জেরার্ড পিকে। বার্সেলোনা এবং স্পেন জাতীয় দলের ডিফেন্ডার। এটাই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। তবে এই পরিচয় ছাপিয়ে তার আরও একটা পরিচয় রয়েছে। তিনি সাংবাদিক। দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনের হয়ে প্রায়ই তিনি বিখ্যাত সব ফুটবলারের সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন। চমৎকার সব সাক্ষাৎকার! তার এই সাক্ষাকারের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন জিয়ানলুইজি বুফন।
Advertisement
জুভেন্টাসের হয়ে দীর্ঘ ৬১১১ দিনের ক্যারিয়ার মাত্রই শেষ করলেন। জুভদের পোস্টের নিচে আর দাঁড়াবেন না কিংবদন্তি এই গোলরক্ষক। অথচ, জুভেন্টাসের অনেক দুঃসময়েও পেছন ফিরে তাকাননি তিনি। জুভেন্টাস সিরি-এ থেকে নেমে গিয়েছিল সিরি-বি’তে। তখনও তিনি দল ছাড়েননি। বয়স আর তাকে থাকতে দিচ্ছে না, ছেড়ে যেতে হচ্ছে পুরো ক্যারিয়ার কাটানো এই ক্লাবকে। তার আগেই পিকের মুখোমুখি হলেন বুফন। বললেন অনেক না জানা কথা। সেগুলোই তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য...।
পিকে : তুরিনের অনুশীলন মাঠে আমার সাথে দেখা করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জিজি। আমি তোমার সম্পর্কে অনেকে জেনেছি। তোমার বাবা মা এবং বোনদেরকে নিয়েও জেনেছি। তারাও অ্যাথলেট ছিলেন তোমার মত।
জিজি বুফন : হ্যাঁ, আমি অ্যাথলেট পরিবারেরই একজন সদস্য। ছোটবেলা থেকেই জানতাম খেলাধুলাই হবে আমার ভবিষ্যৎ। বাবা ও মা দুজনেই জাতীয় পর্যায়ের অ্যাথলেট ছিলেন। দুই বোন প্রথম বিভাগ ভলিবল খেলেছে। এমনকি একজন ভলিবল চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিতেছেন; কিন্তু আমি পারিনি। আমিই একমাত্র বাকি রয়েছি তাদের ভেতর। স্বনামধন্য পরিবারের সবথেকে ছোট হিসেবে আমি সব সময়েই চাইতাম আমার সামর্থ্য প্রদর্শন করতে। আমি খুব ভাগ্যবান যে ফুটবলে আসতে পেরেছি এবং গোলরক্ষক হয়েছি।
Advertisement
পিকে : ফুটবল সম্পর্কে ছোটবেলার প্রথম কোন স্মৃতিটার সাক্ষী হয়েছিলে?
বুফন : আমার প্রথম স্মৃতি? মন বলছে, আমি তখন চার বছরের এক শিশু। ১৯৮২ সালের সেই বিশ্বকাপ দেখি, যা ইতালি জিতেছিল।
পিকে : আমি তো তখন জন্মই নেইনি!
বুফন : আমি তখন এতই ছোট ছিলাম যে, বিশ্বকাপ সম্পর্কে কিছুই বুঝতাম না; কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়ে টিভি চ্যানেলে কী পরিমাণ কোলাহলপূর্ণ ছিল সেগুলো মনে আছে। বিশেষ করে বলতে গেলে ‘ইতালি, ইতালি...’ বলে চিৎকার করাটা। আমি বাইরে ফুটবল খেলছিলাম এবং বুঝতে পারলাম, আমি এটাকে বেশ উপভোগ করছি। আমি বিকেল বেলায় ফুটবল খেলে সময় কাটাতাম এবং টিভিতে জাতীয় দলের সমর্থকদের আনন্দের চিৎকার শুনতাম।
Advertisement
পিকে : তুমি পার্মায় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলে, তাও ১৭ বছর বয়সে। অভিষেক ম্যাচে মিলানের বিপক্ষে ওইটুকু বয়সে একটি গোলও খাওনি!
বুফন : হ্যাঁ।
পিকে : গোলরক্ষকদের স্বপ্নই তো এমন।
বুফন : হ্যাঁ।
পিকে : পার্মার হয়ে ১৭ বছর বয়সে অভিষেক হওয়ার পর কেমন অনুভব করেছিলে? বিশেষ করে পার্মা ওই সময়ে ইতালির অন্যতম সেরা দল ছিল।
বুফন : নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী দশ বছর পার্মা ইউরোপের অন্যতম সেরা দল ছিল। ওই দশ বছরে তারা দুটি ইউরোপা কাপ, একটি ইতালিয়ান কাপ এবং উয়েফা সুপার কাপ জয় করেছে। ওই দলটি অনেক উচ্চ পর্যায়ের ছিল। ম্যাচটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা লিগে সবার উপরে ছিলাম এবং মিলানের সাথে ড্র করেছিলাম।
যে মিলান দলে ব্যাজ্জিও, উইয়াহ, সাভিছেভিচ, মালদিনির মত কিংবদন্তিতূল্য ফুটবলার ছিলেন। আমি তখন সবে সতেরোতে পা দিয়েছি। ওই দিন সকালে আমাকে বলা হলো, আমি ম্যাচটি খেলতে যাচ্ছি এবং গর্বের সাথে বলতে পারি আমি তেমন ভীত ছিলাম না। আমার এখনো মনে আছে, একটি পর্যায়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম, কারণ ওটাই আমার সুযোগ ছিল, বুফন কে এবং বুফনের সক্ষমতা দেখানোর। ভয়কে জয় করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটি খেলেছিলাম।
পিকে : তারপর ১৯ বছর বয়সে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিলে এবং রাশিয়ায় গেলে।
বুফন : পঞ্চম কি ষষ্ঠবারের বেলায় কোচ মালদিনি আমাকে বাছাই করেন; কিন্তু তার আগে আমি কখনোই ইতালির হয়ে খেলিনি। কারণ অন্য গোলরক্ষক যেমন পেরুজ্জি কিংবা পালুইসা আমার থেকেও যোগ্য গোলরক্ষক ছিলেন। ওটা ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপের জন্য বাছাইপর্বের ম্যাচ ছিল। আমরা রাশিয়ার মস্কোতে খেলেছিলাম তাদের বিপক্ষে। ২৫ মিনিটের সময় পালুইসা হাঁটুতে ব্যথা পেলেন এবং সাইডলাইনের বাইরে চলে গেলেন। আমি তখন প্রবল উদ্যমী এক টগবগে যুবক। কোন ভয় পাচ্ছিলাম না; কিন্তু যখন মাঠে নামলাম তখন অবশ্য বেশি খুশি হতে পারলাম না।
কারণ প্রচুর তুষারপাত চলছিল মাঠে। বিশ্বকাপে সরাসরি জায়গা করে নেওয়ার জন্য ম্যাচটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাদের জন্য। দুই মিনিট ওয়ার্মআপ করেই মাঠে নেমে পড়ি। মাঠে খুব মনযোগী ছিলাম। ভয় আমাকে দেখে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি এক ঘণ্টারও বেশি এমন কঠোর মনযোগী ছিলাম। আমি নামার পাঁচ মিনিটের ভেতরেই রাশিয়া ভালো একটি সুযোগ পেয়েছিল গোলের এবং আমি সেটি দুর্দান্তভাবে বামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভ করি যা আমাকে মাঠে প্রবলভাবে সাহায্য করেছিল।
পিকে : পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলারদের ভেতর তুমি একজন। ইতিহাসে মাত্র তিনজন এমন কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিল। তুমি, লোথার ম্যাথিউজ ... এবং একজন মেক্সিকান।
বুফন : একজন মেক্সিকান গোলরক্ষক।
পিকে : কেমন অনুভূতি হয় এটা নিয়ে?
বুফন : ভালো। গর্বিত। এটা অনেকটা জাহাজের মোটা দড়ি বেয়ে ওঠার মত। আমি ধারাবাহিকভাবেই নখের আঁচড় কেটে উপরে উঠেছি।
পিকে : তোমাকে কী অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে?
