'এক লেনের রাস্তায় এক বাস আরেক বাসকে ওভারটেক করার জন্য রেষারেষি করে যাত্রাবাড়ী থেকে সায়দাবাদ মোড় পর্যন্ত আসছিল। এ সময় ডান পাশ দিয়ে যাওয়া এক মোটরসাইকেল আরোহীকে এক প্রকারের ইচ্ছাকৃতভাবেই যেন ধাক্কাটা দিলো একটি বাস। এতেও যদি ক্ষান্ত হতো ঘাতক চালক তাতেও মনকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু চোখের সামনে এরপর যা ঘটলো তা সারাজীবনের আতঙ্ক হয়ে থাকবে আমার কাছে..! '
Advertisement
কথাগুলো বলতেই আতঙ্কে কপাল দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছিল রাসেল মাহমুদ নামে প্রত্যক্ষদর্শী এক যুবকের। ঠিক যেন সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি চোখের সামনেই তাড়া করে ফিরছে তাকে।
আজ সকাল পৌনে ৯টায় রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপনী কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দিন (৩৮)। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রাসেল মাহমুদ। সে বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজেই আঁতকে উঠছেন বারবার।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, আমিও ওই (নিহত নাজিম) ভাইয়ের পেছনে আরেকটি মোটরসাইকেলে করে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলাম। তিনি আমার সামনে ছিলেন। এক লেনের রাস্তা হওয়ায় তাকে ওভারটেক করা সম্ভব নয় বলে আমি আর ওভারটেকের চেষ্টা করিনি। কিন্তু ফ্লাইওভারে উঠার পর দেখতে পাই যাত্রাবাড়ী থেকে দুটি বাস রেষারেষি করে চলছে। ওই ভাই (নাজিম উদ্দিন) ফ্লাইওভারের ডান পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় বাসগুলো একবার ডান, একবার বাম দিকে যাচ্ছিল। তাই তিনি বারবার বাসগুলোকে হর্ন দিয়ে সতর্ক করছিলেন। মাঝে মাঝে আমিও হর্ন দিচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর সায়েদাবাদের জনপদ মোড় বরাবর প্রায় ১০০ গজ আগে বাম পাশে থাকা বাসটি উনার বাইককে ধাক্কা দেয়। তিনি বাইক থেকে রাস্তায় পড়ে যান। আমি দ্রুত আমার বাইক থেকে নেমে উনাকে তুলতে যাওয়ার আগেই ওই বাসের চালক তার ওপর পেছনের দুটি চাকা তুলে দেয়।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। এত জোরে চিৎকার দিলাম তবুও মনে হলো কেউ শুনেনি। আমার চোখের সামনে এখনও সেই দৃশ্যটা যেন ভাসছে। চালক তাকে ধাক্কা দেয়ার পর যদি গাড়িটি থামাতো তাহলে ভাইটা প্রাণে বেঁচে যেত। কিন্তু ঘাতক চালক গাড়ি তো থামালোই না উল্টো গলার ওপর চাকা তুলে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। পরে আরও কয়েকজন পথচারীর সহযোগিতায় নিজাম ভাইকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। এখানে আনার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
এমন ঘটনা দেখে তিনি বারবার সংবাদকর্মীদেরকে বলছেন, এটা দুর্ঘটনা নয় হত্যা। এমন হত্যা কোনোভাবেই যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া পার না পায় সেজন্য সংবাদকর্মীদের ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেন তিনি।
অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী আলি নেওয়াজ বলেন, ‘এমন ঘটনার পর বাসটি পালিয়ে যেতে চেয়েছিল তবে আমরা সেটিকে আটক করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।
এদিকে, নিজামের মৃত্যুর খবর শুনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ছুটে আসেন স্বজন ও সহকর্মীরা। এমন দুর্ঘটনায় সবার অশ্রুজলে পুরো ঢামেক যেন শোকার্ত হয়ে পড়ে। সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা সংবাদকর্মীরাও শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন।
Advertisement
নিহতের ভাগ্নে মো. শাহীন জানান, নিজামের গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহন উপজেলার কালমা ইউপির বালুচরে। বাবার নাম আনিসুল হক। তারা তিন ভাই, পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে সবার বড় ছিল নিজাম। তিনদিন আগে রাজধানীর আদ দ্বীন হাসপাতালে রাইসা আক্তার নামে তার একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। এছাড়া মুনমুন নামে আট বছরের আরও একটি কন্যা রয়েছে। তার স্ত্রী এখনও আদ দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
জামাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে ঢামেকে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিজামের শ্বশুর আরিফ। তিনি বলেন, ‘আমার দুইটা মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। সে (নিজাম) আমাকে বলতো আপনার ছেলে নাই তো কি হয়েছে? আমি আছি না। আমিও তাকে পেয়ে নিজের ছেলে মনে করে গর্ব করতাম। আমার পারিবারিক সব সমস্যা সে একাই সমাধান করতো। এখন আমার সব শেষ। আমার মেয়ে, তিনদিন বয়সী নাতনির ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেলে।
এসএইচ/এমএমজেড/পিআর