* হুঁশিয়ারি আমলেই নেয়নি ব্যবসায়ীরা
Advertisement
* ব্যবসায়ীরা পাননি সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশনা
* মূল্যবৃদ্ধির দায় রাষ্ট্রের : ক্রেতা
বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। রমজান উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনও হলো। বিভিন্ন মনিটরিং সেলও গঠন করা হয়েছে। সংযমের মাসে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনও। এত আয়োজন! তবুও নিয়ন্ত্রণহারা নিত্যপণ্যের বাজার। সব ঘোষণা-ই যেন বুমেরাং। রমজানের প্রথম দিনেই লাগামহীন দ্রব্যমূল্য। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই রাজধানীর বাজারে।
Advertisement
‘দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা’ সরকারের এমন হুঁশিয়ারি আমলে-ই নেয়নি ব্যবসায়ীরা। রমজান উপলক্ষে শুধু দাম-ই বৃদ্ধি করা হয়নি, বাজার ভেদে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম আদায় করছেন বলে ভোক্তাদের অভিযোগ।
ক্রেতাদের অভিযোগ, রমজান উপলক্ষেই গলাকাটা দাম আদায় করছেন ব্যবসায়ীরা। এ মাসে দ্রব্যমূল্য সংযত রাখার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীরা কথা রাখছেন না। সরকারের মনিটরিং এখন তথাকথিত। ভেঙে পড়েছে বাজারকাঠামো।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজানের প্রথম দিনে প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও রমজান মাসকে ঘিরে গত দুই সপ্তাহ আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী।
রোজা উপলক্ষ্যে রাজধানীতে মাংসের (গরু, মহিষ ও ছাগল) দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন। তবে সিটি কর্পোরেশনের এ সিদ্ধান্ত মানেনি মাংস ব্যবসায়ীরা।
Advertisement
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে দেশি গরুর মাংস প্রতিকেজি ৪৫০ টাকা, বিদেশি (বোল্ডার) গরুর ৪২০, মহিষের ৪২০ এবং খাসির মাংস ৭২০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ডিএসসিসির এই নির্ধারিত দাম ঢাকার উত্তরেও বহাল রেখে ঘোষণা দেয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)।
কিন্তু শুক্রবার ঢাকার কোনো বাজারেই সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত দামে গরু ও মহিষের মাংস পাওয়া যায়নি।
প্রথম রোজায় রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, হাজীপাড়া, শান্তিনগর ও যাত্রাবাড়ী অঞ্চলের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখে গেছে, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে মাংস। গরু-মহিষের মাংসের কেজি বিক্রি হয়েছে ৪৭০-৫০০ টাকায়। তবে ৭০০-৭২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে খাসির মাংস।
এদিন রামপুরা অঞ্চলের বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৪৭০-৪৮০ টাকা কেজি। একই দামে বিক্রি হয়েছে খিলগাঁও ও শান্তিনগরে। যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে গরুর মাংস ৪৮০-৫০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
দাম বাড়ানো হয়েছে মুরগিরও। শুক্রবার সাদা বয়লার মুরগি বিক্রি হয় ১৫০-৬০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৪০-১৫০ টাকা। আর লাল কক মুরগির দাম বেড়ে হয়েছে ১৯০- ২০০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৭০-১৮০ টাকা কেজি।
জানতে চাইলে রামপুরার ব্যবসায়ী কালু মোল্লা বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের কোনো নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। তাছাড়া যে দামে গরু কেনা পড়ছে তাতে ৪৮০ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব না। যে দামে বিক্রি করছি তাতে পোষালে নেবে, না পোষালে চলে যাবে। আমরা তো জোর করে কাউকে মাংস ধরিয়ে দিচ্ছি না।’
রাজধানীর বাজারগুলোতে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে বিভিন্ন শাক-সবজিরও। শত টাকা কেজিতে কিনতে হয়েছে শসা। গাজরের কেজিও ১০০ টাকা। ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি মিলছে না বলে ক্রেতাদের অভিযোগ।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা, কচুক্ষেত, মালিবাগ হাজীপাড়া, খিলগাঁও, সেগুনবাগিচা এবং শান্তিনগরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
শসা ও গাজরের দাম বাড়ার আগে রাজধানীতে পেঁপে, বেগুন, চিচিঙ্গা ও ধুন্দলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। টমেটো, লাউ, করলা, পটল, ঢেঁড়স, বরবটির দামও কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে এদিন।
গত সপ্তাহে ৩৫-৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পটলের দাম বেড়ে হয়েছে ৪০-৫০ টাকা। ৪০-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া টমেটোর দাম বেড়ে এখন ৬০-৭০ টাকা। করলা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা কেজি, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৫-৫০ টাকা।
লাল শাক, সবুজ ডাটা শাক, পাট শাক, কলমি শাক বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকা আঁটি, যা আগের সপ্তাহে ৫-১০ টাকা আঁটি ছিল। আর ২০-২৫ টাকা আঁটি বিক্রি হওয়া পুইশাক ও লাউ শাক বেড়ে হয়েছে ৩০-৩৫ টাকা।
কাঁচামরিচের দাম বেড়ে ১৫-২০ টাকা পোয়া (২৫০ গ্রাম) বিক্রি হচ্ছে, যা আগের সপ্তাহে ছিল ১০-১৫ টাকা পোয়া। দেশি পেঁয়াজ ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
শান্তিনগরের ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আড়তে দাম চড়া, তাই আমাদেরও চড়া দামে সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা কম দামে কিনতে পারলে ক্রেতাদের কম দামে দিতে পারব।’
কচুক্ষেতে বাজার করতে আসা মাহবুব আলম বলেন, বাজারে এখন ডাকাতি হচ্ছে। রোজা উপলক্ষে গোটা মুসলিম বিশ্বে পণ্যের দাম কমে। আর আমাদের এখানে দ্বিগুণ হয়। যে লাউ গত সপ্তায় ৩০ টাকা দিয়ে কিনেছি, তা আজ ৭০ টাকায় কিনলাম। মূল্যবৃদ্ধির দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করলে এই নৈরাজ্য চলতে পারত না। একই বাজারের মাছ ব্যবসায়ী বাবুল মোল্লাও মূল্যবৃদ্ধির এই দায় দিলেন রাষ্ট্রকে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা চাইলেই সব করতে পারে না। সরকারের নজরদারি থাকলে অবশ্যই ব্যবসায়ীরা দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাধ্য। সব জায়গায়ই সিন্ডিকেট। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারে আনা পর্যন্ত সিন্ডিকেটের হাত থাকে। রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি। অথচ সব দায় এসে পড়ে আমাদের ওপর। সরকার সবই জানার কথা।’
উল্লেখ্য, চাহিদার তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অনেক বেশি মজুদ থাকায় রমজানে পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলে দাবি করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কোনো পণ্যের সংকট বা সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না বলেও জানানো হয়।
গত রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি, মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক সভা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
সভায় তিনি বলেন, চিনি ও পেঁয়াজ ছাড়া সব পণ্যের বাজারদর স্বাভাবিক রয়েছে। তবে কোনো ব্যবসায়ী যদি পণ্য মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এএসএস/জেডএ/পিআর