খেলাধুলা

নেইমার : বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্বপ্ন সারথি

ব্রাজিলের রাস্তা কিংবা পাভেলাগুলোয় (বস্তি) অসংখ্য মনি-মুক্তা ছড়িয়ে। খনি থেকে যেভাবে হিরা কিংবা সোনা আহরণ করা হয়, ব্রাজিল থেকে এভাবে মনি-মুক্তাগুলো কুড়িয়ে আনার জন্য ওঁতপেতে থাকে ইউরোপিয়ানরা। ইউরোপের জনপ্রিয় প্রতিটি ক্লাবেরই স্কাউটরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লাতিন আমেরিকাজুড়ে।

Advertisement

বিশেষ করে ব্রাজিলে। তারা ঘুরে বেড়ায় রাস্তা থেকে বস্তিতে। শহর থেকে প্রান্তরে। ফুটবল নিয়ে কারিকুরি করা কাউকে দেখলেই তার ওপর নজর রাখতে শুরু করে। খবর পাঠায় নিজ নিজ ক্লাবে। ছবি কিংবা ভিডিও’ও পাঠিয়ে দেয়। অবশেষে ফুটবল নিয়ে কারিকুরি করা বস্তি কিংবা রাস্তার সেই ছেলেটির ঠাঁই মিলে যায় ইউরোপের নামকরা কোনো ক্লাবের একাডেমিতে।

ফুটবল দিয়ে বিশ্বজোড়া নাম করেছেন, এমন রথি-মহারথি ফুটবলারের জীবন এ ধরনের গল্পেই ভরা। বর্তমান সময়ের মেসি থেকে নেইমার, সবার জীবনেই রয়েছে এ ধরনের ঘটনা। ব্রাজিল সুপারস্টার নেইমারকে হয়তো ইউরোপের কোনো একাডেমিতে ফুটবল শিখতে হয়নি। তবে তারও উঠে আসার গল্প স্ট্রিট ফুটবল থেকে। রাস্তার ফুটবল খেলতে খেলতেই গড়ে উঠলেন আজকের সবচেয়ে দামি ফুটবলারটি, নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়র।

পেলের মতই সাও পাওলোর ক্লাব সান্তোসে বেড়ে উঠেছেন ব্রাজিলের বর্তমান সময়ের এই সেরা তারকা। তবে ব্রাজিলে চিরাচরিত নিয়মানুসারে বিরল প্রতিভাগুলো উঠে আসে হয় ফুটসাল খেলতে খেলতে কিংবা স্ট্রিট ফুটবল খেলে। শিশুকাল থেকে একটু বড় হওয়ার পরই ফুটসাল এবং স্ট্রিট ফুটবল- দুটোর প্রতিই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন নেইমার।

Advertisement

নেইমার ফুটবল খেলা শুরুর আগে তার পরিবারের একটি বাড়ি ছিল না ঠিকমত মাথা গোঁজার মতো। নেইমারের আয় দিয়েই সর্বপ্রথম সাও পাওলোর ক্লাব সান্তোসের কাছাকাছি ভিলা বেলমিরোতো জায়গা কিনে নিয়ে একটি বাড়ি নির্মাণ করে নেইমারের বাবা-মা। স্ট্রিট ফুটবলার থেকে যখনই পেশাদার ফুটবলে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, তখন থেকেই তার পরিবারের জীবনমানের উন্নতি হতে শুরু করে।

১৫ বছর বয়সে মাসে ১০ হাজার রেইস করে আয় করেন নেইমার। ১৬ বছর বয়সে সে আয় গিয়ে দাঁড়ায় মাসে ১ লক্ষ ২৫ হাজার রেইসে। ১৭ বছর বয়সে প্রথমবারেরমত সান্তোসের সিনিয়র দলের হয়ে খেলার জন্য চুক্তি করেন। হয়ে যান পুরোপুরি পেশাদার ফুটবলার। একই সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান কোম্পানিগুলোও হুমড়ি খেয়ে পড়ে নেইমারের দিকে। একের পর এক আসতে থাকে স্পন্সরশিপ চুক্তি।

২০০৩ সালের শেষের দিকে নেইমার যোগ দেন সান্তোস এফসির একাডেমিতে। তখন শুধুই একজন বালক তিনি। রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকাদের খেলা দেখে দেখে নিজে স্বপ্ন দেখতেন, একদিন বড় তারকা হবেন। সেই স্বপ্নই আজকের নেইমারে পরিণত করেছে তাকে। সান্তোসের একাডেমিতেই নিজের জাত চেনাতে শুরু করেছিলেন তিনি।

ব্রাজিল ফুটবল মানেই সান্তোসের বিশাল অবদান। পেলে থেকে শুরু করে বিখ্যাত অনেক তারকাই উঠে এসেছেন এই ক্লাব থেকে। নেইমারও তার ব্যতিক্রম নন। ভেতরে যে প্রতিভা ছিল নেইমারের, তার স্ফুরণ ঘটানোর মূল কাজটা করে দিয়েছে সান্তোসই। ২০০৩ থেকে ২০০৯- পর্যন্ত সান্তোসের যুব ফুটবলে খেলেন নেইমার এবং নিজেকে পরিপূর্ণরূপে গড়ে তোলেন।

Advertisement

২০০৯ সালে শুরু হয় তার সিনিয়র ক্যারিয়ার। মাত্র ১৭ বছর বয়সে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সান্তোসে খেলেন তিনি, করেন ৫৪ গোল। এ ক্লাবের হয়ে ২০১০ সালে জেতেন কোপা দো ব্রাজিল। ২০১১ সালে কোপা লিবারতোদেরেস এবং ২০১২ সালে রিকোপা সুদামেরিকানা। সান্তোসে থাকতেই তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে।

রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যানইউ, ম্যানসিটি, চেলসি, এসি মিলান কিংবা বায়ার্ন মিউনিখ- সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে নেইমারের ওপর। এমনকি রিয়াল মাদ্রিদ তো সাও পাওলো গিয়ে বসেছিল তার সঙ্গে চুক্তি করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে নানা ঘটনার পর বার্সায় যোগ দেন তিনি। ২০১৪ বিশ্বকাপের আগে হয়ে যান বার্সেলোনার ফুটবলার।

বার্সায় থাকলেন ৪ বছর। ২০১৭-১৮ মৌসুমের শুরুতে হুট করেই বার্সা ছেড়ে যোগ দেন ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে। গড়েন বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলারের রেকর্ড। তাকে ২২২ মিলিয়ন ইউরোয় কিনে নেয় পিএসজি। তার আগে বার্সার হয়ে ১২৩ ম্যাচ খেলে গোল করেন ৬৮টি। বার্সার হয়ে জিতেছেন দুটি লা লিগা। একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, তিনটি কোপা ডেল রে, একটি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। ২০১৫ সালে ফিফা ব্যালন ডি’অরে তিনি হয়েছিলেন তৃতীয়। শুধু তাই নয়, ২০১৭ ফিফা বর্ষসেরা এবং ব্যালন ডি’অর উভয় জায়গাতেই তৃতীয় হয়েছিলন নেইমার।

২০০৯ সাল থেকেই নেইমার শুরু করে ব্রাজিলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা। ২০০৯ সালে অনুর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই জাপানের বিপক্ষে গোল করেন নেইমার। তার খেলা দেখে পেলে-রোমারিওর মত কিংবদন্তি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা দাবি তোলেন তাকে ২০১০ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে নেয়ার জন্য।

তখনকার কোচ দুঙ্গার প্রতি পেলে-রোমারিও একের পর অনুরোধ জানাতে থাকেন। এমনকি ব্রাজিলের সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে থেকে ১৪ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি পিটিশন দেয়া হয় দুঙ্গার কাছে, নেইমারকে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে নেয়ার জন্য। চারদিকে তুমুল চাপ সত্ত্বেও দুঙ্গা নেইমারকে ২৩ জনের দলে তো রাখলেনই না, এমনকি স্ট্যান্ডবাইতেও রাখলেন না। তার যুক্তি, ‘নেইমার দারুণ প্রতিভাবান; কিন্তু বিশ্বকাপে ব্রাজিলের দলে জায়গা পাওয়ার মত এখনও এতটা পরীক্ষিত হয়ে ওঠেনি সে।’

২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয় ব্রাজিল। বিদায় ঘটে কোচ দুঙ্গারও। নতুন কোচ হয়ে আসেন মানো মেনেজস। তিনিই প্রথম বিশ্বকাপের পরপরই নেইমারকে যুক্ত করে নেন ব্রাজিল স্কোয়াডে। নিজের অভিষেক ম্যাচ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ব্রাজিলের হয়ে ১১ নম্বর জার্সি পরে অভিষেকেই করলেন গোল। ম্যাচের ২৮ মিনিটে এই গোল দিয়ে নেইমার পুরো ফুটবল বিশ্বকে জানিয়ে দেন তার আগমণী বার্তা।

নেইমারের পথ চলা শুরু সে থেকেই। ধীরে ধীরে নিজেকে তিনি পরিণত করেছেন ব্রাজিলের পোস্টার বয়ে। এমন একটা সময়ে নেইমারের আগমণ, যখন ব্রাজিলের চরম দুর্দিন। ভালোমানের ফুটবলারের অভাব একটা ক্রান্তিকালেরই জন্ম দিয়েছিল ব্রাজিল ফুটবলে। নেইমারই যেন একা একটা প্রদীপ হয়ে জ্বলছিলেন পুরো সময়টাজুড়ে।

নেইমারের ওপর নির্ভর করেই ২০১২ অলিম্পিকে প্রথমবারেরমত স্বর্ণ জয়ের স্বপ্ন দেখে ব্রাজিল। কিন্তু দলকে ফাইনালে তুলেও তিনি ব্যর্থ হন। মেক্সিকোর কাছে নেইমাররা হেরেছিল ২-১ গোলের ব্যবধানে। তবে চীনের বিপক্ষে ৮-০ গোলে জয়ের ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিক করার গৌরব দেখান তিনি।

মানো মেনেজেসকে বাদ দিয়ে ২০১৩ ফিফা কনফেডারেশন্স কাপের আগে নিয়ে আসা হয় ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুই ফেলিপে স্কলারিকে। তিনি নেইমারকে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলেন কনফেডারেশন্স কাপের স্কোয়াড। টুর্নামেন্টজুড়ে অসাধারণ পারফম্যান্স দেখালেন নেইমার। ফাইনালে স্পেনকে হারিয়ে ৩-০ গোলে হারানোর ম্যাচে নেইমারই ছিলেন নায়ক। ফ্রেডকে দিয়ে প্রথম গোল করার। দ্বিতীয় গোল করেন তিনি নিজে।

লুই ফেলিপে স্কলারির অধীনে ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করেন নেইমার। কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল; কিন্তু কোয়ার্টারে কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার হুয়ান ক্যামিলো জুনিগার আচমকা এক ট্যাকলের কারণে পাঁজরের হাঁড় ভেঙে চলে যেতে হয় সোজা হাসপাতালে। যে কারণে, সেমিফাইনালে ব্রাজিল ৭-১ গোলে পরাজয় বরণ করে জার্মানির কাছে।

২০১৪ বিশ্বকাপের পর ২০১৫ কোপা আমেরিকায় ভালো কিছু করতে পারেননি। তবে ২০১৬ রিও অলিম্পিকে নেইমারের নেতৃত্বে প্রথমবারেরমত অলিম্পিক স্বর্ণ পদক জয় করে ব্রাজিল। ২০১৮ বিশ্বকাপে নেইমাররা নিজের দেশকে সবার আগেই বিশ্বকাপে তুলে এনেছিলেন। এখনও পর্যন্ত নিজের দেশের হয়ে ৮৩ ম্যাচ খেলে ৫৩ গোল করেছেন নেইমার। এখন অপেক্ষায় রাশিয়া থেকে বিশ্বকাপ জয় করে নেয়ার।

যদিও রাশিয়া বিশ্বকাপে নেইমার কেমন করবেন, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ঘোর সংশয়। কারণ, ইনজুরি। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এসে ফরাসি লিগে পিএসজির হয়ে মার্শেইয়ের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে ডান পায়ের পাতায় আঘাত পান তিনি। এরপর তার পায়ের ফিফথ মেটাটারসালে অস্ত্রোপচার করতে হয়। যদিও এখন সুস্থ হওয়ার পথে এবং দলের সঙ্গে অনুশীলনেও যোগ দিয়েছেন তিনি। ব্রাজিলের হেক্সা মিশনকে কতটা সফল করতে পারেন নেইমার, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আইএইচএস/এমএস