বুফন : তোমার প্রতিভা থাকাটা জরুরি; কিন্তু প্রচেষ্টাও থাকতে হবে যাতে মাঝে মাঝে সহ্য করতে পারো সব কিছু। এটা আমার জন্য সন্তোষজনক ব্যাপার যে মাত্র কয়েকজন পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলতে পেরেছে। ইউরোপে দুটি, এশিয়ায় একটি, আফ্রিকায় একটি এবং আমেরিকায় একটি বিশ্বকাপ খেলতে পারাটা উপভোগ্য ছিল আমার জন্য।
পিকে : আমি তো এটা ভাবে দেখিনি!
বুফন : আমি পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট খেলেছি। ষষ্ঠ বিশ্বকাপ খেলতে পারাটা আমার জন্য বিশেষ কিছু হতো; কিন্তু মাঝে মাঝে যা আছে তা নিয়েই তৃপ্ত থাকতে হয়। ষষ্ঠ বিশ্বকাপ খেলার মত আমার পর্যাপ্ত সাহস ছিল না।
পিকে : তোমার স্বর্ণযুগে ইতালির হয়ে জার্মানিতে ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিলে, যেখানে সেরাদের কাতারে ছিলে তুমি। ওই বিশ্বকাপ সম্পর্কে কী মনে পড়ছে এখন? কেমন লেগেছিল?
বুফন : জার্মানি বিশ্বকাপে জয় ছাড়া যে সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম বিশেষ করে আমরা ইতালিয়ানরা সেটা এক কথায় অন্যরকম। সেখানে অনেক প্রবাসী ইতালিয়ান ছিল যারা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছে, আমরা ঘরের মাঠেই খেলছি। আনন্দ, উচ্ছ্বাস, আবেগ, সহযোগিতা সবকিছুই পেয়েছিলাম। আমরা একা কখনো হারিনি। আমার দুটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত রয়েছে সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে।
পিকে : ২-০!
বুফন : টুউ-টু-জিরো কিন্তু সেটি ছিল আমার জীবনের অন্যতম রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের একটি। যখন আমার সেটি মনে হয় তখন খুব খারাপ লাগে। কীভাবে একজন মানুষ ওই পরিমাণ চিন্তা এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ওই সময়ে! পরবর্তীতে অতিরিক্ত সময়ে ২-০ ব্যবধানে জিতলাম। যখন ভোর ৫টায় হোটেলে আসি তখন বাইরে দেখি ১০ হাজার মানুষ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
পিকে : অবিশ্বাস্য!
বুফন : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল আমরা জার্মানিকে হারিয়ে শান্ত ছিলাম অনেকটা এমন যে আমরা আগে থেকেই বিশ্বাস জিতে গেছি। অনেকটা পাগলাটে!
পিকে : এটা কিন্তু খুব সহজ নয় যে তুমি ফাইনালে উঠে গেছো, আর উদযাপন করছো তুমি বিশ্বকাপ জয় করে ফেলছো। হ্যাঁ, এটা খুব বাজে!
বুফন : এটা পাগলাটে অবস্থা ছিল আমাদের জন্য। ১২ বছর পর ফ্রান্সের দলের দিকে তাকাও এবং চিন্তা করো কতটা শক্তিশালী তখন তারা ছিল। আমরা ভেবেছিলাম আমরা জিতে গেছি; কিন্তু আমাদেরকে খুব শক্তিশালী এক দলের বিপক্ষে খেলতে হয়েছিল। কোন দলকে হারাতে পারলেই সেখানে প্রবল উদ্দীপনা কাজ করবে। জার্মানির মত দলকে হারানোর পর তো আরো।
আমরা ধারাবাহিক ছিলাম। আমরা কাউকে ভয় পাইনি এবং ভাবতাম আমরা সবাইকে হারাতে পারবো। অপ্রত্যাশিতভাবে আমি ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালে খুব কম সময় নার্ভাস ছিলাম। আমি জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচের আগে ৬-৭ ঘন্টা ঘুমিয়ে ছিলাম, অন্যদিকে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচের আগে মাত্র ২ ঘন্টা। অস্বস্তি আমাকে চেপে ধরছিল, কারণ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কষ্ট ওই পর্যায়ে। তাই বিশ্রাম নেওয়াটা দুরূহ ছিল। এটা আসলেই সহজ ছিল না। পরিষ্কার মনে আছে, জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচ জিতে আমরা অনেকেই খুশি হতে পারছিলাম না। কারণ আমাদেরকে আরো শক্তি সঞ্চয় করতে হবে, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এগুলোকে উৎসর্গ করতে হবে। ফাইনালে জয়ের পরেই আমরা সেটিকে উদযাপন করি অনেক দিন পর।
পিকে : তারপর আসলো ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ এবং ব্রাজিল ২০১৪ যেখানে ইতালি তেমন ভালো করতে পারেনি এবং ২০১৮ বিশ্বকাপেও তোমরা বাছাইপর্ব উৎরাতে পারলে না। তোমার কি মনে হয়, সালসিও, ইতালিয়ান ফুটবলের উচিত চাহিদাগুলোকে পুনরায় যাচাই করার মাধ্যমে সেগুলোকে নিয়ে কাজ করে পূনরায় শীর্ষে ফেরা সম্ভব?
বুফন : আমার মনে হয় কিছু একটা গোলমেলে আছে। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না ইতালি বর্তমান সময়ে ঐ রকমের ট্যালেন্টেড খেলোয়াড় খুঁজে পেয়েছে। আমি যখন জাতীয় দলে আসি তখন বাজ্জিও, দেল পিয়েরো, টট্টি, ইনজাঘি, মন্তেলা, ভিয়েরি, মালদিন এদের মত প্রতিভাবান ফুটবলার ছিল। গেল দশ বছরে ইতালির ভালো দল ছিল। আমরা একদম খারাপ দল ছিলাম না কিন্তু প্রতিভাবান ফুটবলার ছাড়া আমাদেরকে কিছু নির্দিষ্ট ফুটবলারের উপর নির্ভর করতে হয়। এখান থেকে ফলাফল বের করে আনাটা খুব কঠিন। ঐতিহ্যের কারণে গেল দশ বছর উন্নতি করতে পেরেছি। আমাদের রেকর্ড খুব বাজে এই সময়টায় কিন্তু সেটা সত্ত্বেও ২০১২ ইউরো কাপের ফাইনালে খেলেছি। ২০১৬ ইউরোতেও ভালো লড়াই করেছি। আমাদের ঐতিহ্যই আমাদেরকে সাহায্য করছে যতটা না আমরা আশা করেছি।
পিকে : তোমার কী মনে হয় প্রতিযোগিতামূলক লিগগুলোর তুলনায় সিরি-আ কিছুটা পিছিয়ে আছে, প্রিমিয়ার লিগ কিংবা লা লিগার চেয়ে? তোমার কী মনে হয় বর্তমানে জুভেন্টাসেরই কেবল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের মত ক্ষমতা রয়েছে?
বুফন : হয়তোবা। এটা অনেকাংশে সত্যি; কিন্তু আমি অন্য দল এবং জাতীয় দল নিয়ে মনযোগী। যেমন ফ্রান্স, যাদের খেলোয়াড় রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, স্পেনেরও। তাদের সব সময়েই অনেক খেলোয়াড় থাকে যারা বিভিন্ন জায়গায় খেলে। আমাদের সমস্যাটা প্রতিযোগিতামূলক লিগে নয়, সমস্যাটা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে, বিশেষ করে খেলোয়াড়দের।
পিকে : প্রতিভার অভাব?
বুফন : হ্যাঁ। সিরি-আ হয়তো নিম্ন পর্যায়ের হতে পারে; কিন্তু প্রতিনিয়ত যদি প্রতিভাবান ফুটবলার বের হয়ে আসতো তাহলে তারা পিএসজি কিংবা রিয়াল মাদ্রিদে খেলার সুযোগ পেত। জাতীয় দল সব সময়ই উচ্চ পর্যায়ে থাকতো। সেখানে ভেরাত্তি এবং জুভেন্টাসের ফুটবলার ছাড়া তেমন কোন প্রতিভাবান ফুটবলার নেই। এটাই প্রধান সমস্যা।
পিকে : তোমার জুভেন্টাস ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সিরি-আ ‘বি’ তে নেমে গিয়েছিল জুভেন্টাস; কিন্তু তুমি সিদ্ধান্ত নিলে ক্লাবেই থেকে যাবে। দেখে মনে হলো সমর্থকদের ভালোবাসার টানেই থেকে গেছো; কিন্তু এটাতে তো অনেক ঝুঁকি ছিল। অন্য কোন দল বেছে নিতে পারতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলে এমন কোন দলকে। তা না করে ওখানেই থেকে গেছো এবং সিরি-আ ‘বি’ তে খেলছো। এটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল?
বুফন : সিরি-আ ‘বি’ তে থাকতে পেরে আমি সন্তুষ্ট হয়েছিলাম কারণ আমার মতে কিছু মানুষ, কিছু খেলোয়াড় রয়েছে যারা খেলাটাকে চারদিকে ছড়িয়ে আশার বাণী শোনাতে চায় মানুষ ও সমর্থকদের জন্য। আমি সেই সুযোগটা লুফে নিয়েছিলাম। ওটা এমন এক সময় ছিল যারা আমাকে পছন্দ করে তাদের বার্তা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। খেলোয়াড়দের এটা অনুভব করতে হয়, জনপ্রিয়তা এবং টাকার উর্ধ্বে গিয়ে এটি করতে হয়।
আমি আবারো সুযোগ পেলে করবো। তারপর আমরা সিরি-আ ‘বি’ জিতলাম। মজার একটি বছর ছিল সেটি। পরের দুইটা মৌসুম জুভেন্টাসকে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এটা আসলেই আমাদের সাথে যাচ্ছিল না। জুভেন্টাসকে একদম অপরিচিত মনে হচ্ছিল। আমাদের সাহস, আমাদের পরিচয়, আমাদের নৈতিক কাজকর্ম হারিয়ে ফেললাম। কয়েক বছর আমরা ছয় কিংবা সাতে থেকেও লিগ শেষ করেছি। আমি আমার নিজেকে তখন বলতাম, ‘কেন আমি এই দলকে বেছে নিয়েছি?’
আমি শান্ত হয়ে এটি বলেছিলাম কারণ আমি স্পষ্টভাষী এবং খুব আশাবাদী একজন মানুষ। আমি নিশ্চিত কঠোর পরিশ্রম এবং ভালো ব্যবহার আপনার কাজে আসবেই। আমি সব সময় এটা বলতাম। ৬ বছর পর লিগ জিতে খুব খুশি হয়েছিলাম। ৬টি খুব বছর খুব বাজে ছিল আমাদের জন্য। ছয়টি বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তেমন খেলার সুযোগ পাই নি। আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলাম যার দরুন সাফল্য এসেছেই।
পিকে : এই ছয় বছরে একবারও কি ক্লাব ছাড়ার কথা মাথায় আসেনি? এটা অবিশ্বাস্য যে ২৩ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে মাত্র দুটি ক্লাবে খেলেছো তাও আবার সে দুটাই ইতালির। অন্য লিগে খেলার ইচ্ছা জাগেনি?
