বিনা ঘোষণায় নিষ্ক্রিয়ের পৌণে দুই বছর পর আবার সক্রিয় হবার ঘোষণা দিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। নিষ্ক্রিয় হবার কোনো ঘোষণা তখন তিনি দেননি। কেন, কোন কারণে নিষ্ক্রিয় হয়েছিলেন? এ নিষ্ক্রিয়তা নিজ থেকে না কারো পরামর্শের কারণে?- সেই প্রশ্নের ফয়সালাও দেননি। দল থেকেও কিছু বলা হয়নি। এখন নিজ থেকে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ঘোষণার পরও দল থেকে কোনো ভাষ্য আসেনি। তবে, তাকে সক্রিয় করার পেছনে প্রধানমন্ত্রী, দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ইশারা রয়েছে বলে প্রচার রয়েছে দলের অভ্যন্তরে। কিছু একটা আঁচ করে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কেউ কেউ তার বাসায় যাতায়াত শুরু করেছেন।
Advertisement
গত ৬ মে সচিবালয়ের পাশে যানবাহন মেরামত কারখানার জমিতে বহুতল কার পার্কিং কাম মাল্টিপারপাস ভবনের নির্মাণ কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনেকটা আকস্মিক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দেন সৈয়দ আশরাফ। আওয়ামী লীগের সধারণ সম্পাদক পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা সৈয়দ আশরাফ বলেন, আমি অনেক দিন মাঠে ছিলাম না। এই যে আজ এসেছি, এখন থেকে আবার রাজনীতি শুরু করবো।
তার কয়েক শব্দের দুই বাক্য রাজনীতির মাঠে নতুন খোরাকের জন্ম দিয়েছে। সেইসঙ্গে প্রশ্নও কম নয়। তিনি একদিকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। আরেকদিকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের শীর্ষ সদস্য। বরাবরের মতো নিয়মিত দলীয় সভা-সমাবেশে যোগ দেন। আগের মতোই মন্ত্রণালয় চালান। সেই হিসেবে তাকে মোটেই নিষ্ক্রিয় বলা যায় না। তিনি যখন দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তখনও তার কাজের ধারা ও ধরন এ রকমই ছিল। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একেবারে উল্টা বৈশিষ্ট্য তার।
জাতীয় চার নেতার একজন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ আপাদমস্তক রাজনীতিক। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত তিনি। প্রবাসে ছিলেন দীর্ঘদিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দল ও সরকারের ভেতর-বাইরের যারা তাকে চেনেন, তারা জানেন তার বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা। চলন-বলন থেকে শুরু করে কথা-কাজসহ অনেক কিছুতেই স্বতন্ত্র তিনি।
Advertisement
এ নিয়ে প্রশংসার সঙ্গে সমালোচনাও রয়েছে। কারো কারো মতে, আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ দলের সাধারণ সম্পাদক এমন ভারি লোকই হওয়া উচিৎ। কেন একজন সাধারণ সম্পাদক মাঠে-ঘাটে নাটকীয় কাজে ব্যস্ত হবেন? কেন বলবেন হালকা মেঠো কথাবার্তা? এর বিপরীতে কেউ কেউ ভাবেন, কর্মীনির্ভর দলের সাধারণ সম্পাদক মাঠে-ঘাটেই থাকবেন। কর্মী, সমর্থকদের মনমর্জি মতো ঘুরবেন। কথা বলবেন।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্যে চলে যান। বিলাতে দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে ৯৫ সালের দিকে দেশে ফেরেন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আরও চারবার তিনি একই আসনে জেতেন। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আশরাফ তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দেন। তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলকে নিষ্ক্রিয় করে আশরাফকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো নিয়ে তখন অনেক কথা হয়েছে।
সংস্কারপন্থীদের বিপরীতে তিনি ভিন্ন অবস্থা তৈরি করেন অল্প সময়ের মধ্যে। বলা হয়ে থাকে যাঁদের কারণে আওয়ামী লীগ অনিবার্য ভাঙন থেকে সে সময় রক্ষা পেয়েছিল, সৈয়দ আশরাফ তাঁদের অন্যতম। কিছু প্রশ্ন ও ঘটনার প্রেক্ষিতে তার কিছু মন্তব্য এখনো অনেকের স্মরণে থাকার কথা। যেমন: আমার শরীরে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের রক্ত। এই রক্ত কখনও বেইমানী করে না। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিয়েছেন, আমিও প্রয়োজনে শেখ হাসিনার জন্য জীবন দেবো।’
ওয়ান ইলেভেন সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া ও আওয়ামী লীগকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী করার পেছনে তার বিশেষ হিম্মত বহুল আলোচিত বিষয়। পরে ২০০৯ সালে দলের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এর পরের সম্মেলনেও তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) মন্ত্রী করা হয় তাকে। কিন্তু ২০১৫ সালের ৯ জুলাই আকস্মিকভাবে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে অব্যাহতি দিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। আর এলজিআরডি মন্ত্রী করা হয় ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে। এর কিছুদিন পর তাকে দেয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
