খেলাধুলা

সবই জিতেছেন, বিশ্বকাপটা জেতা হবে না রোনালদোর!

সর্বকালের সেরা ফুটবলারের তালিকায় তার নাম উঠবে কি-না, এখনও জানা নেই। উঠেও যেতে পারে। টানা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ফুটবল বিশ্বকাপে সমানভাবে শাসন করে যাওয়ার মতো ফুটবলাররে জন্মই তো হয়েছে কম। তাদের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো একজন। ক্লাব পর্যায়েই নয় শুধু, জাতীয় দলের জার্সি গায়েও সমানভাবে সাফল্যের অংশিদার তিনি। নিজের দেশকে প্রথম কোনো বড় শিরোপা, ২০১৬ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ উপহার দিয়েছেন তিনি।

Advertisement

যে কাজটা ইউসেবিও থেকে শুরু করে লুইস ফিগোরা পর্যন্ত পারেনি, অখ্যাত একটি দল নিয়ে সেই অসাধ্যই সাধন করে দেখিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। অথচ, ইউসেবিওর মতো ফুটবলারের নাম উচ্চারিত হয় পেলে-বেকেনবাওয়ারদের মতো সর্বকালের সেরা তারকার সঙ্গে। ২০০৪ সালের ইউরোর ফাইনালে উঠে গিয়েছিল লুই ফিগো-ডেকোদের পর্তুগাল। সেবারও দলে ছিলেন রোনালদো।

তখনকার সময়ে তিনি উদীয়মান তারকা। তার অসাধারণ নৈপুন্যেই পর্তুগিজরা পৌঁছেছিল ইউরোর ফাইনালে; কিন্তু রোনালদো-ফিগো-ডেকোদের পর্তুগাল আর শিরোপা জিততে পারেনি। গ্রুপ পর্বে যে গ্রিসকে তারা হারিয়েছিল, সেই গ্রিসের কাছে হেরেই শিরোপা জয়ের অপেক্ষা বাড়ে পর্তুগালের। সেই ঘটনার বরাবর এক যুগ পর আবারও ইউরোর ফাইনাল এবং ফ্রান্সের মত পরাশক্তিকে হারিয়ে প্রথম কোনো শিরোপা জয় করতে পারলো রোনালদোর দেশ পর্তুগাল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর প্রাপ্তির ঝুড়িতে অপূর্ণতা বলতে গেলে আর কিছুই নেই।

লিওনেল মেসির সঙ্গে রোনালদোর প্রতিদ্বন্দ্বীতাটা কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে ইতোমধ্যেই। টেনিসে নাদাল-ফেদেরার, বক্সিংয়ে মোহাম্মদ আলি-জো ফ্রেজার কিংবা অ্যাথলেটিক্সে উসাইন বোল্ট-জাস্টিন গ্যাটলিনদের বছরের পর বছর চলা প্রতিদ্বন্দ্বীতার মতোই। ফুটবলের ইতিহাসে এককভাবেই মাত্র দুই ফুটবলারের এমন প্রতিদ্বন্দ্বীতার নজির নেই বললেই চলে। প্রতিটি যুগই বেশ কিছু তারকার জন্ম দিয়েছে; কিন্তু মেসি-রোনালদোদের যুগে কেবল তারা দু’জনই। এই দু’জনের সাম্রাজ্য ভাঙে এমন সাধ্য কার!

Advertisement

ফিফা বর্ষসেরা কিংবা ব্যালন ডি’অর জয়েই নয়, ক্লাব কিংবা জাতীয় দলের হয়ে গোল করার ক্ষেত্রেও প্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদোর সঙ্গে প্রতিদ্বনিদ্বতা। লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কিংবা ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জয়- কোনটাতে প্রতিদ্বন্দ্বীতা নেই সিআর সেভেনের! একজন মাত্র তারকা নির্ভর হয়ে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদও ইউরোপীয় ফুটবলে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে বছরের পর বছর। যদিও লা লিগায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারছে না তারা বার্সেলোনার সোনালি প্রজন্মের সামনে।

