খেলাধুলা

‘রেফারি শেষ বাঁশি বাজিয়ো না’

যেতে নাহি দিব। হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়। মাঠের দু’পাশে দাঁড়িয়ে রিয়াল সোসিয়া দাদের ফুটবলাররা। মাঠে নামছেন গুটি কয়েক চুলের টেকো মাথার এক শান্তির প্রতীক, এক সম্মানের প্রতীক, এক শ্রদ্ধাস্পদ মানুষ। মাথা নিচু করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্যাম্প ন্যুতে। খুব কষ্ট করে হাঁটছেন মনে হচ্ছে। অবশ্য মনে না হওয়ারও যে কারণ নেই। একে একে হাত মেলালেন রিয়াল সোসিয়াদাদের সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে। আগেই মাঠে এসে দাঁড়িয়ে ছিল বার্সা খেলোয়াড়রা। ৯৮ হাজার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামের ব্যানারে তখন লেখা 'অসীম ইনিয়েস্তা'।

Advertisement

ইনিয়েস্তার সংজ্ঞা কেবল ইনিয়েস্তাই। আর দশটা দিনের থেকে আজকের দিনটা বার্সেলোনার সমর্থকদের জন্য একটু বেশি বেদনাদায়ক, একটু বেশি কষ্টের। ২২ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করার মুহূর্তটা যে কারোর জন্যে কষ্টের। জীবনের সবটুকু ভালোবাসা, আনন্দ, কষ্ট, বেদনা সবকিছুতেই বার্সাকে পাশে পেয়েছিলেন তিনি। জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টাতেও সাহায্যের হাত বাড়াতে ভুল করেনি ক্লাবটি। সেই ক্লাবকে নিজের জীবনের সবটুকু দিয়েছেন। সাধ্যের সবটুকু নিঙরে দিয়ে বিদায় বেলাতেও দুটি ট্রফি জিততে ক্লাবকে সাহায্য করেছেন।

ইনিয়েস্তা মানুষটা শান্ত হলেও তিনি ছিলেন বিপক্ষ দলের জন্য বিপদজনক এক ব্যক্তি। ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এক মানুষ কীভাবে ফুটবলটাকে নিয়ে ছেলে খেলা করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারতেন তা বিপক্ষ দলের তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল।

স্পেনের আলবাসেতে শহরের ছোট্ট একটি গ্রাম ফুয়েন্তেয়ালবিলা। এই গ্রামেই ১৯৮৪ সালের ১১ই মে জন্মগ্রহণ করেন ‘ডন আন্দ্রেস’ খ্যাত ইনিয়েস্তা। অন্যান্য অনেক বিশ্বখ্যাত ফুটবলারদের শৈশব অনেক দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে কাটায় ইনিয়েস্তার অবশ্য তেমনটা ছিল না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় তিনি আলবাসেতের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আলবাসেতে শহরটি মূলত দুইটি কারণে বেশ পরিচিত।

Advertisement

প্রথমটা হলো, এখানের বেশিরভাগই স্প্যানিশ নাগরিক এবং স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। দ্বিতীয়টা হল, এখানকার মদ হল স্পেনের সবথেকে সেরা। ছোট অবস্থায় একজন বালকের যা যা দরকার সব কিছুই পেয়েছিলেন ইনিয়েস্তা। এজন্য তিনি তার পরিবারকে আজীবন শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানান।

এই যে এতসব আনন্দ, সুখের ভেতর থেকেও ইনিয়েস্তার মন পড়ে ছিল ফুটবলের দিকে। ১২ বছর বয়সে আলবাসেতে বালোম্পাই ক্লাবের হয়ে সেভেন-এ-সাইড টুর্নামেন্ট খেলার সময় স্পেনের বিভিন্ন ক্লাবের নজরে চলে আসেন। তবে ডনের পরিবারের সাথে পরিচয় ছিল বার্সেলোনার যুব দলের কোচ এনরিকে ওরিজাওলা। শেষ পর্যন্ত এনরিকের অনুরোধে ইনিয়েস্তাকে বার্সেলোনার ইয়ুথ একাডেমি যেটা সারা বিশ্বে ‘লা মাসিয়া’ নামে পরিচিত সেখানে পাঠান।