Advertisement
সরকার, দল এবং প্রশাসনসহ কোনো সেক্টরে ক্রাইসিসের সময় তিনি হঠাৎ অ্যাকটিভ হয়েছেন। ফলও ঘরে তুলেছেন। রাজধানীতে ১৩ সালের ৫ মে হেফাজত দমন, ১৪’র ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে-পরে পরিস্থিতি মোকাবেলা, আমলাদের অসন্তোষ সামলানোসহ কিছু ঘটনায় তিনি ম্যাজিক দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী হিসেবে কাজ করে অনেক চ্যালেঞ্জ উতরে দিয়েছেন। নির্বাচনপরবর্তী পরিস্থিতিতেও ছিল মোক্ষম ভূমিকা। একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা সরকারের পক্ষে দেশি-বিদেশি সমর্থন জোগাড়ে ছিল তার ক্যারিশমা। শোনা যায়, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মুখ না খুললেও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তার কিছু হোমওয়ার্ক রয়েছে। দেশি-বিদেশি বিশেষ বিশেষ মহলে ঘনিষ্টতা রক্ষা করছেন যথারীতি। যার সুফল কাজে লাগানোর পর্ব দেখা যেতে পারে শিগগিরই।
বৈশিষ্ঠ্যগত নীরবতার মধ্যে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলের পর তিনি আরো নীরব হয়ে যান। ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর দলের সব শেষ জাতীয় সম্মেলনে আশরাফের বদলে ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এরপর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয় আশরাফকে। এরপর আশরাফের একটি বড় সময় কেটেছে যুক্তরাজ্যে তার অসুস্থ স্ত্রীর পাশে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর আশরাফের স্ত্রী শিলা ইসলাম লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন আশরাফ।
মাঝে মাঝে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অনুপস্থিত থেকেছেন। গণভবনেও যাতায়াতও কমিয়ে দেন। এ নিয়ে কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের বলেছেন, আশরাফের ব্যাপারে মাথা না ঘামাতে। বলা হয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রী তার মেজাজ-মর্জি বোঝেন।
বরাবরের মতো তিনি এখনো এড়িয়ে চলেন মিডিয়াকে। গণমাধ্যমেও তাকে নিয়ে সংবাদ বলতে গেলে থেমেই যায়। মাঝে শিরোনাম হন তার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে। তখন এক খবরে বলা হয়েছিল, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সৈয়দ আশরাফ ঢাকায় নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। খবরটি বেশ আবেগ ও আবেদন তৈরি করে। আরেক খবরে বলা হয়েছে, তার বাড়িই ছিল না যে তিনি বিক্রি করবেন। বহুদিন পর মিডিয়ায় তিনি সর্বশেষ তাজা শিরোনাম হয়ে এলেন ৬ মে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হবার ঘোষণা দিয়ে। এর আগে, গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগে-পরে দলের কিছু কর্মসূচিতে তাকে দেখা গেছে।
মন্ত্রণালয়ে যাওয়াও বাড়িয়েছেন। ঘুম থেকে উঠছেন তুলনামুলক সকাল সকাল। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় এমন কি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। ফোনও করছেন। যা সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়ও করেননি। তার রাজনীতিতে সময় কম দেয়া, কর্মীদের দেখা-সাক্ষাতে কার্পণ্য, মন্ত্রণালয়ে অনিয়মিত থাকা নিয়ে তখন নানা নেতিবাচক কথা ছিল।
সৈয়দ আশরাফের ফের সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা কারো কারো জন্য বিশেষ বার্তা কি-না, এ নিয়ে হাইপ্রোফাইল আলোচনা বোদ্ধা মহলে। দলের সাধারণ সম্পাদক না থাকলেও কিছু কিছু প্রশ্নে হার্ডকোরে তাঁকে নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়নি। নানা ঘটনায় তার আবশ্যকতা বোধ করছেন কেউ কেউ। এর মাঝে তিনি নিজেই এখন আবার সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দিলেন।
এ ঘোষণা নিজ থেকে না কোনো মহল থেকে দেওয়ানো হয়েছে, এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহলে জোর আলোচনা। তিনি সক্রিয় হয়ে কী করবেন বা কী করতে পারেন- এ বিশ্লেষণও রয়েছে। রাজনীতিতে আশরাফুল ইসলামের ফের সক্রিয় হওয়ায় কাদের লাভ আর কাদের ক্ষতি? উনি নিষ্ক্রিয় থাকলে বা তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে রাখলে কার কী যায় আসে?
দলে বা সরকারে নতুন করে তার কি কোনো আবশ্যকতা তৈরি হয়েছে? অবশ্য জবাবও কম-বেশি কারো কারো জানা। সবমিলিয়ে লাইফস্টাইলের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সততায় সহকর্মীদের বেশিরভাগের সঙ্গে তিনি বেমানান। সেই বিবেচনায় এক অস্থির সময়ে এলো সৈয়দ আশরাফের আবার সক্রিয় হওয়ার ঘোষণাটি। এর রহস্যভেদ হওয়া ততো সময়সাপেক্ষ না-ও হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/আরআইপি