মতামত

রাজকীয় বিয়ের গালগপ্প

প্রিন্স হ্যারি আর হলিউড তারকা মেগেন মেরকেলের ঐতিহাসিক বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে শনিবার। ব্রিটেনের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত বিয়ে এটি। ৩২ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে বিশ্বের ৬ শত অতিথি সরাসরি বিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন আর লক্ষাধিক দর্শনার্থীর উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে রাজকীয় এই বিয়ে।

Advertisement

টেলিভিশনের পর্দায় বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি দর্শক উপভোগ করেছেন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। রাজকীয় এই বিয়েতে দাওয়াত না পাওয়ার কারণে যদিও অনেকের মধ্যে হতাশা ছিলো । তবে তাদের জন্য সান্ত্বনার কথা হলো এই, খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে রাজকীয় এই বিয়ের দাওয়াত পাননি। প্রিন্স হ্যারির সাথে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘনিষ্ঠতা থাকলেও দাওয়াত পানি বারাক ওবামা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

তবে রাজ পরিবারের বিয়ে মানে ব্রিটেনবাসীর জন্য উৎসবের দিন। উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেল চার্চ থেকে বিবিসি সকাল ৯ টা থেকে বিরামহীন লাইভ সংবাদ ও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রচার করছিলো। রাজবধূর পোশাক থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে আগত সেলিব্রেটি অতিথিদের বাহারী পোশাক ও হ্যাটসহ কত শত আলোচনার বিষয় ছিলো ব্রডকাস্টারদের জন্য।

মেগেনের জন্য প্রতি মূহুর্তে প্রিন্স হ্যারির অপেক্ষা, মেগেনের মায়ের অশ্রু সজল চোখ, আর মেইকাপ বিহীন মেগেনের হাসি, সব কিছুই যেন টিভির পর্দায় দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রেখেছিলো। তবে এতো আয়োজনের মধ্যেও রাজবধূ মেগেনের ওড়নায় খুঁজে পাওয়া গেলো বাংলাদেশকে। রাজবধূ মেগেন পাঁচ মিটার লম্বা যে সাদা ওড়নাটি পড়েছেন সেই ওড়নার মধ্যে ছিলো ৫৩ টি ফুলের নকশা। মূলত কমনওয়েলথভুক্ত ৫৩টি দেশের জাতীয় ফুলকে নকশায় ফুটিয়ে তুলেছেন ডিজাইনার। মেরকেলের সাদা ধবধবে ওই ওড়নার মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলাও ছিলো।

Advertisement

শুধু রাজ পরিবারের সদস্য বলেই প্রিন্স হ্যারি আর মেরকেলের এই বিয়েকে ঐতিহাসিক আর রাজকীয় বলতে চাই না, এই বিয়ের মাধ্যমে প্রিন্স হ্যারি ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের অনেক প্রথাই ভেঙে দিয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের একজন সাধারণ পরিবারের সদস্য বলতেও আমরা এখনো বিয়ের জন্য যোগ্য প্রাত্রী হিসেবে অবিবাহিত পাত্রীকেই প্রাধান্য দিতে চাই, কিন্ত রাজপুত্র হয়েও প্রিন্স হ্যারি কেমন করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করলেন তাও আবার তার চেয়ে বয়সে বড়, সে এক বড় বিস্ময় বটে!

হ্যারির ভালোবাসার কাছে রাজকীয় সব প্রথা যেন হার মেনেছে। কৃষ্ণাঙ্গ কোন নারী ব্রিটিশ রাজবধূ হবেন এই কথা কি স্বয়ং নেলসন মেন্ডেলাও কোনদিন ভেবেছিলেন? শুধু তাই নয়, প্রিন্স হ্যারি ও মেগেন মেরকেলের বিয়ের দৃশ্য যারা টেলিভিশনের পর্দায় সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। এই প্রথমবারের মতো একজন কৃষ্ণাঙ্গ যাজক যৌথ ভাবে রাজকীয় বিয়ের মন্ত্রপাঠের আনুষ্ঠানিকতায় যুক্ত হয়েছিলেন, এটিই ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথম। চেলিস্ট বাজিয়েছেন বিবিসি'র ইয়াং মিউজিসিয়ান অব দ্য ইয়ার খ্যাত ১৯ বছর বয়সী সেকু কানে মেসন নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর। এঘটনাগুলো ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের ইতিহাস নতুন করে লিখতে সহায়তা করবে।

