প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি তখনও পৃথিবী। এরই মধ্যে ইউরোপজুড়ে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। ফ্রান্সের সঙ্গে ক্রমাগত জার্মানির সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। জার্মান একনায়ক, নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারের তখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন ফ্যাসিবাদের জনক, ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি।
Advertisement
এ দুই শক্তির সম্মিলিত রাঙানো চোখের নিচে থেকে যখন ইউরোপজুড়ে প্রতিনিয়ত শঙ্কা, ‘যে কোনো সময় বেজে উঠতে পারে যুদ্ধের দামামা’, তখনই ফিফা আয়োজন করে ফেলল তৃতীয় বিশ্বকাপ। ওই সময় ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নিল আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি। ১৯ জুন অনুষ্ঠিত ফাইনালে ইতালি ৪-২ গোলে হাঙ্গেরিকে হারিয়ে দেয় ভিত্তোরিও পোজ্জোর শীর্ষরা। টানা দুটি বিশ্বকাপ জিতলো ইতালি বিখ্যাত এই কোচের অধীনে এবং কোনো কোচের টানা দুটি বিশ্বকাপ জয়েরও একমাত্র রেকর্ড হয়ে থাকলো সেটা।
১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপের মতো ১৯৩৮ সালের তৃতীয় বিশ্বকাপের শুরুতেও বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৩৬ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত ফিফার এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ফিফার জন্মস্থান ফ্রান্সে বিশ্বকাপ আয়োজনের। ১৯৩৪ বিশ্বকাপ এবং ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ফিফা চেয়েছিল, পরের বিশ্বকাপটা নিরাপদে আয়োজন করার। এ কারণে, তারা বেছে নেয় ফ্রান্সকে। জার্মানি এবং আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় ফরাসিরা। তবে টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপে বিশ্বকাপ আয়োজন মেনে নিতে পারেনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলো।
কিন্তু এতে ক্ষেপে যায় আর্জেন্টিনা। আয়োজক হতে না পেরে বিশ্বকাপেই অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে তারা। দ্বিতীয় বিশ্বকাপের মতো তৃতীয় বিশ্বকাপেও ক্ষোভ প্রকাশ করে উরুগুয়ে ছিল অনুপস্থিত। স্পেনজুড়ে আগেই শুরুই হয়ে গিয়েছিল গৃহযুদ্ধ। সুতরাং, ওই বিশ্বকাপে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হয় স্পেনকে।
Advertisement
হিটলারের চাপে বাছাইপর্ব থেকে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পরও নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় অস্ট্রিয়া। মূলতঃ বিশ্বকাপের ঠিক আগেই অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সঙ্গে একীভুত করে নেন হিটলার এবং এক জার্মানি হয়ে বিশ্বকাপে খেলার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ফলে নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ার অধিকাংশ ফুটবলারকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয় জার্মান দলে। তবে স্বাধীনতা হারানোর কারণে দারুণ প্রতিবাদী ছিলেন অস্ট্রিয়ার তারকা ফুটবলার ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার এবং জার্মানির হয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। লাটভিয়া অস্ট্রিয়ার গ্রুপ থেকে রানারআপ হলেও তাদেরকে বিশ্বকাপে খেলার জন্য অনুমতি দেয়া হয়নি। যার ফলে অস্ট্রিয়ার জায়গাটা ফাঁকাই থাকে।
১৯৩৮ বিশ্বকাপ থেকেই স্বাগতিক এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার নিয়ম চালু করা হয়। যে নিয়ম প্রযোজ্য ছিল ২০০৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। যে দল চ্যাম্পিয়ন হবে তারা এবং স্বাগতিকরা সরাসরি পরের বিশ্বকাপে খেলবে। ২০০৬ বিশ্বকাপের পর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সরাসরি খেলার নিয়ম বাতিল করে দেয়া হয়। শুধুমাত্র স্বাগতিকদেরই বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার নিয়ম চালু রাখা হয়। খেলার নিয়ম ছিল নির্ধারিত ৯০ মিনিটে জয়-পরাজয় নির্ধারণ না হলে খেলা গড়াবে অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। তাতেও যদি নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে সেই ম্যাচ আবারও অনুষ্ঠিত হবে। এই নিয়মে ৫টি ম্যাচ গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে। দুটি ম্যাচ পুনরায় আয়োজন করতে হয়েছিল।
স্বাগতিক ফ্রান্স এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালিছাড়া বাকি ১৪টি জায়গা পূরণের জন্য অঞ্চল ভাগ করা হয়। ইউরোপ থেকে ১১টি, আমেরিকা থেকে ২টি এবং এশিয়া থেকে একটি। সে হিসেবে আমেরিকা থেকে কেবল ব্রাজিল আর কিউবা এবং এশিয়া থেকে অংশ নেয় ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া। এশিয়া থেকে এই প্রথম কোনো দেশ অংশ নিলো বিশ্বকাপে।
বর্তমান ইন্দোনেশিয়া ওই সময় নেদারল্যান্ডসের উপনিবেশে থাকায় আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশটি অংশ নেয় ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ নামে। কিউবাও বিশ্বকাপে সেবার প্রথম অংশ নেয়। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে ইন্দোনেশিয়া কিংবা ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ ও কিউবার অংশগ্রহণ ওই একবারই। এরপর তার আর কখনও বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি।
Advertisement
দ্বিতীয় বিশ্বকাপের মতো ১৯৩৮ সালের তৃতীয় বিশ্বকাপও অনুষ্ঠিত হয় নকআউট পদ্ধতিতে। অস্ট্রিয়া নাম প্রত্যাহার করায় দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫টিতে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, কিউবা এবং ব্রাজিলকে শীর্ষ দেশ ধরে ৭টি গ্রুপ বানানো হয়। অস্ট্রিয়া না থাকায় সুইডেন সরাসরি খেলে কোয়ার্টার ফাইনাল। কিউবা ৩২ বছরের জন্য বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দেয় রোমানিয়াকে। তারা ১৯৭০ সালের আগে বিশ্বকাপে আর তারা খেলতে পারেনি।
প্রথম রাউন্ড থেকে ফ্রান্স, ইতালি, ব্রাজিল, চেকোস্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সুইডেন এবং কিউবা ঠাঁই করে নেয় কোয়ার্টার ফাইনালে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে হাঙ্গেরি, সুইডেন, ইতালি এবং ব্রাজিল চলে যায় সেমিফাইনালে। সেমিতে ওঠার লড়াইয়ে কিউবাকে ৮-০ গোলে হারায় সুইডেন।
সেমিফাইনালে সুইডেনকে ৫-১ গোলে হাঙ্গেরি এবং ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় ইতালি। ফাইনালের আগে ইতালির ফুটবলাররা মুসোলিনির কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম বার্তা পেয়েছিল। যাতে লেখা ছিল, ‘হয় জেতো, নয় মরো’। এটাকে আবার ইতালিয়ানরা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেনি কখনও। তাদের কাছে এই বার্তা ছিল, শিরোপা জয়ের জন্য বড় এক উৎসাহ। তবে, সেই টেলিগ্রামের কোনো রেকর্ড কিন্তু রক্ষিত নেই। আদৌ তেমন কোনো টেলিগ্রাম ইতালি ফুটবল দলের কাছে এসেছিল কি না তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ। তখনকার ইতালি ফুটবলার পিয়েত্রো রাভা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘না না না, এমন কোনো টেলিগ্রাম আমাদের কাছে আসেনি। হ্যাঁ, একটা টেলিগ্রাম এসেছিল। সেখানে আমাদের জন্য শুভ কামনা জানানো হয়েছিল। তবে, হয় জেতো নয় মরো- এমন কোনো কথা লিখা ছিল না।’
প্যারিসের স্টেডে অলিম্পিক ডি কলম্বেসে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে। যেখানে হাঙ্গেরিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জিতে নেয় ইতালি। ফাইনালের পর হাঙ্গেরির গোলরক্ষক অ্যান্টাল অ্যাসজাবো বলেন, ‘আমিই মুসোলিনির কাছ থেকে ইতালি ফুটবলারদের মাথা বাঁচিয়ে দিয়েছি।’
কোয়ার্টার ফাইনালে কিউবার বিপক্ষে সুইডেনের টোরে কেলার এবং উইটারস্ট্রম দু’জনই হ্যাটট্রিক করেন। আরও একটি হ্যাটট্রিক করেন ব্রাজিলের লিওনিডাস। লিওনিডাস ছিলেন ওই বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জয়ী। সর্বাধিক ৭টি গোল করেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আর কোনো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ১৯৩৪ থেকে টানা ১৬ বছর শিরোপা ছিল ইতালির কাছে। বিশ্বকাপ শিরোপা টানা এতটা বছর এক দেশের কাছে থাকারও রেকর্ড এটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরোটা সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী থেকে বিশ্বকাপের ট্রফিকে বাঁচাতে ফিফার ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. অট্টোরিনো বারাজ্জি খাটের নিচে জুতার বাক্সের মধ্যে সেটি লুকিয়ে রাখেন।
আইএইচএস/এমএস