লন্ডনের স্থানীয় নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন অনেকেই। ব্রিটেনের স্থানীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নারী-পুরুষদের এ এগিয়ে যাওয়া এ এক আশা জাগানিয়া উত্তরণ। টাওয়ার হ্যামলেটস ধরে রেখেছে লেবার পার্টি। এবার নিউহাম বারায় রীতিমত বিপ্লব ঘটিয়েছে লেবার দল। দলটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এশিয়ান কমিউনিটি একটা বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
Advertisement
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত রুকশানা ফাইজ নেতৃত্ব দিয়েছেন এ পরিবর্তনে। ঐ বারার সাবেক মেয়র স্যার রবিন ওয়েলস যেন শেকড় গড়েছিলেন, তার ইশারা ছাড়া এই বারায় কিছুই হতো। স্যার রবিনের কারণে দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে দলটিতে ছিল অস্বস্তি। বাঙালিসহ এশিয়ান মানুষের একটা দৃঢ় ও ব্যাপক অবস্থান আছে এই কাউন্সিলে। অথচ তাঁর কিছু কার্যক্রম এই কমিউনিটির মানুষকে আঘাত দিয়েছে, লেবার দলের অভ্যন্তরে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভও তাই ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। কিন্তু এই কাউন্সিলসহ উচ্চপর্যায়ে খুবই প্রভাবশালী নেতা হবার কারণে কেউই সাহস করে তাঁকে সরাতে পারে নি।
ক্ষোভ জমেছে, প্রতিবাদ করেছেন কিন্তু জোরালো কিংবা প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করা ছিল রীতিমত সাহসের ব্যাপার। এবার সাহস দেখিয়েছিলো নিউহামের লেবার দল। রুকশানা ফাইজ নামের পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত নিউহাম বারার কাউন্সিলার সবাইকে নিয়ে সেই সাহস দেখালেন। এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় শেষে লেবার দলের ভোটাধিকারপ্রাপ্ত সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ একনায়কতান্ত্রিকতা বিদায় করেছিলেন তারা। আর সেজন্যে ষোলটি বছর পরে ফাইজের নেতৃত্বে নির্বাচনের আগেই স্যার রবিনকে পার্টির মেয়র মনোনয়ন থেকেই বাদ পড়তে হয়। বলতে হবে সেকারণেই এবার নিউহাম বারায়ও প্রত্যাশিত বাঙালি কাউন্সিলার প্রার্থী হতে পেরেছিলেন এবং এবারে বাংলাদেশী দশ জন কাউন্সিালার প্রার্থীর প্রত্যেকেই বিজয়ী হয়েছেন।
প্রায় পঁচিশ বছর থেকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কাউন্সিলার নিউহামে চারজন থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে পারে নি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তনের কারণেই এখানে মূলধারায় একটা শক্ত কণ্ঠ হিসেবে এবার সামনে এসেছে বাঙালিরা।
Advertisement
টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে শুরু করে নিউহামে নতুন পদক্ষেপ, এখন নির্ভর করবে নির্বাচিত কাউন্সিলাররা তাদের কর্মদক্ষতা দিয়ে মূলধারার রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে নিজেদেরকে কতটা জনমুখি কিংবা রাজনীতিমুখি করে তোলেন, তা দেখার। তাদের কার্যক্রমের উপরই নির্ভর করছে নিউহামের রাজনীতিতে নতুনরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবার।
২) টাওয়ার হ্যামলেটসতো বাঙালিদের নিজস্ব জায়গাই। এখানেই বাঙালিরা ভিত রচনা করছে সবকিছুর। সংগ্রামও এখানেই হয়েছে। এখানেই রক্তাক্ত হয়েছে বাঙালিদের শরীর-হৃদয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে এখানেই জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন ইতিহাসের। এখানেই রুশনারা আলীকে দিয়ে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের দ্বার উন্মুক্ত হয়। তারপর একে একে টিউলিপ সিদ্দিকী কিংবা রুপা হককে দিয়ে ইতিহাসের যাত্রাপথে উন্মুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন আরও জানালা। এই জানালায়ই হাওয়া দিয়েছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস এর নির্বাহী মেয়র নির্বাচনে লুৎফুর রহমান নির্বাচিত হয়ে ।
কিন্তু আইনী মারপ্যাচে লুৎফুরকে দ্বিতীয়বার মেয়র থাকাকালীন রাজনীতির মাঠ থেকেই ছিটকে পড়তে হয়। রাজনীতির যে কোন কার্যক্রম থেকে আইনী কারণেই দূরে থাকতে হয় তাঁকে। নির্বাচনে প্রার্থীতায় তিনি অযোগ্য থাকায় এবারেও নির্বাহী মেয়র হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন নি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে অনেকেই মনে করছেন, তার মাধ্যমেই যেন এ কমিউনিটিতে বিভক্তিটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবার।
আগেরবার তাঁর মনোনীত প্রার্থী রাবিনা খান একজন প্রতিশ্রুতিশীল এবং কমিউনিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ রাজনীতিক হওয়া সত্ত্বেও এবার লুৎফুর ব্লকের মেয়র প্রার্থী হয়ে উঠেন তাঁর সময়কালীন ডেপুটি ওহিদ আহমদ। শুরু হয় বিভক্তি। রাবিনা খানও নিজের প্রার্থীতা নিয়ে মাঠে আসেন। একজন স্মার্ট , শিক্ষিত আধুনিক মুসলিম মহিলা হিসেবে বাঙালি কমিউনিটিতে তিনি ছিলেন গ্রহণযোগ্য। অথচ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিলো রাবিনা খান মহিলা হিসেবে ফেইথ কমিউনিটি তাকে ভোট দিতে চাইবে না। প্রচারটা যে কত যুক্তিহীন ছিল, তা কি বিরোধীপক্ষ তাদের ধারণায় রাখেননি। মাথায় হিজাব না পরলেও টাওয়ার হ্যামলেটস এর ফেইথ কমিউনিটির মানুষই বার বার নির্বাচিত করছে এমনকি ব্রিটেনের পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে রোশনারা আলীকে। এ উদাহরণতো আমাদের চোখের সামনেই।
Advertisement
৩) ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি মানুষের আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু যখন অপপ্রচার করা হল, ধর্মীয় আবেগ-অনভূতির কারণে মানুষ রাবিনাকে ভোট দিতে চাইবে না, তখন কিন্তু না চাইলেও বাঙালি কমিউনিটিকে একটা সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে নিয়ে আসা হল।
স্বাভাবিকভাবেই মূলধারার রাজনীতির সুবিধাভোগীরা এসব অপপ্রচার লুফে নেয়, এবং সময় হলে তারা এটা ঠিকই ব্যবহারও করে। কারণ এসব কথা দিয়ে আঙ্গুল উচিয়ে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে যে, টাওয়ার হ্যামলেটস এর মানুষ শুধু ধর্মীয় অনভূতি দিয়ে বিবেচনা করে সবকিছু। কিন্তু আশার কথা হল, এবারের নির্বাচন আবারও প্রমাণ করেছে টাওয়ার হ্যামলেটস এর বাঙালি কিংবা মুসলিম ভোটাররা ধর্মের বিচারে নয়, তারা যোগ্যতার বিচারেই কিংবা কমিউনিটির ঐক্যের প্রয়োজেনেই ভোট দিয়েছে রাবিনা খানকে। এবং একসময় লুৎফুর রহমানের একটা বিশাল জনপ্রিয়তা থাকা সত্বেও তাঁর মনোনীত প্রার্থী ওহিদ আহমদ রাবিনা খানের চেয়ে প্রায় ছয় হাজার ভোট কম পেয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে এবারেও ওহিদ এবং রাবিনা মিলে আগের বারের মতই অর্থাৎ প্রায় ২৭ হাজার ভোট পেয়েছেন। রাবিনা-ওহিদ বিভক্তি থাকার কারণে অনেক ভোটারই ভোট দেননি তাদের দুজনের কাউকেই। যেহেতু লুৎফুর-ওহিদ-রাবিনা সবাই লেবার পার্টিরই নেতা কিংবা কর্মী ছিলেন এবং তাদের সমর্থন করা অধিকাংশ ভোটারও মূলত লেবার ঘরানারই মানুষ, সেজন্যে এবারে অসংখ্য ভোটার ওহিদ-রাবিনা বিভক্তির কারণে তাদের দুজনের কাউকেই ভোট না দিয়ে তাদের পুরনো পছন্দ সেই লেবার পার্টিকে ভোট দিয়েছে। আর সেকারণেই লুৎফুর রহমান সমর্থিত কেউ এবারে কাউন্সিলার পর্যন্ত হতে পারেন নি। শুধু রাবিনা খান কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছেন।
অর্থাৎ মূলধারার রাজনীতির বিপরীতে তাদের কেউই ব্যাপক মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেন নি। পক্ষান্তরে মোট ৪৫ জন নির্বাচিত কাউন্সিলারের মাঝে ২৪ জনই বাঙালি কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছেন লেবার পার্টি থেকেই। এবং বিশাল ভোটের ব্যবধানে ৪৪ হাজার ৮৬৫ ভোট পেয়ে আবারও নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জন বিগস।
অথচ এবার লুৎফুর রহমান যদি তার বিশাল জনপ্রিয়তাকে সামনে রেখে রাবিনাকেই তার কিংবা তাদের প্রার্থী করতেন, তাহলে তাঁর রাজনীতির আগামীতে একটা নতুন মেরুকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েই যেত। কারণ তিনি ২০২০ সালে আবার রাজনীতির মাঠে আসতে পারবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং আইনী বিধি-নিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে আগামী চার বছর পর হয়ত আবার নির্বাচন করতে পারবেন এই টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র নির্বাচনে। কিন্তু লুৎফুর রহমানের মত একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের এবারের নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণ মিলাচ্ছে টাওয়ার হ্যামলেটস এর মানুষ ভিন্নভাবে।
আমরা কি ধরে নেব, আগামীর রাজনীতিতে লুৎফুর রহমান তাকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিটি নেতা কিংবা মূলধারার রাজনীতিবিদ হিসেবে তোলে ধরতেই এই রাজনীতি করলেন। পরাজিত দুই মেয়রের বিপরীতে তিনিই হতে চাইছেন একক কোন মানুষ, যিনি তোলে আনবেন এই কমিউনিটিকে আবারও, হারিয়ে যাওয়া গহ্বর থেকে। এ কথাটা এখন উঠে আসছেও। কিন্তু কার্যত কি তা হবে?
৪) লুৎফুর রহমান এই কমিউনিটিকে আশার আলো দেখিয়েছিলেন। রাজনীতির মাঠে এমনকি তিনি জাতীয়ভাবে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনের এক বছর আগ থেকেই। এবারের মেয়র নির্বাচনের এই বিভক্তি কিংবা জনমনে বিভিন্ন সংশয় থাকার পর লুৎফুর রহমানের সমর্থকরা কি তাকে এই জায়গায় আর ভাবতে পারবেন।
বাঙালি কমিউনিটিকে যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন, সে স্বপ্নের কথা সহজেই কেউ হয়ত ভুলবে না। কিন্তু গত ৩ মে’র নির্বাচনে বাঙালি কমিউনিটিতে যে বিভক্তির শিকড় নতুনভাবে গ্রন্থিত হলো তা থেকে বের করে আনতে পারবেন কি লুৎফুর ? ইতিহাস কিছু মানুষকে তৈরি করে দেয়। কিছু কিছু অধ্যায় সৃষ্টি হয় অনেক মেধায়-প্রজ্ঞায়, অনেক ত্যাগে। একটা কমিউনিটিকে একটা জায়গায় নিয়ে আসেন কোন এক নেতা। সেই জায়গাটাতে লুৎফুর ছিলেন সার্থক। কিন্তু এবারে সেই জায়গাটাকেই তিনি ব্যবচ্ছেদ করলেন। তাঁর নেতৃত্বে যে কমিউনিটি একসময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলো, তাঁর নেতৃত্বে আবার সেই কমিউিনিটি উঠে দাাঁড়াবে, এটা খুব একটা প্রত্যাশা করা যায় না। বরং এবারের নির্বাচনে বাঙালিদের একটা বড় অর্জন যেন ম্লান হয়ে গেল। তবে একটা কথা বলতেই হয়, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে নতুন এবং মেধাবী নেতৃত্ব এগিয়ে এসেছে, এবং এভাবেই লেবার কিংবা কনজারভেটিভের হয়েই এ কমিউনিটিকে এগিয়ে নিতে হবে। দলের ভেতরে সংগ্রাম করেই এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর হতে হবে রাজনীতির কর্মীদের। আঞ্চলিকতা কিংবা শুধু সম্প্রদায়ের ধুয়া এ আধুনিকতায় সেকেলে হিসেবেই যেন প্রমাণিত হল এবার। টাওয়ার হ্যামলেটস এর এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এরকম রাজনীতির কবরও রচিত হলো, এটা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম