> ১১১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যবহার হয়েছে > অব্যবহৃত রয়েছে ১৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা > জমি ও ভবন নির্মাণে ৭৫.৬০% অর্থ ব্যবহৃত হয়নি> কোম্পানির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কমেছে > কমছে স্থায়ী সম্পদের পরিমাণও
Advertisement
জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবসা সম্প্রসারণের কাথা বলে রাইট শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করলেও সেই অর্থের সিংহভাগ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অপরদিকে কমে গেছে কোম্পানিটির বিনিয়োগের পরিমাণ। স্থায়ী সম্পদে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেই সঙ্গে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার পরিমাণও কমে এসেছে। বেড়ে গেছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ।
ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে জিপিএইচ ইস্পাত ২০১৬ সালে পুঁজিবাজার থেকে ২৬১ কোটি ৯৫ লাখ ৪০ টাকা উত্তোলন করে। প্রতিটি রাইট শেয়ারের জন্য চার টাকা প্রিমিয়ামসহ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেয়া হয় ১৪ টাকা।
চলতি বছরের ৩১ মে’র মধ্যে রাইটের মাধ্যমে উত্তোলন করা সম্পূর্ণ টাকা খরচ করা হবে বলে রাইট শেয়ারের ডকুমেন্টে উল্লেখ করা হয়। তবে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটি ১১১ কোটি ১৮ লাখ ৭১ হাজার ৮১৫ টাকা ব্যবহার করতে পেরেছে। বিপরীতে ১৫০ কোটি ৭৬ লাখ ৬৮ হাজার ১৮৫ টাকা অব্যবহৃত রয়েছে।
Advertisement
রাইট শেয়ার ছেড়ে উত্তোলন করা টাকা দিয়ে কোম্পানিটি জমি ও ভবনের কাজ, মেশিনারিজ স্থাপন ও মেরামত এবং রাইট ইস্যুতে খরচ করবে বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানায়। এর মধ্যে জমি ও ভবন নির্মাণকাজে ২৩০ কোটি, মেশিনারিজ স্থাপন ও মেরামতে ৩০ কোটি এবং এক কোটি ৯৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা রাইট ইস্যুতে খরচ করার কথা।
তবে কোম্পানিটি রাইটের অর্থ ব্যবহারের বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বশেষ যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জমি ও ভবনের কাজে মাত্র ৫৬ কোটি ১১ লাখ ছয় হাজার ৭২০ টাকা ব্যবহার করেছে। অব্যবহৃত রয়েছে ১৭৩ কোটি ৮৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৮০ টাকা। অর্থাৎ জমি ও ভবন নির্মাণকাজের ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থই কোম্পানিটি ব্যবহার করতে পারেনি।
একইভাবে মেশিনারিজ স্থাপন ও মেরামত খাতেও কোম্পানিটি রাইট শেয়ার ছেড়ে উত্তোলন করা টাকার সিংহভাগ ব্যবহার করতে পারেনি। এ খাতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে তিন কোটি ৭০ লাখ ৯১ হাজার টাকা। অব্যবহৃত রয়েছে ২৬ কোটি ২৯ লাখ নয় হাজার টাকা। অর্থাৎ এ খাতের ৮৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ অর্থই কোম্পানিটি ব্যবহার করতে পারেনি। তবে রাইট ইস্যুতে যে অর্থ খরচ করার কথা ছিল তার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই খরচ করা হয়েছে। এ খাতে খরচ হয়েছে এক কোটি ৯৫ লাখ চার হাজার ৯৪৯ টাকা।
কোম্পানিটির চলতি বছরের মার্চশেষে প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের স্থায়ী সম্পত্তির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রপার্টি, প্ল্যান্ট ও ইকুইপমেন্ট কমে গেছে। ২০১৭ সালের ৩০ জুন শেষে কোম্পানিটির প্রপার্টি, প্ল্যান্ট ও ইকুইপমেন্ট ছিল ১৬৪ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকার। যা চলতি বছরের ৩১ মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১৬২ কোটি ১৬ লাখ ১১ হাজার টাকা।
Advertisement
একই সঙ্গে কমেছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় বিনিয়োগ। ২০১৭ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ছিল ৩৬ কোটি ৪১ লাখ ৮১ হাজার টাকা, যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি চার লাখ ৮৭ হাজার টাকায়। আর ২০১৭ সালের ৩০ জুন শেষে থাকা ২৪৪ কোটি ৩৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকার স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ চলতি বছরের মার্চশেষে কমে দাঁড়িয়েছে ১৮৬ কোটি এক লাখ ২৪ হাজার টাকায়।
স্থায়ী সম্পদ ও বিনিয়োগ কমলেও কোম্পানিটির দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পাল্লা ভারী হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে জিপিএইচ ইস্পাতের দীর্ঘমেয়াদী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২১ কোটি ১৭ লাখ ১৮ হাজার টাকা। যা ২০১৭ সালের জুন শেষে ছিল ১৭২ কোটি নয় লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ নয় মাসের ব্যবধানে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে তিন গুণের বেশি।