পরিবারের সঙ্গে লা মাসিয়ায় এসে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন ১২ বছর বয়সের ইনিয়েস্তা। সেখানেই ইনিয়েস্তাকে রেখে আসেন তার বাবা-মা। সেই সময়টা তার জন্য ছিল অনেক কষ্টের। যেদিন প্রথম তার বাবা-মা তাকে ছেড়ে রেখে আসেন সেই রাতে অনেক কেঁদেছিলেন। নিজের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও ইনিয়েস্তা বলেন সেই রাতটি ছিল লা মাসিয়ায় তার সবচেয়ে কষ্টের রাত।

শহরের দুরন্তপনা ইনিয়েস্তা এখন বন্দী চার কোণা এক ফুটবল মাঠের গণ্ডিতে। ছোট্ট অবস্থায় পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াটা ঠিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি তিনি। তবে এমন না যে নিজের অমতেই এখানে এসেছেন। বাবা-মা তাকে দেখতো দায়িত্ববান এক বালক হিসেবে কিন্তু ইনিয়েস্তা জানতেন তিনি কী হতে চান। এজন্যেই তাদের সেই মায়া ত্যাগ করে লা মাসিয়াতে প্রবেশ করেন।

Advertisement

তবে লা মাসিয়াতে তিনি যে খুব খারাপ ছিলেন সেটাও না। লা মাসিয়ার হয়ে প্রথম অভিষেকের দিনটি এখনো তার সেই সময়ের সেরা দিনগুলোর একটি। ইনিয়েস্তা যখন কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পদার্পন করছেন ঠিক তখনই তার পদধূলি পড়ে বার্সেলোনা ক্লাবের মূল দলে। বিশ্বের অন্যতম সেরা কোচ পেপ গার্দিওলা সেদিনই আরেক বিশ্বখ্যাত মিডফিল্ডার জাভিকে বলেছিলেন, ‘সবাই বলে তুমি আমাকে অবসরে পাঠাবে কিন্তু এই ছেলেটি আমাদের সবাইকে অবসরে পাঠাবে।’ হায় নিয়তি! এই ছেলেটি আজ ঠিকই অবসরে গেলো কিন্তু চোখের জলে সবাইকে কাঁদিয়ে।

ইনিয়েস্তা বার্সেলোনা অধ্যায়ের শুরুতেই ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে কোচ হিসেবে পান। ইয়োহান ক্রুয়েফের আদর্শে ফুটবল খেলা রাইকার্ডকে কোচ করে আনে বার্সেলোনা। সেই মৌসুমেই আবার হুয়ান লাপোর্তে বার্সেলোনার নতুন ক্লাব প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। যেখানে বার্সেলোনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ দিনের পর দিন জয় এবং ট্রফি জিতে যাচ্ছিল সেখানে বার্সেলোনা ছিল নিষ্প্রভ।

এক পর্যায়ে রাইকার্ড তার প্রথম মৌসুমে অবনমন অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু এর পরের মৌসুম থেকেই যেন সাফল্যের সুবাস পেতে শুরু করেন। আর সেই সাফল্যে হাওয়া লাগিয়েছিল দুই তরুণ তুর্কি আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা এবং ভিক্টর ভালদেস। তাছাড়া অভিজ্ঞ রোনালদিনহো, ইতো, ডেকো, রাফায়েল মার্কুয়েজরাতো ছিলেনই। তবে ইনিয়েস্তা রাইকার্ড অধ্যায়ে নিজেকে প্রথম আলোচনার ঊর্ধ্বে নিয়ে যান আর্সেনালের সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। প্রথমার্ধে বার্সেলোনা ১-০ গোলে পিছিয়ে ছিল। অথচ ঐ ম্যাচে প্রথম একাদশেই ছিলেন না আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা।