তবে প্রচণ্ড নারীবাদি ও স্বাধীনচেতা মেরকেল রাজ পরিবারে কতটা স্বাধীনভাবে চলতে পারবেন সেটা নিয়েও ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। হলিউড অভিনেত্রী হিসেবে মেগেন যতটা খোলামেলা পোশাক পরে অভ্যস্ত রাজবধূ হিসেবে তিনি কতটা দ্রুত রাজকীয় ধাঁচের সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন সেটিও দেখার বিষয়, কেননা রাজবধূ হিসেবে মেগেনকে এখন থেকে প্রাসাদের ডিজাইনারের পছন্দমতো রাজকীয় ড্রেস কোড মেনে চলতে হবে।

পাঠকদের একটা বিষয় মনে করিয়ে দেই। আপনাদের নিশ্চয়ই প্রিন্সেস ডায়ানার পরিণতির কথা মনে আছ। প্রিন্স চার্লস রাজ পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে যেসকল অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে যেতেন সেই অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমের আকর্ষণ থাকতো ডায়ানার দিকে। প্রতিদিনই কোন না কোন খবরের শিরোনাম হতেন ডায়ানা। প্রিন্স চার্লস এসব মেনে নিতে পারতোনা।

Advertisement

তাছাড়া ক্যামেলিয়ার গোপন প্রেমের কথাও অজানা ছিলো না। সব কিছু মিলিয়ে রাজ পরিবারের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে ডায়ানার। যদিও আমি এতো তাড়াতাড়ি নব রাজবধূ মেরকেলের বিষয়ে উপসংহার টানতে চাইনা। তবুও মেরকেলের চরিত্র আর রাজ পরিবারের অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে পাঠকের মনে এমন শংকার সৃষ্টি হওয়া অবান্তর নয়।

রাজবধূ হিসেবে শপথ নেওয়ার সাথে সাথে একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে মেগেন মেরকেলের অভিনেত্রী জীবনের যবনিকাপাত হলো। এই ধাক্কা মেগেন কি সামলাতে পারবেন? ১৯৮১ সালে ডায়ানাকে যখন প্রিন্স অব ওয়েলস বিয়ে করেন, সেই সময়ে ডায়ানা যে কুমারী ছিলেন সেটি ডায়ানার পরিবারকে প্রমাণ করতে হয়েছিলো। যেই পরিবারটিতে বধূ হিসেবে স্বীকৃতি পাবার জন্য প্রিন্স হ্যারির মাকে প্রমাণ করতে হয়েছিলো তিনি কুমারী, সেই পরিবারে হ্যারি এমন একজনকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন যিনি ছিলেন একজন বিবাহিত নারী!

রাজ পরিবারের আরো একটি প্রথা, রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে বংশ বিস্তারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। কেইট মিডিলটন ইতিমধ্যেই তিন সন্তানের জননী হয়েছেন। এখন মেরকেল এই ধারাবাহিকতায় কতটা অভ্যস্ত হবেন সেটাও বিবেচনার বিষয়। যদিও সন্তান জন্ম হওয়ার পেছনে মানুষ কখনই নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ডায়ানাকে পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করার আরো একটি কারণ ছিলো ডায়ানার চেহারা দেখতে নিষ্পাপ ছিলো আর ডায়ানার কোন সাবেক প্রেমিক ছিলো না। ডায়ানার সাবেক প্রেমিক না থাকায় টেবলয়েড পত্রিকাগুলোর জন্য রাজ পরিবারকে নিয়ে রসালো গল্প ফাঁদার সুযোগ কম থাকবে, একারণেই রানী এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু নববধূ মেরকেলকে নিয়ে গল্প লেখার জন্য ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড গুলো তার সাবেক স্বামী ফ্লিম প্রডিউসার ট্রভর এ্যঙ্গেলসনকে তুরুপের তাসের মতো ব্যবহার করবে।

