ক্যাম্পাস

‘কে চায় বলো স্বামীর ভাত ছাইড়া দিবার’

‘পদ্মার চরে আব্বারা আমাগো নিয়ে থাকতো। যহন চরে ভাঙন শুরু হলো ঠিক ঠিকানা ছিল না বাড়ি ঘরের। বন্যায় ভাসায়ে নিয়ে যায় ওপারের জমি। তাই নদীর এপারে এসে একটা ঝুপড়ি ঘর বাইন্দা বসবাস শুরু করি। ৫ ভাই ও ৫ বোনের বড় সংসার। কখনও খাওয়া জুটতো, কখনও জুটতো না।’

Advertisement

কথাগুলো ষাটোর্ধ্ব নূরজাহান বেগমের। তা প্রায় পয়ষট্টি বছর আগের ঘটনা। চর ভাঙনেই দারিদ্রতা কড়া নেড়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করা এই নারীর দরজায়।

নূরজাহান বেগম জানাচ্ছিলেন, ‘জন্মই হয়েছে আমার ভাঙনের মধ্য দিয়ে। বাবা ভালো মতো পরিবারের ভরণ পোষণ দিতে পারতো না। অবশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চাকরিটা নতুন করে বাচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু প্রথমে চরের ভাঙন আর পরেরটা ঘরের ভাঙন দুই ভাঙন সামাল দিতেই শেষের পথে জীবন।’

এতটুকু বলতেই গলা ভারি হয়ে গেল তার। বললেন, ‘ওই সময়ে বয়স ১৪ বছর হবে আমার। ভরণ পোষণ দিতে পারতো না বলে বাবা মা আমারে বিয়ে করাই দিল। তবে যে বেডার সঙ্গে বিয়ে হলো সে বেডাই খালি মারধর করতো। কোনো কথা বলতে গেলেই মারধর করতো। একদিন মাইরা মাথাডা ফাটাই দিলো। ভাগ্যে জুটেনি স্বামীর সংসার।’

Advertisement

‘এদিকে স্বামীর ওই সংসারেই জন্ম নিল ৩ ছেলে ও একটা মেয়ে। এর মধ্যেই নতুন একটা বিয়ে করে ফেলল স্বামী। অত্যাচার দিন দিন বাড়ছিল। সংসারের অশান্তিও চরমে। এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাল যে শেষ পর্যন্ত আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলাম না’ বললেন তিনি।

‘দেখলাম এর সঙ্গে থাকলে আমার আর চলবে না। তাই স্থানীয়দের শালিসে ডিভোর্স দিলেন স্বামীকে। বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়েই বললেন, কে চায় বলো স্বামীর ভাত ছাইড়া দিবার?

আজ থেকে তা প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। সেই বার দ্বিতীয় ভাঙনের মুখে পড়েছিলেন তিনি। থাকার মতো জায়গা বা কোনো ঘরও না থাকায় বাবার বাড়িতে এসে উঠতে বাধ্য হলেন। বেঁচে থাকার আশায় আশে পাশের মেসগুলোতে রান্না বান্নার কাজ করতে থাকেন। পরের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কাজ করা শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কাজ করতেন।

এভাবে কেটে গেল আরও ৭ থেকে ৮ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টাররোলে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী। দিনে ৫০ টাকা আর মাসে কখনও ৭০০ টাকা কখনও ৮০০ টাকা বেতন দেয়া হতো তাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেও যখন শরীর ক্লান্ত তখনও মেসে যাইতে হতো রান্না করতে। মেসের ছাত্ররা মাথাপ্রতি মাসে ১০ টাকা দিতো। পাড়া-পড়শি যা সাহায্য করতো আর মেসে রান্না করে যে দুই দশ টাকা পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতে চেষ্টা করতেন তিনি। জানালেন ‘সন্তানগুলোর মুখেও মাঝে মধ্যে খাবার দিতে পারতাম না।’

Advertisement

সেই দুঃখ বেদনা নিয়ে চলতে থাকা এই নারীর তখনও স্বপ্ন ছিল তিন ছেলে ও একটা মেয়েকে শিক্ষিত করার। তবে অর্থকষ্টে বাস্তবে রুপ নেয়নি সেই স্বপ্ন। সন্তানদের অবস্থা সম্পর্কে জানান ‘শিক্ষিত হতে পারেনাই একটাও। ছোট বেটাডারে একটা স্কুলে ভর্তি করাইছিলাম তবে ৩ ক্লাস পর্যন্ত পড়েই পয়সার অভাব। তাই আর পড়তে দেই নাই। পরিচিত এক মিস্ত্রির কাছে দিছিলাম তহন থেকে। সেইখানে কাজ শিখছে। এখন একটা ফানির্চারের দোকান দিছে। আর বড় বেটাডা গান করে। মেজোডা শহরে রিকশা চালায়। মেয়েডার পোড়া কপালে দুঃখের শেষ নাই। বিয়ে করা বউ আর ছোট একটা মেয়ে রেখে জামাই পলাইছে। তাও প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর আগে।

এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার রোলের চাকরিটা স্থায়ী হয় তার। যার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, সৃষ্টিকর্তা ভিসির মাধ্যমে চাকরিটা দিয়েছিলেন বলেই হয়তো এখনও মেয়েকে নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি।

এক যুগ পেরিয়েছে নূরজাহান বেগমের চাকুরি স্থায়ী হওয়ার। এখন কাজ অনেকটা কমে গেছে। তার রুটিন মাফিক কাজের মধ্যে রাস্তা ঝাড় দেয়া, বেসিন পরিষ্কার করা, ঝুল ঝাড়ার কাজ করতে হয় তাকে। তবে বড় ধরনের একটা অপারেশন করা শরীর নিয়ে প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে হাজির হতে কষ্ট হয় বলে জানান তিনি।

জানালেন, এই বয়সেও বিধবা সেই মেয়ে ও তার সন্তানকে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয় আমার। তবে ঝাড় দেয়ার এই কাজটা না পারলে কেউ তাকে ভাত দিতো না বলে দাবি করেন তিনি।

নিজেও পড়ালেখা করার সুযোগ হয়নি কখনও। বললেন, খাবার জুটতো না আর পড়ালেখা। তবে এখন আকাশ ছোয়া স্বপ্ন দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কিছু টাকা লোন নিয়ে একটু মাটি (জমি) কিনেছেন। তার ভাষ্য আমার তো জীবন শেষ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রভিসির বাড়িতে কাজ করতাম। মেসে মেসে রান্নার কাজ করে সময় কাটতো। বাড়ি ঘর ছিল না। থাকার জায়গা ছিল না। এখন ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের জন্য কিছু করে যেতে চাই।

নিজের ছেলে সন্তানদের শিক্ষিত করতে না পারার বেদনাটা ছেলে সন্তানদের ঔরসে জন্ম নেয়া নাতি নাতনিগুলাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার মাধ্যমে লাঘব করতে চান তিনি।

সকলের উদ্দেশ্যে একটা কথায় বলেন, লেখাপড়া ছাড়া কোনো গতি নাই। যারা সত্যিকারের লেখাপড়া করে তাদের কদর আছে। এছাড়া নারীর প্রতি বৈষম্যহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখেন তিনি।

এমএএস/জেআইএম