এদিকে রাইট শেয়ার ছাড়ার আগে জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানান, প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তারা কোম্পানির বড় ধরনের সম্প্রসারণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এতে কোম্পানির রড ও বিলেট উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বাড়বে।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমন ঘোষণা দিলেও গত দুই বছরে শেয়ারহোল্ডারদের দেয়া লভ্যাংশের পরিমাণ কমে গেছে। রাইটের আবেদন করার আগে ২০১৫ সালে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ১৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে রাইটের অর্থ অব্যবহৃত রেখেই ২০১৭ সালে ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসাবে দেয়া হয়। তার আগের বছর ২০১৬ সালে দেয়া হয় ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার। অবশ্য ২০১৫ সালের আগে কোম্পানিটি শুধু বোনাস শেয়ারই লভ্যাংশ হিসাবে দিয়েছে। ফলে কী কারণে ২০১৫ সালে হঠাৎ ১৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়া হয় তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এদিকে জিপিএইচ ইস্পাতের রাইট শেয়ার আবেদনের সময় তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির কোনো প্রান্তিকের সময় শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে ওই সময়ের ব্যবসায়িক অবস্থা প্রকাশ করতে হয়। তবে সেটা অডিট বাধ্যতামূলক না হওয়ায় সাধারণত আন-অডিট প্রকাশ করে কোম্পানিগুলো।
সেই ধারাবাহিকতায় জিপিএইচ ইস্পাত ২০১৪-১৫ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে আন-অডিটেড হিসাব প্রকাশ করে। পরে আবার একই সময়ের হিসাব নিয়ে রাইট শেয়ারের আবেদন করে। এ সময় কোম্পানিটিকে অডিট শেষে হিসাব জমা দিতে হয়। আর তখনই বেরিয়ে আসে কোম্পানির ভিন্ন চিত্র। এই দুই হিসাবের ফাইন্যান্সিয়াল পজিশন, ইনকাম স্টেটমেন্ট ও ক্যাশফ্লোর আইটেমগুলোর মধ্যে সিংহভাগ ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা দেয়।
অ্যাডভান্স, ডিপোজিট, প্রি-পেমেন্টস, লং টার্ম লোন, কারেন্ট পোরশন অব লং টার্ম লোন, ক্রেডিটরস অ্যান্ড অ্যাকরুয়ালস, প্রভিশনস ফর ইনকাম ট্যাক্স, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এক্সপেন্স, ট্যাক্স এক্সপেন্স, ডেফার্ড ট্যাক্স, ইপিএস, ইন্টারেস্ট পেইড, লিজ অবলিগেশন, নিট ইনক্রিজ ক্যাশ, শর্ট টার্ম লোন গ্রহণ- সবকটি আইটেমের দুই হিসাবের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হিসাববিদ বলেন, অ্যাকাউন্টস তৈরি করা কোম্পানির কাজ। আর অডিটরের কাজ তার সত্যতা যাচাই করা। যদি ভুল কিছু থাকে তা নিয়ে অডিটর অপিনিয়ন দেয়। যাতে অডিট ও আন-অডিট হিসাবে পার্থক্য না হয়। তবে দু-এক ক্ষেত্রে পার্থক্য হতে পারে। যদি এর চেয়ে বেশি হয় সেটা অস্বাভাবিক। নগদ প্রবাহ, ডিপোজিট এবং ঋণে বড় ধরনের পার্থক্য হওয়া অস্বাভাবিক। অডিট করার পর এত পরিবর্তন হলে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস তৈরির দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অডিট ও আন-অডিট হিসাবের পার্থক্য নিয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে কোম্পানিকে প্রশ্ন করা উচিত।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাইট শেয়ারের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের পর সঠিক সময়ে তা ব্যবহার করতে না পারা কিছুতেই যুক্তিসংগত নয়। এ বিষয়ে বিএসইসির মনিটরিং করা উচিত। আবার রাইটের অর্থ তোলার পর বিনিয়োগ, প্রপার্টি কমে যাওয়া এবং ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।’
‘আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যে ভিন্নতা থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এজন্য বিএসইসি ও ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল- উভয়কে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জিপিএইচ ইস্পাত কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের জন্য জাগো নিউজের পক্ষ থেকে কোম্পানিটির শেয়ার বিভাগের ইনচার্জ মোশারফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘রাইটের টাকা ব্যবহারের জন্য আমরা ইজিএম করে আরও এক বছর সময় বাড়িয়েছি। সে হিসাবে চলতি বছরের ৩১ মে নয়, ২০১৯ সালের মে মাসে রাইটের টাকা ব্যবহারের সময় শেষ হবে। তারপরও রাইটের যে টাকা অব্যবহৃত রয়েছে, তা চলতি কোয়াটার শেষে অনেকটাই মেকাপ হয়ে যাবে।’
রাইটের টাকা অব্যবহৃত রেখে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য রাইটের টাকা উত্তোলন করিনি। রাইটের টাকা তোলা হয়েছে নতুন প্রজেক্টের জন্য। আর ঋণ নেয়া হয়েছে বিদ্যমান প্রকল্পের জন্য।’
বিনিয়োগ এবং প্রপার্টি, প্লান্ট ও ইকুইপমেন্ট কমে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। এমএএস/এমএআর/আরআইপি