বুফন : আমি হয়তো পছন্দ করতাম এটা, কারণ আমার সাথে বিভিন্ন ক্লাবের বিভিন্ন মানুষদের পরিচয় ছিল। অনেকটা মর্মস্পর্শী ব্যাপার ছিল; কিন্তু আমার ভেতরে আমি কেবলই একজন ইতালিয়ান। আমি জানি ইতালির নিজস্ব কিছু বাধ্যবাধকতা আছে; কিন্তু বিশ্ব আমাকে এখানে এখানেই দেখতে চেয়েছিল এবং এখানেই আমি খুশি। যে কোন ধরনের খেলাধুলায় আমি কখনোই ইতালিকে ত্যাগ করতে চাই না এবং করবোও না।
পিকে : তুমি ২৩ বছর ধরে পেশাদার ফুটবল খেলছো। এই দীর্ঘ সময়টায় ফুটবল অনেক পরিবর্তিত হয়েছে এবং একজন গোলরক্ষক হিসেবে তুমি দেখে থাকবে কীভাবে এখনকার গোরক্ষকরা তাদের পা-কে ব্যবহার করছে। তুমি এই পরিবৃত্তিটা দেখেছো। তাছাড়া গোলরক্ষকরা এখন তাদের নিজেদের বিচরণকে আরো দ্রুতগতির করে ফেলছে; কিন্তু তোমার এগুলো কিছুই দরকার নেই।
বুফন : এটা আমার জন্য দারুণ সুযোগ, সামান্য সুযোগ বলা যায়। কারণ ফুটবল ধীরে ধীরে উন্নতি করছে। এখন কম সময়ে বেশি উপভোগ্য হচ্ছে। আমিও এটা নিয়ে ভেবেছি। ব্যক্তিগতভাবে এটা আমাকে আরো শাণিত করবে। কারণ প্রত্যেক গোলরক্ষকের উচিত তাদের ফিট অনুসারে নড়াচড়া করা এবং ভিন্নভাবে খেলা। কিক মেরে মাঠের বাইরে পাঠানোর মত দক্ষ হতে হবে আপনাকে। পূর্বের থেকে এখন এটি আরো জটিল কাজ। এটা আমার জন্য ভালো। কারণ আমি এখন ৪০ বছর বয়স্ক এক ফুটবলার এবং এখনো খেলছি। কারণ আমি প্রতিযোগিতা ও উন্নতি পছন্দ করি।
পিকে : কয়েক মাস আগে তুমি বলেছো এটাই তোমার শেষ বছর; কিন্তু আমি কিয়েল্লিনির সাথে কথা বলেছি, সে বলল বুফন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এই ব্যাপারে কোন খবর আছে? আমি কি কিছু মিস করেছি? আমরা কী বুফনকে আরো দুই বছর দেখতে পারি?
বুফন : এটাতে চমক নেই। এই বয়সে আমার মনে হয় প্রত্যেক মাস, প্রত্যেক সপ্তাহ এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। কারণ এটা অ্যাথলেটদের জন্য, যেমন তুমি-আমি এদের জন্য বেশি দরকার। যারা সব সময়েই শীর্ষ পর্যায়ে খেলে, যারা সব সময়েই সেরা খেলে, নিজেদের সেরাটা বের করে আনতে পরিশ্রম করে এবং শীর্ষে অবস্থান করে। শারীরিকভাবে তোমাকে শক্তিশালী হতে হবে। কারণ তুমি কখনোই চাইবে না, তোমার ঐতিহ্য অনুযায়ী বাজে ফলাফল পেতে। আমি বুফন, এটাই আমি শেষ মিনিট পর্যন্ত বলতে চাইবো এবং যখন আমার মনে হবে এটা আমি নই তখনই চলে যাবো। কয়েকমাসের ভেতর প্রেসিডেন্টের সাথে আমার দেখা হবে। তখন শান্তিপূর্ণভাবেই তাকে এই ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করবো। আমি বর্তমানে খুব খুশি আছি। আমি খেলে যাচ্ছি, কারণ এই পরিবেশটাকে ভালোবাসি। বন্ধুদেরকে আমি সবসময় সাহায্য করার চেষ্টা করি। যেদিন থেকে পারবো না, কোন সমস্যা নেই। আমার দীর্ঘ একটি অসাধারণ ক্যারিয়ার ছিল।
পিকে : তুমি কি অবসরকে ভয় পাও? একজন পেশাদার ফুটবলারের বয়সের থেকেও তুমি বেশি খেলে যাছো। তুমি কী অবসর নিয়ে ভীত? ফুটবলকে ছেড়ে একদমই অপরিচিত একটি জীবন গড়তে তুমি কী আসলেই ভীত?