ব্যাক্তিগত অর্জনের তুলনায় যে কোনো কিংবদন্তি, সেরা ফুটবলারকে ছাড়িয়ে রোনালদো। নিজের শো কেসে স্থান দিয়েছেন ২৫টি ট্রফির। এর মধ্যে ৫টি লিগ শিরোপা, চারটি উয়েফো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, একটি ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপও রয়েছে। মেসির চেয়েও এগিয়ে দুটি ক্ষেত্রে রোনালদো। সেটা হচ্ছে ইউরোপের সেরা ৫টি লিগের মধ্যে সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি (৩৯৩টি)। অন্যটি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ গোলাদাতা তিনি (১২০টি)। ক্লাব এবং দেশের হয়ে ৬৫০টি গোলের মালিক ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

কিন্তু একটি বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে ওঠেনি বিশ্বসেরা এই তারকার। ওঠার সম্ভাবনা যে তৈরি হবে তাও নয়। ইউরো শিরোপাটা হয়তো তিনি জিততে পেরেছেন; কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের স্বপ্ন রোনালদো দেখেন না। পর্তুগালের দলটি শিরোপা জয় নয়, সর্বোচ্চ কতদুর যাওয়া যায় সে চিন্তায় ব্যাস্ত। বিশ্বকাপে চমক দেখিয়ে বড় কিছু করে ফেলতে পারলে সেটা পরের কথা; কিন্তু রোনালদোর চিরকালের আক্ষেপ থেকে যাবে, একটি বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে না পারার।

অথচ এই রোনালদোই পৃথিবীর আলো দেখার আগে শিকার হতে যাচ্ছিলেন এক নির্মন বাস্তবতার। কারণ গর্ভে থাকাকালেই রোনালদোর মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গর্ভপাত করাবেন; কিন্তু ততদিনে অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারও পরামর্শ দিয়েছিলেন গর্ভপাত না করানোর। রোনালদোর মাও সিদ্ধান্ত নেন, গর্ভপাত করাবেন না। শেষ পর্যন্ত সান্তোস অ্যাভেইরো পৃথিবীর আলো দেখালেন পরিবারের চতুর্থ সন্তানকে। কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের নামে। আভেইরো এবং মারিয়া ডলারস ছোট ছেলের ডাক নাম রাখলেন তারা ‘রোনালডো’।

Advertisement

১৯৯২ সালেই মূলতঃ ফুটবলের ক্যারিয়ার শুরু রোনালদোর। শুরুতে খেলতেন অ্যামেচার ফুটবল। ১৯৯৫ সালে ন্যাসিওনেলে যোগ দেয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক ফুটবলে পদচারনা শুরু। ১৯৯৭ সালে ১২ বছর বয়সে অংশ নেন স্পোটিং সিপির তিন দিনের ট্রায়াল। টিকেও যান। ১৫০০ পাউন্ড ফিতে যোগ দেন সিপিতে। শুরু হয় স্পোর্টিং সিপির ইয়থ অ্যাকাডেমির ক্যারিয়ার। ১৪ বছর বয়সে রোনালদোর মধ্যে বিশ্বাস জন্মে, তিনি পেশাদার ফুটবল খেলতে পারবেন। রোনালদোর বয়স যখন- ১৬ বছর, তখনই তার অসাধারণ ড্রিবলিং দেখে স্পোর্টিং সিপির তখকার কোচ তাকে সুযোগ দেন সিনিয়র দলের হয়ে খেলার। ওই মৌসুমেই রোনালদো ক্লাবের অনুর্ধ্ব-১৬, অনুর্ধ্ব-১৭, অনুর্ধ্ব-১৮, ‘বি’ দল এবং সিনিয়র দলের হয়ে খেলেছেন।

