ফিফার সঙ্গে অলিম্পিকের একটা দ্বন্দ্ব যেন জন্ম থেকেই বিদ্যমান। বিশ্বব্যাপি ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে যখন পারস্পরিক ম্যাচ আয়োজন করছিল, তখনই আন্তর্জাতিকভাবে এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যে কারণে, ১৯০৪ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জন্ম নেয় ফিফা (ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন)। তখন থেকেই অলিম্পিকের সঙ্গে একটা স্নায়ুর দ্বন্দ্ব বরাবরই ছিল ফিফার।
Advertisement
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিই শুধু অলিম্পিক গেমসে ফুটবলের বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারবে, অন্য কেউ নয়- এমন একটা দ্বন্দ্ব চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের উদ্যোগে শুরু হয়ে যায় বিশ্বকাপ ফুটবল আসরের। ১৯৩০ থেকে শুরু হওয়ার পর থেকে একক কোনো ডিসিপ্লিনের এত জনপ্রিয়, এত আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট আর কোনো খেলাতেই দেখা যায়নি। যে কারণে অনেকেই অলিম্পিকের পরিবর্তে ফুটবল বিশ্বকাপকেই ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি তো ফুটবলকে খেলা হিসেবেই যেন গণ্য করতে চাইতো না। যে কারণে ১৯০০ এবং ১৯০৪ সালের অলিম্পিকে ফুটবল নামক একটি ইভেন্ট থাকলেও, এই দুই আসরে ফুটবলে পদকজয়ীদেরকে কোনো পদকই দেয়া হয়নি। ফিফা গঠন করার পর ১৯০৮ সালে লন্ডন অলিম্পিক থেকে ফুটবলকে স্বীকৃতি দেয় অলিম্পিক কমিটি। যদিও, স্বীকৃতির মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। কারণ, অলিম্পিক ফুটবলে খেলতে পারতো কেবল অপেশাদাররাই (অ্যামেচার)।
ফিফা গঠনের পর ফুটবল খেলা শুরু হয়েছে এমনটা নয়, ফুটবলের ইতিহাস অনেক পুরনো। খৃষ্টপূর্ব সহস্র শতাব্দী আগে থেকেই ফুটবলের ইতিহাস রয়েছে। মূলতঃ ফুটবলের জন্ম নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলা বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলেন চীনে, কেউ বলেন প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে ফুটবলের জন্ম। আবার অনেকে ফুটবলের জন্ম ইংল্যান্ডে বলে দাবি করে থাকেন। তবে নানা তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, ‘প্রায় ১০০৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে জাপানে ফুটবলাকৃতির বস্তু দিয়ে মানুষ খেলাধুলা করত।’ জার্মানির মিউনিখের নৃ-তত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত তথ্য থেকে জানা গেছে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০ সালে জাপান এবং চীনের মধ্যে ফুটবলের মতো এক ধরনের খেলা হতো।
Advertisement
ফিফার কাছে ফুটবলের সবচেয়ে প্রাচীন যে ইতিহাস রক্ষিত, তাতে জানা যায় ফুটবলের উৎপত্তি চীনেই। চু জু নামে বল নিয়ে এক ধরনের খেলা খেলতো চীনারা। যেটা প্রচলিত ছিল কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনামেও। চু জু’র অর্থই হলো বলে কিক দেয়া। তখন থেকেই নিয়ম ছিল, পা দিয়ে খেলতে হবে এবং হাত ব্যাতিত শরীরের যে কোনো অঙ্গ দিয়ে বল ছোঁয়া যাবে। খৃস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে চীনের হান রাজবংশ চু জু খেলাকে একটা নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করে তোলেন এবং খেলাটিকে আধুনিক করেন।
