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আইসিবির শেয়ার বিক্রির চাপ কিছুটা কমে। তবে, বাজার থেকে শেয়ার কিনে সাপোর্ট দেয়ার কাজ আর করেনি আইসিবি। ফলে আইসিবির শেয়ার বিক্রির যে নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ে তার রেশ এখনও রয়েছে- এমনটাই মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, ‘আজ শেয়ারবাজারের যে অবস্থা তার জন্য আইসিবি অন্যতম দায়ী। আইসিবির শেয়ার বিক্রির চাপের কারণেই বাজরের এ অবস্থা। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসিও দায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণেই আইসিবি শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছিল। আইসিবি যদি গত নভেম্বরে শেয়ার বিক্রির চাপ না বাড়াত তা হলে হয়ত আজ বাজারের এ অবস্থা হতো না।’ 

Advertisement

এদিকে আইসিবিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের অর্থ দিয়ে সমস্যায় জর্জরিত ফারমার্স ব্যাংক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকপ্রতি ১৬৫ কোটি টাকা করে মোট ৬৬০ কোটি টাকা এবং আইসিবি ৫৫ কোটি টাকাসহ সর্বমোট ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেবে ফারমার্স ব্যাংককে।এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বাধাও দূর হয়েছে। আইসিবির টাকা ফারমার্স ব্যাংকের মতো দুর্বল ব্যাংকে যাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে শেয়ারবাজারে সাপোর্ট দেয়ার সক্ষমতাও কমে যাবে বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি জানি না শেয়ারবাজারে সাপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে আইসিবি এখন কী ভূমিকা পালন করছে। তবে আমি বিএসইসির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আইসিবিকে প্রায় বিনিয়োগ করাতাম বাজার স্থিতিশীল করতে। সেটা আইসিবির করা উচিত।’

ফারমার্স ব্যাংকে আইসিবির অর্থ দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি ফারমার্স ব্যাংকের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। আইসিবি, সোনালী ব্যাংক ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নিজেদের অবস্থাই সুবিধাজনক নয়। আবার তাদের ওখানে (ফারমার্স ব্যাংক) ঋণ দেয়ার দরকার ছিল না।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘এখন যে দরপতন হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। এর জন্য দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক। শেয়ারবাজারকে ভাল করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বরং তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ শেয়ারবাজারের বিপক্ষে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যতগুলো পদক্ষেপ নিচ্ছে সবই শেয়ারবাজারের উন্নয়নের পরিপন্থী।’

ডিএসইর সাবেক পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন বলেন, ‘কথা ছিল আইসিবি শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট দেবে। কিন্তু এখন আইসিবির টাকা যাচ্ছে ফারমার্স ব্যাংকে। একটি দুর্বল ব্যাংককে সাপোর্ট দেয়ার জন্য আইসিবির টাকা গেলে শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট কে দেবে? আগে আইসিবি সাপোর্ট দিত এখন সেটাও নাই। যে কারণে শেয়ারবাজারে নীরব ধস চলছে।’

আইসিবি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আইসিবি মাঝখানে তিন হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। এই যে শেয়ারবাজারে পতন তা শুরু হয়েছে গত নভেম্বর থেকে। যেটা শোনা যায়, সে সময় আইসিবি তিন হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। তারপর শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট দিতে যে পরিমাণ শেয়ার কেনা দরকার আইসিবি সেভাবে তা করছে না।’

বিনিয়োগকারী রাসেল আহমেদ বলেন, ‘ব্রোকারেজ হাউজে গিয়ে শুনতে পাচ্ছি আইসিবি এখন বাজার থেকে শেয়ার কিনছে না। অথচ আগে দেখেছি বাজার যখন নিম্নমুখী হতো আইসিবি শেয়ার কিনে বাজারকে সাপোর্ট দিত। কিন্তু এখন আইসিবি নিষ্ক্রিয়। যে কারণে বাজারে এমন টানা দরপতন হচ্ছে।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাপোর্ট তো আমরা দিয়েই যাচ্ছি। সাপোর্ট দিতে দিতে সামর্থের তো একটা জায়গা থাকে আমাদের, একটা তো লিমিটেশন থাকে। আনলিমিটেড তো সম্ভব নয়। এরপরও নানাভাবে আমরা মার্কেটকে সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেছি।’

‘বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে, ওই টাকা লোকাল (স্থানীয়) মার্কেটে বিনিয়োগ করছি। আমরা বাজারকে সাপোর্ট দিতে যখন শেয়ার ক্রয় করছি, তখন বিক্রির চাপ চলে আসছে। ফলে সাপোর্টটা সেভাবে কাজে আসছে না।’

এমএএস/এমএমজেড/এমএআর/আরআইপি