২০০৪ সালে এ্যাঙ্গেলসন ও মেগেন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, সম্পর্কের চূড়ান্ত পরিণতি বিয়েতে গড়ায় ২০১০ সালে। ২০১৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। একজন স্ক্রিন রাইটার, লেখক বা চলচ্চিত্র পরিচালক তার প্রায় ১০ বছরের সংসার জীবনের আলেখ্য লিখবেন না বা চলচ্চিত্রে রুপ দেবেন না একথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।

ইতোমধ্যে বিয়ের আগে ট্রাভরের একটি টিভি সিরিজ বন্ধের জন্য মেগেন তার সাবেক স্বামীর সাথে সমঝোতা করেন, যে টিভি সিরিজের চরিত্রে মেগেনের গল্প উঠে আসার কথা ছিলো। তাই ট্রাভর এ্যঙ্গেলসন ভবিষ্যতে মেগেনকে কতটুকু ছাড় দেবেন সেটির জন্যও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সেই সাথে ব্রিটিশ ট্যাবলয়ডগুলো মেগেনের স্পর্শকাতর ছবির জন্য নিশ্চয়ই ট্রেভরের জন্য লোভনীয় অফার নিয়ে অপেক্ষা করছে। হয়তো হ্যারি আর মেগেনের হানিমুন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ট্যাবলয়ড গুলো।

নববধূ মেগেনকে তার ইন্সটগ্রাম একাউন্ট ত্যাগ করতে হচ্চে, সেই সাথে ত্যাগ করতে হবে তার প্রিয় দুটি বুল ডগকেও। মেগেন ব্যক্তি জীবনে নানা রাজনৈতি ইস্যুতেও মত প্রকাশ করতেন। কিন্তু রাজবধূ হিসেবে তিনি এখন আর কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে নিজস্ব মতামত দিতে পারবেন না।

রাজ পরিবারের সদস্য হলে বায়োলজিক্যাল সম্পর্ক ছাড়া অন্য পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে রাজ পরিবার তেমন গুরুত্ব দেয় না। রাজপরিবারের সদস্য হওয়ার পর তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা খুব দূরূহ হয়ে ওঠে। কিন্তু মেগেন মেরকেলের সৎ ভাই থমাস জুনিয়রের সাথে মেরকেলের রয়েছে খুব সুন্দর সম্পর্ক। সামনের দিনগুলোতে ভাইয়ের সাথে দূরত্ব মেগেনের জন্য কষ্টের কারণ হতে পারে।

প্রিন্স উইলিয়াম ও হ্যারি দু্ই ভাই তাদের মা প্রিন্সেস ডায়ানাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। তাদের পিতা প্রিন্স চার্লস প্রিন্সেস ডায়ানার প্রতি যে আচরণ করেছে তার জবাব দিতেই কি প্রিন্স হ্যারি মেগেন মেরকেল কে বিয়ে করেছেন? নাকি হলিউড তারকা মেগেন খ্যাতির জন্য রাজপরিবারে যুক্ত হলেন এমন কথাও আলোচনায় আনছেন বিশ্লেষকরা। সব কিছু নিয়ে এখনই হয়তো উপসংহার টানা সম্ভব হবে না, তবে ৯২ বছর বয়স্ক রানী এলিজাবেথ যে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে নিজের মানসিকতার পরিবর্তন করেছেন প্রিন্স হ্যারি ও মেগেল মেরকেলের বিয়ের মাধ্যমে তারই প্রমাণ পাওয়া গেলো।

চার্চের প্রধান হিসেবে রাজ পরিবারের সকল বিয়ের অনুমোদন দেন রানী। ১৯৫৩ সালে রানীর বোন প্রিন্সেস মার্গারেট যখন তালাকপ্রাপ্ত পিটার টাউন সেন্ডকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন এলিজাবেথ তখন সেই বিয়েতে বাধা দিয়েছিলেন। তাই অনেকেই ধারণা করেছিলেন মেগেন বিবাহিত হওয়াতে হয়তো রানী এই বিয়েতে রাজি নাও হতে পারেন। কিন্তু সময়ের সাথে রাজ পরিবারের প্রচলিত ধারণাও বদলেছে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে রাজবধূ হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালটি ব্রিটেনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। সেই সাথে রাজতন্ত্র যে প্রথা ভেঙে আধুনিক হচ্ছে তারও একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেলো এই বিয়ের মাধ্যমে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। একাত্তর টিভির যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।

এইচআর/পিআর