ফুটবল মানেই ব্রাজিল আর ছন্দময় ফুটবলের আহ্বান! সাম্বার সৌন্দর্য আর ‘জোগো বোনিতো’য় মুগ্ধ তখন পুরো ফুটবল বিশ্ব। ছন্দময় ফুটবল তো ব্রাজিলকে ছাড়া কল্পনা করারও উপায় নেই। ব্রাজিলিয়ানদের রক্তে মিশে আছে ফুটবল। ফুটবলই তাদের জীবন। তারা জন্ম নেয় ফুটবল দেখতে দেখতে। এ কারণেই বিশ্বসেরা ফুটবলাররা উঠে আসে ব্রাজিলের ‘পাভেলা’গুলো (বস্তি) কিংবা রাস্তা থেকে।
Advertisement
অথচ, এই ব্রাজিলকেই বিশ্বকাপের স্বাদ গ্রহণ করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৮টি বছর। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের লড়াই শুরুর হওয়ার পর ১৯৫৮ সালে এসে এসে প্রথম শিরোপার স্বাদ পেল ব্রাজিল। যদিও ১৯৫০ বিশ্বকাপে নিজ দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল সেলেসাওরা; কিন্তু মারাকানার সেই বিখ্যাত ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হেরে শিরোপা তো জেতা হয়নি, উল্টো দুঃখজনক এক অধ্যায়ের সূচনা হয় ওইদিন। রচিত হয়, মারাকানাজ্জো নামক ট্র্যাজেডির। যেখানে অর্ধশতেরও বেশি ফুটবল সমর্থক আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
১৯৫০ সালে যখন মারাকানায় সেই বিয়োগান্ত অধ্যায়ের জন্ম নিচ্ছিল, তখন এডসন আরান্তেস দো নসিমেন্তো নামের এক বালকের বয়স ছিল ৯ পেরিয়ে ১০ বছর ছুঁইছুঁই। ১৯৫৮ সালে সুইডেন বিশ্বকাপে যখন ব্রাজিল খেলতে গিয়েছিল, তখন সেই বালকটির বয়স পেরিয়েছে ১৭ বছর। তাও বিশ্বকাপের শুরুটা হয়েছিল তার ইনজুরিতে থাকা অবস্থায় এবং বিশ্বকাপের প্রথম দুটি ম্যাচ তো খেলতেই পারেননি। মাঠে নেমেছেন গ্রুপ পর্বের তৃতীয় এবং শেষ ম্যাচে।
সেই তরুণ ফুটবলারটির সংক্ষিপ্ত নাম পেলে। ফুটবল ইতিহাসে যাকে সর্বকালের সেরা বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৯ সালে যাকে দ্য গ্রেটেস্ট প্লেয়ার অব দ্য সেঞ্চুরি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেই পেলে যখন নিজেকে মেলে ধরলেন, তখন বিশ্বকাপ শিরোপা তো ব্রাজিলের পায়েই এসে লুটোপুটি খাওয়ার কথা, হলোও তাই। কালোমানিক পেলের অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্যে ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসরের শিরোপা প্রথমবারের মতো জয় করে নিল ব্রাজিল। এই বিশ্বকাপটা যেন ব্রাজিলের নয়, হয়ে রইল পেলের বিশ্বকাপ হিসেবে।
Advertisement
ব্রাজিলই প্রথম যারা নিজ মহাদেশের বাইরে থেকে প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে নিতে পারলো। একই সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয়ে গেল ফুটবলের সেরা তারকা পেলের নাম। পেলের অসাধারণ শৈলী তো তখন থেকেই দেখতে শুরু করে ফুটবলবিশ্ব। যার পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্ব। পেলে জাদুতে শুধু ১৯৫৮ বিশ্বকাপই নয়, ব্রাজিল জিতে নিল ১৯৬২, ১৯৭০ বিশ্বকাপের শিরোপাও।
১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে ফেরেঞ্চ পুসকাস, স্যান্ডোর ককসিসদের হাঙ্গেরি দলটি আজও সর্বকালের অন্যতম সেরা দল হিসেবে পরিচিত। সোনালি যুগটা অবশ্য ওই বিশ্বকাপেই পার করে ফেলেছে হাঙ্গেরিয়ানরা। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির শ্রেষ্ঠত্বের বিদায় ঘটার পর, ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপে এসে শুরু হলো নতুন ছন্দময় ফুটবলের যাত্রা। পেলে, দিদি, ভাভা, গ্যারিঞ্চা, জাগালোদের নিয়ে গঠিত তখনকার ব্রাজিল দলকে ফুটবল ইতিহাসের সেরা বলেও স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করেনি কেউ।
১৯৪৫০ বিশ্বকাপে মারাকানাজ্জো ট্র্যাজেডির আগেই রিও ডি জেনিরোয় বসেছিল ফিফা কংগ্রেস। সেখানেই ১৯৫৮ বিশ্বকাপের জন্য সুইডেনকে বাছাই করে নেয়া হয়। বিশ্বকাপও রাখা হয় ১৬ দলের মধ্যে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি এবং স্বাগতিক সুইডেন সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে যায়। বাকি ১৪টি স্থান ভাগ করে দেয়া হয় মহাদেশগুলোর মধ্যে। ইউরোপের জন্য ৯টি, লাতিন আমেরিকার জন্য ৩টি, উত্তর আমেরিকার জন্য ১টি এবং এশিয়া ও আফ্রিকার জন্য ১টি।
১৯৫৮ সালেই প্রথমবারের মতো গ্রেট ব্রিটেনের চারটি দেশ- ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড একসঙ্গে অংশ নেয় বিশ্বকাপে। বাছাই পর্বে উত্তর আয়ারল্যান্ড ইতালিকে হারিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ঠাঁই করে নেয়। সেবারই প্রথম ইতালিকে চলে যেতে হলো বিশ্বকাপের বাইরে। ১৯৫৮ সালের পর এবারই (২০১৮) দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের বাইরে যেতে হলো ইতালিকে।
Advertisement
সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড। ১৯৩৪ সালের পর বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে আসে আর্জেন্টিনা। ওয়েলস প্লে-অফ ম্যাচ খেলে আসার কথা ছিল; কিন্তু তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া এবং সুদান ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে না নেয়ার কারণে বাছাই পর্বেই অংশ নেয়নি।
বাছাই পর্বের কোনো ম্যাচ না খেলেই ইসরায়েল প্লে-অফের জন্য বাছাই হয়; কিন্তু ফিফা সেবারই নিয়ম প্রবর্তন করে, প্লে অফ খেলতে হলে বাছাই পর্বে অন্তত একটি ম্যাচ হলেও খেলতে হবে। অথচ, ইসরায়েল বাছাই পর্বে কোনো ম্যাচই খেলার সুযোগ পায়নি। এ কারণে ইসরায়েলকে আর প্লে-অফ খেলার সুযোগ দেয়নি ফিফা। ফলে ওয়েলস বিশ্বকাপে ঠাঁই করে নেয় সরাসরি।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের মাত্র কিছুদিন আগে (৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৮) মিউনিখে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ডানকান এডওয়ার্ডসহ ইংল্যান্ড জাতীয় দলের তিন ফুটবলার। যে কারণে বিশ্বকাপে সেবার ইংল্যান্ড দল ছিল একেবারে দুর্বল। হাঙ্গেরির সোনালি প্রজন্মের বেশ কয়েকজন ফুটবলারও অবসর নেয়ায় দলটি তার জৌলুস হারিয়ে ফেলেছিল অনেকটা।
গ্রেট ব্রিটেনের একটি, পশ্চিম ইউরোপ থেকে একটি, পূর্ব ইউরোপ থেকে একটি এবং লাতিন আমেরিকা থেকে একটি দিয়ে চার গ্রুপের চার শীর্ষদল নির্বাচিত করা হয়। এরপর ১৬ দলকে ভাগ করে দেয়া হয় মোট ৪টি গ্রুপে। ১৯৫৪ সালের মতোই খেলার নিয়মগুলো প্রায় এক রাখা হয়। তবে, একটি নিয়ম পরিবর্তন করা হয়। সেটা হচ্ছে, গ্রুপপর্বে নির্ধারিত সময়ে ম্যাচ ড্র হলে আর অতিরিক্ত সময়ের খেলা হবে না। জয়-পরাজয় কিংবা ড্র যাই হোক, সেখানেই শেষ হবে ম্যাচ। জয়ী দল ২ এবং ড্র হলে দুই দলই ১টি করে পয়েন্ট পাবে।
