হঠাৎ থেকে যায় মাইকের আওয়াজ, জন কোলাহল ছেড়ে প্রার্থীরা চলে যাচ্ছেন বাড়িতে, কর্মীরা হয়ে গেলেন স্তব্ধ, চার দিকে কানাঘোষা, গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে বিভিন্ন জনের ফোন ‘নির্বাচন নাকি বন্ধ হয়ে গেছে’।
Advertisement
উৎসবের আমেজ মুহূর্তেই যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকা। রোববার গাজীপুর হাই কোর্টের নির্দেশে গাজীপুর সিটি নির্বাচন বন্ধ হয়ে গেলে এমন অবস্থারই অবতারণা ঘটে। ‘শোকের ছায়া’ বুধবারও প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের মাঝে অব্যাহত ছিল। এখন সবাই আপিল বিভাগের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
রোববার থেকে গাজীপুর মহানগরীতে এক প্রকার স্থবিরতা বিরাজ করছে। সর্বত্র শোকের আবহ বিরাজ করছে। নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রার্থী ও ভোটাররা। আকস্মিক যেন একটি ঝড় বয়ে যাওয়ার পর নিস্তব্ধ চারপাশ।
ক্লান্তিহীন ব্যস্ততা চলতে চলতে হঠাৎ থমকে গেছে সব কিছু। নির্বাচন বন্ধ হওয়ার পর আদৌ নির্বাচন হবে কিনা? এমনটা ভেবে মহিলা ও সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। প্রার্থীরা অনেক বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি নিয়েও চিন্তিত।
Advertisement
প্রার্থীদের অনেকেই জমানো টাকা খরচ করে, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের থেকে ধার-দেনা করে ঋণী হয়ে গেছেন। জয়ী হবেন এমন আশায় অনেকে নিজের মূল্যমান জিনিসপত্র ও জমি বিক্রি করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
নগরীর পাড়া-মহল্লা, অফিস আদালত ও চায়ের দোকনসহ বিভিন্ন অঙ্গনে চলছে একই আলোচনা। নগরীর সর্বত্র নীরবতা নেমে এসেছে। বিভিন্ন মোড়ে চায়ের দোকানগুলোতে ঝিম মেরে বসে আছেন অনেক মানুষ। চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে চোখেমুখে। হাসি নেই কারও মুখে। নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে খালি চেয়ার পড়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজা পোস্টারগুলো সুতায় ঝুলছে। কেন্দ্রগুলোতে নেই কোনো কর্মচাঞ্চল্য। তার পর নগরবারসী তাকিয়ে আছেন আদালতের দিকে।
নির্বাচন স্থগিতের বিষয়টি নিয়ে সিটির সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি স্থগিতাদেশ কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, আপিলে কী হবে- তা নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, কোনো স্থানে নেই প্রচারের আওয়াজ, নেই কর্মী বা প্রার্থীদের জনসংযোগ। পাড়া-মহল্লায় দলবেঁধে মানুষের ছোটাছুটি নেই। প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী বাসায় নেই মানুষের জটলা। দুইদিন আগেও যেসব নির্বাচনী প্রচারণার অফিসগুলোতে ছিলো লোকারণ্য সেখানে বইছে নীরবতা। তবে নির্বাচনী উৎসবের আমেজ ফিরে পেতে চায় সবাই।
Advertisement
৫৭টি ওয়ার্ডে ২৫৪ জন কাউন্সিলর, ৮৪ জন মহিলা কাউন্সিলর, ৭ জন মেয়র প্রার্থী মিলে সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।
নির্বাচন স্থগিত হওয়ার বিষয়ে গাজীপুর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মো. সোহরাব উদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও তারা নির্বাচনে পরীক্ষা দিতে ভয় পায়। তাই আদালতের একটি মীমাংসিত ইস্যু সামনে টেনে এনে নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়েছে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচন হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হওয়ায় মহানগরীর ৩৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন মন্ডল বলেন, নির্বাচনী প্রচারণা ভালোই চলছিল। ভোটগ্রহণের অপক্ষোয় দিন গুনছিলাম। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম ফসল ঘরে তোলার। সব দলের প্রার্থীরা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গেছেন। একটা উৎসবের আমেজ ছিল। নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এ নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অন্যান্য প্রার্থীদের মতই এরই মধ্যে আমার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। আর্থিক ও মানসিকভাবে আমি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
৭, ৮, ৯ (সংরক্ষিত ৩) মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী মিসেস শিরিন চালকলাদার বলেন, তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচনের দিন ধার্য করা হলো। সব নির্বাচনী কার্যক্রমও চলছিল ঠিকঠাক। বাজেটের ১০ আনা ব্যয় করা হয়ে গেছে। এ যেন তীরে এসে তরি ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন মানুষের মুখে হাসি নেই। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। সবাই এই নির্বাচনী উৎসব ফিরে পেতে চায়।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর জেলা সভাপতি মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একটা উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণ ভোটাররা অপেক্ষায় ছিলেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জয়ের মালা পরাবার। কিন্তু নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়াতে উৎসবে ভাটা পড়েছে। তাছাড়া গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের সহিংসতা না হওয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচনর সম্ভাবনা ছিল।
অপরদিকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ব্যস্ততা নেই। নির্বাচনের সব প্রস্তুতি তাদের নেয়া হয়েছিল। হঠাৎ থামিয়ে থেমে যেতে হয়েছে।
রিটার্নিং কর্মকর্তা যুগ্মসচিব রকিব উদ্দিন মন্ডল বলেন, আদালতের আদেশে নির্বাচনী কার্যক্রম স্থগিত করতে বলেছে নির্বাচন কমিশন। আমরা তাই করেছি। এখন কমিশনের পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় আছি।
বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, ১৫ মে তারিখে ভোটগ্রহণ সম্ভব নয়। তবে আদালত যদি ওইদিন নির্বাচন করতে বলে তাহলে আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হবে।
মো. আমিনুল ইসলাম/এএম/জেআইএম