২০০২ সালে শুরু হয়ে যায় রোনালদোর পেশাদার ক্যারিয়ার, স্পোর্টিং সিপির হয়ে। সেখান থেকেই সিঁড়ি পেয়ে যান ইউরোপের বড় লিগে চলে আসার। সিপিতে থাকাকালীনই রোনালদোকে প্রথম দেখেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি কোচ স্যার আলেক্স ফার্গুসন। যেদিন সিপির কাছে এক প্রীতি ম্যাচে ৩-১ গোলে হেরে যায় ম্যানইউ। ফার্গি রোনালদোকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার দেখা সেরা প্রতিভা হচ্ছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।’ ২০০৩ সালেই স্পোর্টিং সিপি থেকে সোজা চলে আসেন ম্যানইউতে। শুরু হয় ইংলিশ ফুটবলের কঠিন জীবন। বিশ্বসেরা হওয়ার প্রথম পদক্ষেপও ছিল তার সিপে থেকে ম্যানইউতে নাম লেখানো। ম্যানইউতে এসেই পেলেন সাত নম্বর জার্সি। তখন থেকেই পরিচিতি পেলেন সিআর সেভেন নামে।

২০০৩ সালে বোল্টন ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে রোনালদো যখন ম্যাচের ৬০ মিনিটে নিকি বাটের বদলি হিসেবে প্রথম মাঠে নামেন, তখন পুরো ওল্ড ট্র্যাফোর্ড দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অভিষেকে তার খেলা দেখে জর্জ বেস্ট মন্তব্য করেছিলেন, ‘নিঃসন্দেহে অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং স্মরণীয় এক অভিষেক।’

২০০৩ থেকে শুরু করে ২০০৯- এই অর্ধযুগে রোনালদো শুধু ইতিহাস লিখেছেন। পরিণত হয়েছিলেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ঘরের ছেলেতে। এই সময়ের রেড ডেভিলসদের হয়ে ১৯৬ ম্যাচ খেলে করেছেন ৮৪ গোল। জিতেছেন তিনটি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, একটি এফএ কাপ, দুটি লিগ কাপ, একটি কম্যুনিটি শিল্ড, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং একটি ক্লাব বিশ্বকাপ। ম্যানইউতে থাকতেই প্রথম ব্যালন ডি’অর এবং ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার জিতে নেন, ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার, ৯৪ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে।

রিয়ালে যোগ দেয়ার পরই মূলতঃ রোনালদোর প্রতিদ্বন্দ্বীতা মেসির সঙ্গে। এই প্রতিদ্বন্দ্বীতায় কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে মেসির সঙ্গে মিলে টানা ৯-১০ বছর ফুটবল বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের আসন দখল করে রয়েছেন তারা দু’জন। রিয়ালে এসেছেন ৯ বছর হয়ে গেলো। জিতেছেন মাত্র দুটি লিগ শিরোপা। তবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন তিনবার। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন ২বার।

পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়েও রোনালদো নিজেকে প্রমাণ করেছেন অনেকবার। ২০০৪ ইউরোয় নিজের দেশকে তুলেফিলেন ফাইনালে। ২০০৬ বিশ্বকাপে তুলেছিলেন সেমিফাইনালে। তবে রোনালদোর সবচেয়ে সেরা সাফল্য, দেশকে প্রথমবারেরমত ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ উপহার দেয়া। ইউসেবিও থেকে লুই ফিগো- যে কাজটা তারা করতে পারেননি, সেটা করে দেখালেন রোনালদো। ক্লাব ফুটবলে কাঁড়ি কাঁড়ি সাফল্যের সঙ্গে জাতীয় দলের হয়ে ইউরো জয়, রোনালদোর ক্যারিয়ারকেই যেন পূর্ণ করে দিল। পর্তুগালের হয়ে এখনও পর্যন্ত ৮১ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার আসন ধরে রেখেছেন তিনি। ব্যালন ডি’অর জিতেছেন ৫বার। ফিফা বর্ষসেরা হয়েছেন ৫বার।

আইএইচএস/জেআইএম