যদি গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দলের পয়েন্ট সমান হয়ে যায় তাহলে গোল ব্যবধান বিবেচনায় আনা হবে। তাতেও সমাধান না হলে প্লে-অফ অনুষ্ঠিত হবে। প্লে-অফে ম্যাচ ড্র হলে মোট গোলের ব্যবধান কিংবা কতটা ম্যাচ ড্র হয়েছে সে হিসেবে বিজয়ী দল নির্ধারণ করা হবে। এসব নিয়মের মারপ্যাঁচের কারণে গ্রুপ পর্বে পয়েন্ট সমান হয়ে যাওয়ায় প্লে-অফ ম্যাচে ২-১ গোলে উত্তর আয়ারল্যান্ড চেকোস্লোভাকিয়াকে, ওয়েলসও ২-১ গোলে হাঙ্গেরিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১-০ গোলে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিদায় করে দেয়।
প্রথম পর্বে কোনো গোল পাননি পেলে। কারণ, ইনজুরির কারণে তিনি প্রথম দুই ম্যাচ খেলতেই পারেননি। মাঠে নেমেছিলেন গ্রুপের শেষ ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে ব্রাজিল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম গোলশূন্য ড্রয়ের ঘটনা।
পেলের বিশ্বকাপ হলেও ১৯৫৮ বিশ্বকাপটাকে প্রায় নিজের করে নিয়েছেন ফ্রান্সের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার জ্যাঁ ফন্তেঁ। ১৩টি গোল করেন তিনি। কোনো এক বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোলের রেকর্ডও গড়েন তিনি, যা এখনও পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি। দুটি হ্যাটট্রিকও করেন ফন্তেঁ।
তবে পেলের ক্যারিশমা দেখা যায় সেমিফাইনালে। ফন্তেঁর দল ফ্রান্সের বিপক্ষেই হ্যাটট্রিক করে বসেন তিনি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ট হ্যাটট্রিক করা ফুটবলারের ইতিহাস তৈরি করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত স্টকহোমের ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল এবং স্বাগতিক সুইডেন।
ফাইনালের মতো হাইভোল্টেজ ম্যাচে ব্রাজিলের বিপক্ষে শুরুতেই (৪ মিনিট) লিইডোলমের গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিক সুইডেন; কিন্তু পেলের মতো ফুটবলার যখন কোনো দলে থাকেন, তাদের যেকোনো সময় ম্যাচে ফিরে আসা অসম্ভব কিছু নয়। পেলে করলেন ২ গোল। দুর্দান্ত এক ভলিতে ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে সুইডেনের জালে বল জড়িয়ে দেন পেলে। যেটাকে এখনও ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোলের স্বীকৃতি দেয়া হয়।
ব্রাজিলের হয়ে পঞ্চম গোলটি যখন করলেন পেলে, সেটা দেখে মুগ্ধ সুইডিশ খেলোয়াড় সিগভার্ট পার্লিং মন্তব্য করেছিলেন, ‘যখন পেলে ম্যাচের পঞ্চম গোলটি করলেন, সত্যি বলছি সেটা দেখে আমার নিজেরই করতালি দিতে ইচ্ছে করেছিল।’
২ গোল করেছেন আরেক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ভাভা। এক গোল করেন জাগালো। শেষ পর্যন্ত ৫-২ ব্যবধানে স্বাগতিক সুইডেনকে হারিয়ে দিল ১৭ বছর বয়সী পেলের ব্রাজিল। বিশ্বকাপের শিরোপাটাও প্রথমবারের মতো গেল সেলেসাওদের ঘরে। জ্যাঁ ফন্তেঁর ১৩টির পর পেলে এবং জার্মানির হেলমুট রান করেন ৬টি করে গোল।
আইএইচএস/বিএ