চীনের চু জু’র আধুনিক সংস্করণই আজকের ফুটবল। কালের বিবর্তনে ফুটবল আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলায় পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর এত পুরনো এক খেলা, অথচ একে সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথমবারেরমত ১৯০৪ সালেই একটি বৈশ্বিক সংগঠন গঠন করা হলো- ফিফা নামে। ফিফা গঠন করা হলেও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে অবশেষে ১৯৩০ সালে প্রথম মাঠে গড়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল।
ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সের জুলে রিমেই ছিলেন (১৯২০-১৯৫৪) বিশ্বকাপের স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৯২৮ সালে হল্যান্ডের (বর্তমানে নেদারল্যান্ডস) রাজধানী আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত ফিফার কংগ্রেসের জুলে রিমে বিশ্বকাপের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯২৯ সালে ২৫-৫ ভোটে বিশ্বকাপের সিদ্ধান্ত পাস হয়। ইতালি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্পেনকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় উরুগুয়ে। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করে উরুগুয়ে স্বাধীনতার শতবর্ষও উদযাপন করে। রাজধানী মন্টেভিডিওতে বিশ্বকাপের জন্য নির্মাণ করা হয় ৯৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টাডিও সেন্টেনারিও। প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে বাছাইপর্ব ছাড়াই। ফিফার সদস্য দেশগুলোর সবাইকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিশ্বকাপে খেলার; কিন্তু আটলন্টিক পাড়ি দিয়ে বিশ্বকাপে খেলার মতো ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে না বলে অনেকগুলো ইউরোপিয়ান দেশই প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি। শেষ পর্যন্ত লাতিন আমেরিকা থেকে ৭টি, ইউরোপ থেকে ৪টি এবং উত্তর আমেরিকা থেকে ২টিসহ মোট ১৩টি দেশ অংশ নেয় প্রথম বিশ্বকাপে। যে চারটি ইউরোপিয়ান দেশ অংশ নিয়েছিল, তাদেরকে অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর এবং ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর চারটি ইউরোপিয়ান শেষ পর্যন্ত অংশ নেয় উরুগুয়ে বিশ্বকাপে।
১৯৩০ সালের ১৩ জুলাই থেকে ৩০শে জুলাই অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্বকাপ। ৩টি ভেন্যুতে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় মোট ১৮টি। অংশগ্রহণকারী ১৩টি দেশকে চার গ্রুপে ভাগ করা হয়। ‘এ’ গ্রুপেই ছিল কেবল চারটি দেশ- আর্জেন্টিনা, চিলি, ফ্রান্স এবং ম্যাক্সিকো। বাকি তিন গ্রুপের প্রতিটিতে ছিল তিনটি করে দেশ। ‘বি’ গ্রুপে যুগোস্লাভিয়া, ব্রাজিল এবং বলিভিয়া। ‘সি’ গ্রুপে উরুগুয়ে, রোমানিয়া, পেরু এবং ‘ডি’ গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্র, প্যারাগুয়ে এবং বেলজিয়াম।
Advertisement
প্রথম দিনই মন্টেভিডিওর দুটি ভেন্যুতে একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় দুটি ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে ফ্রান্স ৪-১ গোলে হারায় ম্যাক্সিকোকে এবং অন্য ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্র ৩-০ গোলে হারায় বেলজিয়ামকে। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেই (১৭ জুলাই, ১৯৩০) যুক্তরাষ্ট্রের বার্ট প্যাটেনাউডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম হ্যাটট্রিকের রেকর্ড গড়েন। বড় কোনো ফুটবলার না হলেও, ইতিহাসের পাতায় নাম উঠে গেলো যুক্তরাষ্ট্রের এই ফুটবলারের।
চার গ্রুপ থেকে সেরা চারটি দল উঠলো সেমিফাইনালে। এস্টাডিও সেন্টেনারিওতে বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা ৬-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারায় যুক্তরাষ্ট্রকে। ৬জন বৃটিশ বংশোদ্ভূত ফুটবলার নিয়ে খেলতে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মাঠ পিচ্ছিল থাকায়, ১০ মিনিটেই পা ভেঙে মাঠ ছাড়েন মিডফিল্ডার রাফায়েল ট্র্যাকি। প্রথমার্ধ আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে এগিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনার গতির কাছে আর টিকতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। হজম করে আরও ৫ গোল। একটি শোধ করলেও সেটা পরাজয় এড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না।
দ্বিতীয় সেমিফাইনালে উরুগুয়ে ৬-১ গোলে হারায় যুগোস্লাভিয়াকে। ১৯২৪ অলিম্পিকের গ্রুপ ম্যাচে যুগোস্লাভিয়াকে ৭-০ গোলে পরাজিত করার ম্যাচের পূনরাবৃত্তিই ঘটেছে যেন এই ম্যাচে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে শুরুতেই গোল দিয়ে বসে যুগোস্লাবিয়া; কিন্তু প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই ২-১ গোলে এগিয়ে যায় উরুগুয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে তো একাই ইতিহাস লেখে স্বাগতিকরা। আরও চার গোল দিল তারা যুগোস্লাবদের জালে। এই ম্যাচে উরুগুয়ের পেদ্রো সিয়া হ্যাটট্রিক করেন।
৩০ জুলাই এস্টাডিও সেন্টেনারিওয় অনুষ্ঠিত হলো প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেখানে প্রতিপক্ষ দুই লাতিন পাওয়ার হাউজ আর্জেন্টিনা এবং স্বাগতিক উরুগুয়ে। লা প্লাতা অববাহিকা অঞ্চলে বিশ্বকাপের ফাইনাল নিয়ে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করতে শুরু করে। আর্জেন্টাইনরা দলে দলে রিভার প্লেট নদী পেরিয়ে এসে জড়ো হতে থাকে মন্টেভিডিওতে। তারা একসঙ্গে কোরাস ধরে, ‘ভিক্টোরিয়া ও মুয়ের্তে (জয় কিংবা মৃত্যু)’ বলে। অন্তত ১০টি জাহাজভর্তি করে আর্জেন্টিনা সমর্থকরা এসেছিল প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে।
ফাইনাল শুরুর ৮ ঘণ্টা আগে খুলে দেয়া হয় স্টেডিয়ামের গেট। অফিসিয়াল হিসাবমতে অন্তত ৯৩ হাজার দর্শক সমাগম ঘটেছিল এস্টাডিও সেন্টেনারিওতে। খেলা নিয়ে যাতে কোনো অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে না যায়, সে কারণে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয় তখন। খেলার ১২ মিনিটেই স্বাগতিক উরুগুয়েকে এগিয়ে দেন পাবলো ডোরাডো। ২০ মিনিটেই উরুগুয়ের গোল শোধ করে দেন পিউসিলে।
৩৭তম মিনিটে আর্জেন্টাইনদের আনন্দে ভাসান গুইলার্মো স্ট্যাবিলে। কিন্তু আর্জেন্টিনার দৌড় যেন থেমে গেলো সেখানেই। ম্যাচের ৫৭ মিনিটে সমতায় ফেরে উরুগুয়ে। গোল করেন পেদ্রো সিয়া। এরপর ৬৮ মিনিটে ইরিয়াত্রে এবং ৮৯ মিনিটে ক্যাস্ত্রো গোল করে উরুগুয়ের বিজয় নিশ্চিত করেন। ৩৭ মিনিট পর্যন্ত ২-১ গোলে এগিয়ে থেকেও স্বাগতিকদের কাছে ৪-২ গোলে হার মানতে হয় আর্জেন্টিনাকে।
টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৮ গোল করেন আর্জেন্টিনার গুইলার্মো স্ট্যাবিলে। প্রথম বিশ্বকাপে মোট তিনটি হ্যাটট্রিক হয়। অপর হ্যাটট্রিকটি করেন আর্জেন্টিনার গুইলার্মো স্টাবিলে, ম্যাক্সিকোর বিপক্ষে।
আইএইচএস/আরআইপি