বুফন : আমি যদি বলি আমি ভয় পাচ্ছি না, তাহলে মিথ্যা বলা হবে; কিন্তু ভেতরে আমি খুব শান্ত। কারণ সাধারণত আমি কিছুটা কৌতূহলী এবং যেদিন আমি ফুটবল খেলা বন্ধ করবো তখন কীভাবে এই বিষাদ কাটিয়ে ওঠা যায় সেটির খোঁজ করবো। মোটের উপর আমাদের মত খেলোয়াড়েরা যারা খেলার ভেতরেই তীব্রভাবে নিমজ্জিত থাকে তাদের মনকে অধিষ্ঠিত করা উচিত এবং কোন কারণে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো এবং কিছুর জন্য লড়াই করা উচিত।
মানুষের দৃষ্টিতে আমি কখনোই বিষণ্ণ হবো না। আমার জীবনের ২৩টা বছর খুব গোছালো ছিল এটাই প্রধান সমস্যা। প্রত্যেক সকালেই আপনাকে একটি নির্দিষ্ট কাজের ভেতর দিয়ে যেতে হয়; কিন্তু যখন আপনি ২৪ ঘন্টার ভেতর কোন কিছু না করেই বসে থাকবেন তখন সমস্যা হবেই।
পিকে : তুমি কী এই পেশাতেই থাকবে? অবসরের পর অন্য কোন পেশায় যোগ দিবে নাকি?
বুফন : পরিচালক, ম্যানেজার অথবা ট্রেইনার হওয়ার জন্য কোর্স করবো। তারপর একটিকে বেছে নিব এবং চালিয়ে যাবো।
পিকে : সর্বশেষ জানতে চাই, তুমি বলেছো ফুটবল তোমাকে সেরা মানুষ বানিয়েছে। ফুটবলার না হলে কী হতে তুমি?
বুফন : নির্দ্বিধায় আমি একজন খারাপ মানুষ হতাম। হয়তো বাবা-মার মতো শিক্ষক হতাম। ওই রাস্তাতেই ছিলাম। সব সময়ে খেলাধুলা পছন্দ করতাম এবং বাচ্চাদের সাথে থাকতাম; কিন্তু ফুটবল আমাকে ভালো মানুষ বানিয়েছে। কারণ আমি বিশ্বাস করি গ্রুপটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রুপের সদস্য হিসেবে দলের সবার সাথে জয়-পরাজয় ভাগ করে নেওয়াটা আনন্দের। এটা আপনার স্বার্থপরতা কমাবে।
পরার্থবাদী এবং নিজের সবকিছু অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়াটা জীবনের সেরা জিনিসগুলোর একটি। জনপ্রিয় হলে আপনার ভালো-খারাপ দুটোই থাকবে। খারাপ তখনই নজরে আসে যখন আপনি খারাপ কিছু করছেন এবং এটাই টিভি, পত্র-পত্রিকাগুলো ফলাও করে প্রচার করে। ওইসব সমালোচনা আপনার ভেতর স্পৃহা যোগাবে এবং নিজেকে ভাবতে চিন্তা করবে, এগুলো কখনোই তোমার প্রাপ্য না। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো যাতে কেউ তাদের না খেপায়, ভালো ব্যবহার করো এবং অন্যদের থেকে ভালো মানুষ হও। ওইরকম দ্বিধান্বিত খবরগুলো আমার নিজেকে উন্নতি করতে খুব সাহায্য করেছে।
পিকে : খেলোয়াড় হিসেবে, আমি জানি তুমি থাকাতে ফুটবল আরো সুন্দর হয়েছে। তোমাকে এখানে পাওয়াটা এবং কথা বলাটা আমাদের জন্য তৃপ্তিদায়ক। তুমি কি জানো, যখন আমার বয়স ২১, তখন আমাকে বার্সা এবং জুভেন্টাসের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয়েছিল? আমি হয়তো তোমার সাথে তখন চ্যাঞ্জিং রুমটা ভাগাভাগি করতে পারতাম।
বুফন: আসলেই?
পিকে : হ্যাঁ। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।বুফন : ধন্যবাদ তোমাকেও। আরআর/আইএইচএস/এমএস