বিরতির পর ইনিয়েস্তাকে নামানোর ফলেই যেন বার্সেলোনা হয়ে ওঠে বিধ্বংসী। তার অসাধারণ পারফরম্যান্স মুগ্ধ করে সেদিন ফাইনাল খেলতে আসা দর্শকদের। টুর্নামেন্ট জয়ের পর বার্সার স্পোর্টিং ডিরেক্টর টিজাটি রাইকার্ডকে বলেন, ‘ফ্রাঙ্ক তোমার আন্দ্রেসের সাথে কথা বলা উচিত’। কিন্তু রাইকার্ড সামান্য ধন্যবাদটুকুও দেননি ইনিয়েস্তাকে। সেই ফাইনালে আর্সেনালের অধিনায়ক ছিলেন থিয়েরি অরি। অরি তার বইয়ে লেখেন, ‘আমরা সবাই জানি লারসন এবং বেলেত্তির কথা কিন্তু যেই মানুষটার কাছে আমরা সবাই হেরেছি সে হচ্ছে ইনিয়েস্তা। যখন সে নামলো, সবকিছুই যেন পালটে যেতে লাগলো।’

রাইকার্ড অধ্যায়ের পর ইনিয়েস্তার কোচ হিসেবে আসেন তার অতি পরিচিত একজন মানুষ পেপ গার্দিওলা। পেপ গার্দিওলার হাতের ছোঁয়াতে যেন ইনিয়েস্তার ক্যারিয়ারে প্রাণ ফিরে পায়। বলা চলে ইনিয়েস্তার ফুটবল অধ্যায়ের সেরা মৌসুমগুলো ছিল পেপ গার্দিওলার সময়েই। মাঝমাঠের দুই কাণ্ডারি জাভি ও ইনিয়েস্তাকে দিয়ে বিপক্ষ দলের ফুটবলারদের নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলায় মেতে উঠেছিলেন গার্দিওলা।

ফিরিয়ে আনেন লা মাসিয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘রিসিভ, পাস, অফার, রিসিভ, পাস, অফার’ ঐতিহ্য। যেখানে রাইকার্ডের ফরমেশন ছিল অনেকটাই ৪-৩-৩ সেখানে গার্দিওলা ফরমেশনের দিকে নজর না দিয়ে নজর দেন পজিশন নির্ভর ফুটবল খেলার দিকে। গার্দিওলার সময়ে যখন হাই ডিফেন্সিভ লাইনের পাশাপাশি ফুলব্যাকদের কাজই ছিলে হাই প্রেস করা। অন্যদিকে মাঝমাঠের বল পজিশনে থাকতেন ইনিয়েস্তা ও জাভি। পরে অবশ্য ২০১১-১২ মৌসুমে গার্দিওলা ৩-৪-৩ ফরমেশনে খেলাতে থাকেন বার্সেলোনাকে।

গার্দিওলা যখন কোচ হয়ে আসেন বার্সার দলটা তখন ছিল একদম খাঁদের কিনারায়। সেই দলকে নিয়ে পুরোপুরি নতুন উদ্যমে তরুণদের নিয়ে দল গোছাতে থাকেন পেপ। তার সেই দলের প্রধান দুই সদস্যই ছিলেন জাভি-ইনিয়েস্তা। যেখানে এই দুইজনের উপর নির্ভর করে আক্রমণে মেসি কিংবা ইতো বিপক্ষ দলকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার ছক কষতেন। এখানে অবশ্য গার্দিওলার একঘুয়েমিতাও কাজ করেছে। কোচ হিসেবে জয়েন করেই জানিয়ে দেন রোনালদিনহো, ইতো এবং ডেকো তার প্লানে নেই। ফলে ক্লাব ছাড়তে বাধ্য হন এই তিন অভিজ্ঞ ফুটবলার যদিও আরো এক মৌসুম ছিল বার্সেলোনায়।

২২ বছর লা মাসিয়া এবং বার্সেলোনা অধ্যায়ে জিতেছে অজস্র ট্রফি। ৯টি লা লিগা, ৬টি কোপা দেল রে, ৭টি স্প্যানিশ সুপার কোপা, ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৩টি উয়েফা সুপার এবং ৩টি ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে প্রত্যেক ফুটবলারের ধ্যান জ্ঞান যেই বিশ্বকাপ নিয়ে সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করে স্পেনকে তাদের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি পাইয়ে দেন ইনিয়েস্তা। বিশ্বকাপ ছাড়াও স্পেনের হয়ে জিতেছেন দুইটা ইউরো কাপের শিরোপাও। ব্যক্তিগত আরো বহু ট্রফি জিতেছেন যা আজও তার জীবনে অনন্য কীর্তিগুলোর ভেতর অন্যতম।

ইনিয়েস্তা তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। কিন্তু তার বল দখলে রাখার ক্ষমতা, বল নিয়ে তৎপরতার কারণেই তিনি পরবর্তীতে এটাকিং মিডফিল্ডে পরিণত হন। তার খেলার স্টাইলে সম্পর্কে স্পেনের বিশ্বকাপজয়ী কোচ দেল বস্ক বলেছেন, ‘সে একজন কমপ্লিট ফুটবলার। সে আক্রমণও করতে পারে আবার ডিফেন্ডও করতে পারে, সে সুযোগ তৈরি করতে পারে এবং গোলও করতে পারে।’ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড তার সম্পর্কে বলেন, ‘আমি তাকে উইঙ্গার, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার, ডিপ মিডফিল্ডার, স্ট্রাইকার ঠিক পেছনে এসব জায়গায় খেলিয়েছি এবং প্রত্যেকটা জায়গাতেই সে ছিল অসাধারণ।’

হুয়ান রোমান রিকোয়েলমে এবং রোনালদিনহোর অবর্তমানে প্রায় বেশিরভাগ সময়ই তাকে খেলতে হয়েছে ওয়াইড ফরোয়ার্ড হিসেবে। ইনিয়েস্তা সম্পর্কে ফিফা বলেছে, ‘তার স্টাইল এবং বলকে দ্রুততার সাথে নিজের দখলে আনা এবং সেটি নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে সুপার গ্লু দিয়ে কেউ তার পায়ে বল লাগিয়ে রেখেছে এবং সেটা নিয়ে সে দৌড়াচ্ছে। ইনিয়েস্তা পরিচিতই তার পাসিং, ড্রিবলিং, ভিশন এবং মুভমেন্টের জন্য।’ মূলত বল নিজের দখলে নিয়ে নিজেদের ভেতর পাসিং পাসিং এবং পাসিং এর মাধ্যমে খেলাকে কিছুটা স্লো করে যোগ্য একজন খেলোয়াড়ের কাছে সেটিকে পাঠানোই হল ইনিয়েস্তার খেলার মূল ভিশন।

ইনিয়েস্তা যখন ৮০ মিনিটে ২২ সেকেন্ডে মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন পুরো স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে সম্মান জানায় এই কিংবদন্তিকে। ৬৭৫ তম ম্যাচে এসে থামলেন মিডফিল্ডের এই যাদুকর। করতালিগুলো চোখের কোণে জমে থাকা পানির প্রতিধ্বনি হয়েই যেন উচ্চস্বরে কম্পিত হচ্ছিল। এ যেন এক মহানায়কের বিদায়। এক সমর্থক ব্যানারে লিখে এনেছেন, ‘রেফারি তুমি বাঁশি বাজিয়ো না, তাহলেই ইনিয়েস্তা আর আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না।’ কিন্তু ইনিয়েস্তা চলে গেলেন সকল বার্সা সমর্থকদের চোখের জলে কাঁদিয়ে। ভালো থাকুন ইনিয়েস্তা।

আরআর/এমআরএম