জাতীয়

আদালতের নির্দেশনা না মানায় কমছে না যৌন হয়রানি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অসচেতনতা এবং আদালতের নির্দেশনা না জানা কিংবা না মানার ঝোঁকের কারণে কমছে না যৌন হয়রানির ঘটনা। আদালতের নির্দেশনা, হয়রানি তদন্তে কমিটি গঠন ও নজরদারির বিষয়টিও সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে যৌন হয়রানি হলে তার প্রতিকার পান না ভুক্তভোগীরা। যৌন হয়রানি বন্ধে করণীয় কী, তা নিয়ে রয়েছে অসচেতনতা। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে কার্যকর ভূমিকা।

Advertisement

‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ : আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা’ নিয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের করা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পর এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্টজনরা। গবেষণায় উঠে এসেছে হাইকোর্টের নির্দেশনা প্রণয়নের দীর্ঘ নয় বছর পরেও কর্ম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।

গবেষণাটিতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ শিক্ষার্থী অংশ নেন। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা, পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যমের ২০ জন ব্যক্তির ওপরও গবেষণাটি করা হয়।

এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো কমিটির কথা জানেন না। ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই জানেন না আদালতের সেই নির্দেশনা। ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী নির্দেশনার কথা জানলেও তা নামেমাত্র জানেন।

Advertisement

আর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা, পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানে ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ কর্মজীবী জানেন না হাইকোর্টের নির্দেশনাটি। ১৪ শতাংশ নির্দেশনাটি জানলেও পরিষ্কার ধারণা নেই তাদের। এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এই নির্দেশনা সম্পর্কে জানেন না, ভাবেনও না।

সোমবার দুপুরে রাজধানীর গুলশান ১- এর স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, কর্মক্ষেত্রে বা উন্মুক্ত স্থানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনাকে একটি যুগান্তকারী নির্দেশ হিসেবে ধরা হয়।

ওই নির্দেশনায় বলা হয়, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সচেতনতা বৃদ্ধি, হয়রানির তদন্তে কমিটি গঠন ও আইনের প্রয়োগের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের অবহিতকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে বিদ্যমান আইনে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিচার নিশ্চিত করার কথাও বলা আছে হাইকোর্টের নির্দেশনাটিতে। যেটি কর্মক্ষেত্রের যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যও প্রযোজ্য।

Advertisement

নির্দেশনায় আরও বলা হয়, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে যতদিন না একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ আইন গ্রহণ করা হয় ততদিন পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ের সব কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

প্রতিবেদন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, ‘আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো একজন হয়রানি বা নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কর্মক্ষেত্রে একই অবস্থা। এই পরিস্থিতি সমাধানে হাইকোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনা একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। হয়রানি বা নির্যাতনকারীকে আইনের আওতায় এনে বড় অঙ্কের জরিমানা করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক ও নারীনেত্রী খুশি কবির বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনাটা মানা খুবই দরকার। এটি মানা হলে আমাদের দেশে নির্যাতনের মাত্রা কমে যেত। তবে বাস্তবতা হলো স্বীকৃত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যৌন নির্যাতন হলে তার বিচার হয় না। ছাত্রীদের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। অভিযোগ আসলে বিচার হয় না। অনেকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ, অনেকক্ষেত্রে মাতব্বরি করে কমিশন। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা মান্য করা হলেও এ চিত্র পরিলক্ষিত হতো না।

অ্যাকশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে হাইকোর্টের নির্দেশনা মানে সেটি আইন। তবে সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিকার বা প্রতিরোধ হচ্ছে না। যেটির ভয়াবহতা আমরা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। নারীরা ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সমস্যা সমাধানে হাইকোর্টের নির্দেশনার বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়াতে হবে। যারা হাইকোর্টের নির্দেশনা মানেন না, তাদের ক্ষেত্রে জবাবদিহি করতে হবে।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ডিরেক্টর উজমা চৌধুরী বলেন, আমরা নারী দিবস করি। অথচ সেখানে যৌন হয়রানি-নির্যাতনের বিষয়গুলো সঠিকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। নারীরা কোন জায়গায় আটকে আছে তা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধবিষয়ক একটি করে সচেতনতামূলক সেশন চালু করা জরুরি বলে মন্তব্য করে উজমা চৌধুরী বলেন, ‘যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটবে তখনই ধামাচাপার বিষয়টি আসে। কারণ চাকরি থাকা না থাকা ও প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির বিষয়টিও থাকে। আমরা যদি যৌন হয়রারিকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিই কিংবা অভিযোগের পরই ডেপুটেশন দিই তবে আরও ৫০ জন নারী যৌন হয়রানি থেকে বাঁচবে।’

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা পুরোপুরি মানা গেলে কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতন নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। সরকার এ বিষয়ে কাজ করছে। মানুষ কিংবা পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজের ব্যাপকতা হয়ত কম। তবে আমরা কাজ করছি। নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

গবেষণায় বলা হয়, সচেতনতার অভাবেই মূলত হাইকোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাই এ সম্পর্কে সর্বস্তরে বিশেষত, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। আদালতের নির্দেশনা যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় সেজন্য সরকারি উদ্যোগে একটি তদারকি কমিটি থাকা উচিত। ওই কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ট্রেড ইউনিয়ন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা থাকবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গণপরিসরে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা।

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুপারিশ

২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনাটি যাতে মানা হয় সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য কিছু সুপারিশ করা হয় গবেষণাটিতে। সুপারিশে বলা হয়, বর্তমান অবস্থাকে বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে আদালতের নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নোটিশ বা অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে হাইকোর্টের নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত অবহিত করবেন। শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকামণ্ডলী ও কর্মীদের মাঝে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইন, প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা এবং আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দায়িত্ব হবে, বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে একটি তদারকি ও পর্যবেক্ষণ কৌশল গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা।

সুপারিশে আরও বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি কর্মী ও ব্যবস্থাপকের জন্য সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা, ব্যবহারিক ও প্রচারণার নথিপত্র তৈরি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদারকি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। তদারকি কৌশলগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সরকারি অধিদফতর ও কর্তৃপক্ষের সুপরিকল্পিত, সমন্বিত উদ্যোগে গ্রহণ করতে হবে।

জেইউ/জেডএ/আরআইপি