ক্রমে ক্রমে সমাজটা ভেঙে পড়ছে। আমরা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি, ব্যক্তি-সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে। দীর্ঘদিনের অঁটুট থাকা বন্ধনটা ভেঙে যাওয়ায় স্বার্থপরতার সমাজ কাঠামোই মানুষকে স্বার্থপর ও সমাজ থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ইভটিজিং,জিম্মি, গুম, খুন, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ বিকৃত ও নৃশংস নানা ধরনের অপরাধ আমাদের সমাজে সংগঠিত হচ্ছে।
Advertisement
এসবের মধ্যে সম্প্রতি কিছু ভিন্নমাত্রার নিত্য-নতুন অপরাধও যুক্ত হয়েছে। যার অধিকাংশই সংগঠিত করছে কিশোর অপরাধীরা। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি সদ্য কৈশোরে পা-দেওয়া কিশোরদের এসব অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়া যথেষ্ট ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ না হওয়ায় এই কিশোররা আবার আইন অনুযায়ী শিশুই হয়ে আছে। সম্প্রতি এই বয়সের কিশোরদের নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ আমাদের যথেষ্ট চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ২৫ এপ্রিল প্রকাশিত তেমন একটি সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি, পিরোজপুর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ৭ ছাত্র চতুর্থ শ্রেণির ১০ ছাত্রকে ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে এক ছাত্রের কাছ থেকেই নেওয়া হয়েছে তিন লক্ষাধিক টাকা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রকে সপ্তম শ্রেণির ওই সাত ছাত্র শৌচাগারে নিয়ে বিবস্ত্র করে ছবি তোলে। এরপর এই ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা আদায় করা হতো। এ ছাড়া কয়েকজন ছাত্রকে মারধর করার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হতো।
একদিন বিদ্যালয়টির সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র এক শ ডলারের একটি নোট বাসায় নিয়ে গেলে ডলার দেখে তার মায়ের সন্দেহ হয়। তিনি ছেলেকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্র তাকে ডলারটি দিয়েছে বলে ছেলেটি জানায়। এরপর এই ছেলের মা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রটির মাকে ফোন করে বিষয়টি জানান। বেরিয়ে আসে আরো তথ্য।
Advertisement
জানা যায়, চতুর্থ শ্রেণির সেই ছাত্রটি বাধ্য হয়ে এর আগে এক শ ডলারের ৩৪টি নোট ও ৫০ হাজার টাকা সপ্তম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রকে দিয়েছে। তার বাবা সৌদিপ্রবাসী এবং তার নানার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে। তার মতো আরও ৯ জন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র বাড়ি থেকে টাকা এনে সপ্তম শ্রেণির ওই ছাত্রদের দিতে বাধ্য হয়।
স্থানীয় সাংবাদিকরা এবিষয়ে জানতে চাইলে, অভিযুক্ত সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র এভাবে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলে, ‘আমরা চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রের কাছ থেকে দুষ্টুমির ছলে টাকা নিয়েছি।’
অপরাধ সংগঠিত করে তারা আবার বলছে, ‘আমরা দুষ্টুমির ছলে টাকা নিয়েছি’। অপরাধের মাত্রাটা যে কত ভয়াবহ তা তারা অনুধাবনই করতে পারেনি। কোনদিকে যাচ্ছে আমাদের সমাজ! কত নির্লিপ্তভাবে কিশোরের আপরাধ করে চলেছে।
কিশোর অপরাধের এমন আরো একটি সংবাদ আমাদের নজরে আসে গত ২৪ এপ্রিল। সংবাদে প্রকাশ-কিশোরগঞ্জের কিশোর 'সন্ত্রাসী'দের দৌরাত্ম্যে তটস্থ শহরবাসী। প্রায় প্রতিদিনই শহরের কোনো না কোনো মহল্লায় চাপাতি নিয়ে হামলা চালাচ্ছে তারা। তাদের চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন।
Advertisement
গত এক বছরে জেলা শহরে এই চাপাতি গ্যাংয়ের শতাধিক হামলায় কমপক্ষে দেড়শ' মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয় ও পঙ্গুত্ববরণ করেছেন চারজন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৪০ জন। সর্বশেষ তাদের চাপাতি হামলায় শারফিন নামের সদ্য সমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার ভয়াবহতা বুঝার জন্য সংবাদের বাকী অংশ না পড়েও সহজেই অনুমান করা যবে যে ঠিক কী পরিমাণ নৃশংস পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শান্তির শহর বলে খ্যাত কিশোরগঞ্জে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে।
আমাদের মনে আছে, গত বছর দেশে কিশোর অপরাধের আলোচিত কয়েকটি ঘটনা ঘটে ঢাকায়। এরমধ্যে উত্তরায় কিশোরদের দুই দলের বিরোধের জেরে ৬ জানুয়ারি খুন হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান কবীর। সেই ঘটনার কিছুদিন পর তেজগাঁওয়ের তেজকুনীপাড়ায় ‘কে বড়, কে ছোট’ এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয় আবদুল আজিজ নামে এক কিশোর। এ দুটি ঘটনার মধ্যে একইমাসের ১৫ তারিখ রূপনগরে এক স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে একদল কিশোর।
দিনকেদিন কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। ২০১৭ সালের ২৮ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি, দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা।
অসহনীয় মাত্রায় সংগঠিত কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। ভাবতে পারেন, আমরা কোন পথে হাঁটছি?
অতীতে আমরা দেখিছি, রাজনৈতিক দলের নেতা- কর্মীরা নিজেদের স্বার্থে মিছিল, মিটিং, হরতালে পিকেটিং, বোমা হামলা আর অপরাধীরা চুরি, ডাকাতিসহ নানা কাজে শিশু- কিশোরদের ব্যবহার করতো। আজ তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বিষয়টি এমন নয়, বরং এরসাথে যুক্ত হয়েছে নিত্য- নতুন নানা অপরাধ।
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার এইসময়ে কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। এ ছাড়াও আরো অনেক কারণ রয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে কিশোর আপরাধ বাড়ার পেছনে।
পরিবারের অবহেলা, পিতা- মাতার সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, বয়োজ্যেষ্ঠদের নেতিবাচক চিন্তা- চেতনা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, শিল্প- সংস্কৃতির বিকাশে বাধা, মাদকের সহজলভ্যতা, দেশপ্রেমের অভাব, ও অসহিষ্ণু সমাজব্যবস্থাও এর জন্য সমপরিমাণ দায়ী।
আজকে সময় হয়েছে, পড়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া এই সমাজটাকে আবার পুনঃর্নিমাণের। মহান স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এজন্য সবার আগে আমাদের নজর দিতে হবে নতুন প্রজন্মের দিকে। তাদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষাগ্রহণ, বৈষম্যহীন নিরাপদ জীবন-যাপন নিশ্চিত করতে হবে। সময়কালের বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোর ও তরুণদের পেছনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলোর বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবেই না সঠিকভাবে তৈরি হবে প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষা ও গড়ার আগামী প্রজন্ম। যারা একদিন পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দাঁড় করাবে।
আর আমরা যদি সে দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে না পারি, তাহলে আগামীদিনে একটি দুর্বল, অসৎ, মেধাহীন, ভিরু, স্বার্থপর, নেশাগ্রস্ত ও অসুস্থ একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এখন ভেবে দেখতে হবে আমরা আসলে কোনটা চাই।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম