নির্বাচন নিয়ে যে কোনো ঘটনা ঘটবে তাতেই সরকার দোষী সাব্যস্ত হবে- এটাই স্বাভাবিক। এই যে, হাই কোর্টের রায়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত ঘোষিত হলো, তাতেও সরকারকেই সকলে দায়ী করছেন এবং সেটা যে অযৌক্তিক নয়, সেকথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
Advertisement
এই অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি সম্পূর্ণই এড়ানো যেতো, তফসিল ঘোষণার আগেই যদি যে সীমানা-সমস্যার কারণে নির্বাচন স্থগিত হলো সেটি সমাধান করা যেতো। কিন্তু এদেশে আগেভাগে চিন্তাভাবনা করে সমস্যার সমাধান হতে আমরা দেখিনি কোনোদিন, বরং একটি কাজ অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎই তুচ্ছ কোনো সমস্যা বের হয় এবং একটি হওয়া-কাজ নষ্ট হয়ে যায় সম্পূর্ণ ভাবে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও যখন ভোটাররা পুরোপুরি ভোট উৎসবে মত্ত হয়ে উঠেছেন ঠিক তখনই একটি পুরোনো মামলার রায়ে নির্বাচন স্থগিত করা হলো। যে গাজীপুর ছিল মিছিল, প্রচারণা আর পোস্টারের নগরী মাত্র ঘন্টা কয়েকর ব্যবধানে সেই শহরটি হয়ে গেলো সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ এবং আশাভঙ্গের শহর। সাধারণ মানুষও যে এই রায়ে খুশি নয়, তা বলাই বাহুল্য।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিগত বছর কয়েক ধরেই গাজীপুরে নির্বাচন করবেন বলে আমরা শুনে আসছিলাম এবং তিনি এ জন্য সেখানে ব্যাপক কাজও করেছেন বলে জানা যায়। অপরদিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এলাকায় ক্ষমতাবান এবং তারও জনসমর্থন বেশ জোরালো। দু’পক্ষের কেউই যে নির্বাচন স্থগিত হোক সেটা চাননি তা নির্বাচন স্থগিত হওয়ার দিন পর্যন্ত কেউ জানতে পারেননি। তারা জোরালো ভাবেই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে নির্বাচন স্থগিত হলো সে মুহূর্তেই সর্বত্র একথাই প্রচারিত হতে শুরু হলো যে, সরকারি দল নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা দেখে নির্বাচন স্থগিত করেছে।
Advertisement
এবং এ প্রশ্ন একেবারেই অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে যে, সরকার নয়, নির্বাচন স্থগিত করেছে আদালত এবং দেশের উচ্চ আদালতের রায়কে এভাবে বিতর্কিত করা যায় না। কিন্তু এদেশে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেতো মিছিল হয়েছে, বিচারককে উল্টো ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি জানানোও হয়েছে। আর বিচার বিভাগকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রমাণ করার এরকম বড় সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায় বলুন?
এর আগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল এক বিএনপি নেতার দায়ের করা সীমানা সংক্রান্ত রিটের কারণে। এবার গাজীপুরে বিচারক নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন এমন একজন চেয়ারম্যানের দায়ের করা রিটের কারণে। দু’টো ক্ষেত্রেই যদি কেউ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকে তাহলে সেটি আর কেউ নয়, দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আগেই বলেছি যে, তফসিল ঘোষণার আগেই সম্ভাব্য সব রিট বা মামলা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া নির্বাচন কমিশনের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় সীমানা নির্ধারণ এবং সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়নের পরেই কেবল নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করবেন- এমনটাই তাদের কাছে দাবি। কিন্তু কার্যতঃ দেখা যাচ্ছে যে, সেটি তারা করছেন না, তাড়াহুড়ো করে একটি তফসিল ঘোষণা করে দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, প্রার্থী এবং সাধারণ ভোটারদের মাঝে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করে তারপর কোনো পুরোনো মামলায় বা রিটে আদালতের নির্দেশে সে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাচ্ছে।
স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন আপিল করে কোথাও সফল হয়েছেন তার নজির এখনও বর্তমান নির্বাচন কমিশন দেখাতে পারেনি। এমতাবস্থায় সবচেয়ে যে বড় ক্ষতিটি হচ্ছে তাহলো, নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণ আস্থা হারাচ্ছে। এবং সরকার যতোই বলছে যে, আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর তাদের কোনো হাত নেই, জনগণ কেবল একথা অবিশ্বাসই করছে তা নয়, তারা এ জন্য সরকারকেই দোষারোপ করছে মূলতঃ।
Advertisement
নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর নির্বাচন বাতিল করার পুরোনো অভিজ্ঞতার আলোকে শামসুল হুদা কমিশনের সুপারিশনামা বাস্তবায়ন করেছিল এর আগের মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকার এবং সংবিধান সংশোধন করে এই বিধান সংযুক্ত করা হয়েছিল যে, কোনো আদালত ঘোষিত হওয়া তফসিল বিষয়ে অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনো আদেশ দেওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনকে নোটিশ এবং শুনানীর সুযোগ দেবে। কিন্তু গাজীপুরের ক্ষেত্রে সেটি অনুসৃত হয়নি এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগও নেয়নি, সংবিধানের এই নির্দেশনাকে আদালতের নজরে আনার ক্ষেত্রে।
ফলে মানুষের মনে সন্দেহ আরো দানা বেঁধেছে যে, তাহলে নির্বাচন কমিশনই কি চায়নি গাজীপুরে নির্বাচন হোক? নাহলে নির্বাচনের মাত্র নয় দিন আগে কী ভাবে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন স্থগিত হলো? যখন সংবিধানই এরূপ নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে? এবং সেটা এই আওয়ামী লীগের অধীনেই সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল যে নীতি?
মজার ব্যাপার হলো, আদালত নির্বাচন কমিশনকে গাজীপুর সিটি নির্বাচন বিষয়ে দায়ের করা রিট সম্পর্কে একটি নোটিশও দিয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু সেই নোটিশ সম্পর্কে গণমাধ্যম অজ্ঞাত ছিল সম্পূর্ণ ভাবেই এবং এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনও নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এখনতো সকল পক্ষই (এমনকি সরকারি দলও) সন্দেহ করছে যে, নির্বাচন কমিশনের অবহেলার কারণেই বিষয়টি আসলে সরকারি হস্তক্ষেপে নির্বাচন বন্ধের মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, আদালতের এই নোটিশ সম্পর্কে আগে থেকেই গণমাধ্যমে জানানো হলে এবং সর্বত্র আলোচনা শুরু হলে আদালতের নির্বাচন বন্ধের নির্দেশ সম্পর্কে সকলেই অবগত থাকতো এবং হয়তো মানুষের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার ঢেউ অতোটা আলোড়ন তুলতো না।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে দায়ের করা রিট এবং আদালতের দেয়া নোটিশ বিষয়ে এতোটাই গোপনীয়তা অবলম্বন করেছে যে, এটা মনে হতেই পারে যে, নির্বাচন কমিশন কোনো একটি দুরভিসন্ধি নিয়ে চুপ করে বসে ছিল আদালতের নির্দেশের জন্য। এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর যে, সরকার নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে কাজটি করিয়েছে। যদি সরকার সেটা করাতো তাহলে দলীয় প্রার্থীর বিষয়টি জানা থাকার কথা এবং তার প্রচার-প্রচারণাতেও তার আলামত থাকার কথা। কিন্তু কোনো পক্ষের প্রচারণাতেই এরকম কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি যে, তারা অন্ততঃ এটা জানতেন যে, নির্বাচন স্থগিত হতে যাচ্ছে। বরং উভয় বড় দলের প্রার্থীকেই নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণায় মুষড়ে পড়তে দেখা গেছে এবং তারা সকলেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার দাবি নিয়ে।
দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বহুকাল ধরেই নেতিবাচক আলোচনা চলছে। সকল পক্ষ কোনো নির্বাচন কমিশনকে কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেওয়ার ঘটনা এদেশে এখনও ঘটতে দেখা যায়নি। একথাও সত্য যে, নির্বাচন কমিশনকে বরাবরই কোনো না কোনো সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছে। বিগত এক দশকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা পর্যালোচনা করলেও মিশ্র ফল লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু একথাই সত্য যে, এখনও পর্যন্ত কোনো নির্বাচন কমিশনই সকল পক্ষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
সামনে একটি জাতীয় নির্বাচন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এমনিতেই নানা ভাবে এই নির্বাচনকে বানচাল করা, নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় তৈরি করা এবং সর্বোপরি নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে না দেওয়ার ঘোষণাও আসছে কোনো কোনো রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে। নির্বাচনকে প্রতিহত করার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এদেশের মানুষের হয়েছে, জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে এদেশের ভোটাররা সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ফলে এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের যে কোনো দুর্বলতা যে মানুষকে সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাকেই স্মরণ করিয়ে দেবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
শুরুতেই বলেছি যে, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার প্রথম ও প্রধান দায় গিয়ে পড়ে সরকারের ওপর। গাজীপুর নির্বাচন স্থগিত হওয়ার দায়ও সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বর্তেছে। এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের সম্মিলিত দায়িত্ব এই দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করার এবং আদালতের নির্দেশেই আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানকে ফিরিয়ে এনে জনগণ যে উৎসবে মেতে উঠেছিল তাদেরকে সেই উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার।
যে আলোচিত রিটের কারণে নির্বাচন স্থগিত হয়েছে সেই রিটটি নিয়ে এমনিতেই নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে, ফলে একটি প্রশ্নবিদ্ধ রিটকে আদালতের সামনে যতো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে ততোই নির্বাচন কমিশনের হারানো গ্রহণযোগ্যতা ফিরে আসবে এবং সরকারকেও অবিলম্বে এই দায় থেকে মুক্ত হতে হবে যে, তারা হেরে যাওয়ার ভয়েই গাজীপুরে নির্বাচন স্থগিত করেছে।
নির্বাচন স্থগিত করা যে সমস্যার সমাধান নয় সেটা সরকার বুঝতে পারে না, সেটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। বরং নির্বাচনই একমাত্র উপায় জনগণের সামনে নিজেদের স্বচ্ছতা ও জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের- সরকার দৃঢ়ভাবে সেটি বিশ্বাস করে বলেই আমরা বুঝতে চাই।
ঢাকা ৮ মে, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর