শেয়ারবাজারের আতঙ্ক ব্যাকিং খাতে চলে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
Advertisement
বৃহস্পতিবার বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দেশের আর্থিক খাত নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার ৯ বছরে দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখে পড়েছে। সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব, দুর্নীতি, লুটপাট আর বিশৃংখলা সব মিলিয়ে নৈরাজ্যকর অবস্থায় রয়েছে ব্যাংকিং খাত। ঋণের নামে ও বিভিন্ন কারসাজি করে গ্রাহকের প্রায় দুই লাখ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে আওয়ামী নেতাকর্মী, সমর্থক ও আওয়ামী মদদপুষ্ট গোষ্ঠী। ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যাংক সেক্টর। দেশের একটি স্বনামধন্য গবেষণা সংস্থা ২০১৭ সালে ব্যাংকিং সেক্টরের সার্বিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরে ২০১৭ সালকে ‘ব্যাংক কেলেংকারির বছর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বর্তমানে ব্যাংক তীব্র তারল্য সংকটে জর্জরিত। ধার-দেনা করে চলছে বেশিরভাগ ব্যাংক। লাইন ধরে আমানতের টাকা ফেরত নিতে চাইলেও সময়মত টাকা পাচ্ছে না আমানতকারীরা। তহবিলের অভাবে চেক বাউন্স হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদনপ্রাপ্ত ঋণও ফেরত নেয়া হচ্ছে। অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়ে উঠছে। প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায় কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ব্যাংকের মালিকানা জোর করে বদল হচ্ছে।
Advertisement
স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংক খারাপ অবস্থায় পড়েছে। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই ব্যাংক থেকে আমানত সরিয়ে নিতে চাইছে। ফলে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ আতঙ্ক আগে শেয়ার বাজারে ছিল, এখন ব্যাংকে চলে আসছে। অথচ অর্থমন্ত্রী পরিস্থিতি গুরুতর নয় বলে দাবি করছেন। অর্থনীতির অবস্থা আর কত তলানিতে নামলে সরকারের কাছে 'গুরুতর' বিবেচিত হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
তিনি আরও বলেন, আতংকের শুরুটা বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক কেলেংকারির ঘটনা থেকে শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক কেলেঙ্কারির শুরু হয় ২০০৯ সালে হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে। হলমার্কের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের নাম জড়িত। এ ছাড়া বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১২০০০ কোটি টাকার বহুল আলোচিত ঋণ জালিয়াতির কথা সবাই জানে।
২০১৬ সালের ২৭ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে শিরোনাম ছিল ‘সাত বছরে আত্মসাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকা’। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ ও ডেসটিনির কেলেঙ্কারিসহ ছয়টি বড় অর্থ কেলেঙ্কারির বিস্তারিত সবার জানা আছে। এছাড়া রয়েছে রূপালী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নেয়া প্রায় হাজার কোটি টাকা, যার ৮০১ কোটি টাকা আদায়ের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংক থেকে বহুতল ভবন নির্মাণের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘটনা। জনতা ব্যাংক সব নিয়মনীতি ভঙ্গ করে একক গ্রাহকের মালিকানাধীন এননটেক্স গ্রুপের ২২ প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছেন যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এটি একক ঋণের বৃহত্তম কেলেংকারি। ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ ব্যতিত কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে এত ঋণ পাওয়া সম্ভব নয়। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ আছে। দেয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ। রাজনৈতিক বিবেচনায় শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর ব্যাংকটি দেউলিয়াত্বের পর্যায়ে চলে যায়। ব্যাংকটি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে সংকটে পড়ে। এনআরবি ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকেও সীমাহীন অনিয়ম হচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৩ সালে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ফারমার্স ব্যাংক চালুর পর ব্যাংকটি আমানতকারী ও সরকারি খাত হতে জমাকৃত অর্থ অধিকাংশ আত্মসাৎ করেছে।
Advertisement
‘নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক ঋণ বিতরণে অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুটপাটে অতীতের যে কোনো ব্যাংক কেলেঙ্কারি-অনিয়মকে ছাড়িয়ে গেছে।’ বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে চার হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।’ এ ব্যাংকের কাছে পাওনা যে কেবল ব্যক্তিগত আমানতকারী বা প্রতিষ্ঠানের তা নয়, এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা রয়েছে। সুদসহ যা ৫১০ কোটিতে পৌঁছেছে’।
তার মানে, এ অর্থের মালিক দেশের সাধারণ জনগণ এবং ব্যাংকটি জনগণের এ টাকাও আত্মসাৎ করেছে। অথচ ব্যাংকটি বাঁচানোর জন্য সরকার সম্প্রতি জনগণের করের টাকায় প্রায় ১১০০ কোটি টাকা মূলধন পুনঃগঠনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য।
তিনি আরও বলেন, এ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৮০০ কোটি টাকা লুট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ডলার চুরির ঘটনায় ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা’ রয়েছে এবং ‘ব্যাংক ডাকাতির হোতারা ব্যাংকের ভিতরেই আছে’ বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই।
বাংলাদেশ সরকারের আশীর্বাদ না থাকলে ব্যাংক ডাকাতির হোতাদের ব্যাংকের অভ্যন্তরে থাকা সম্ভব নয়। চুরি যাওয়া অর্থের সামান্য অংশ ফেরত এলেও সিংহভাগই পাওয়ার সম্ভবনা নেই। চুরির পরপর ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় সরকারি কর্মতৎপরতা দেখা গেলেও এখন অবৈধ সরকার একেবারেই নির্লিপ্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লুটের বিষয়ে সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি কেন এখনও প্রকাশ করা হলো না তা আর রহস্যাবৃত নয়।
সংবাদ সম্মেলনে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ড. আব্দুল মঈন খান এবং আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
কেএইচ/এএইচ/জেআইএম