মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম; বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দুই দশক ধরে। সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছান নিজের যোগ্যতা, ত্যাগ আর প্রজ্ঞার বলে। দেশে প্রগতি ধারার ছাত্র রাজনীতির অভিভাবক সংগঠক বলে পরিচিত ছাত্র ইউনিয়নেরও সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
Advertisement
রাজনীতির কারণে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার হন, জেল খাটেন একাধিকবার। স্বাধীনতার পর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ডাকসুর ভিপি (সহ-সভাপতি) নির্বাচিত হন। নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীর।
রাজনীতি, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জোটভুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। আজ থাকছে এর শেষ পর্ব।
জাগো নিউজ : লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের পাসপোর্ট জমা দেয়া নিয়ে রাজনীতিতে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি কীভাবে দেখছেন?
Advertisement
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : দুই বুর্জোয়া দল নিজেদের ঘরের ঝগড়া বাইরে নিয়ে আসে জনগণের মূল দাবি আড়ালের জন্য। এমন ইস্যু তৈরি করে রাজনীতির বাতাবরণকে একটি মিথ্যা, অবাস্তব ও ধোঁয়াশার মধ্যে পতিত করতে চায়। তারেক রহমানের পাসপোর্ট ইস্যুও ঠিক তাই। এমন ইস্যু আগেও তৈরি হয়েছে। এগুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আগ্রহ কাজ করে না।
কারণ এই জগৎ আমার জগৎ নয়। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি, দুই দলের কেউই সত্যটি বলছে না। আওয়ামী লীগ ধোয়া তুলসী পাতা নয়, আবার বিএনপিও নয়। হাওয়া ভবনের খবর আমরা সবাই জানি। বিএনপিকর্মীরা আমার হাত ভেঙে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের কর্মীরাও একই কাজ করেছিল।
বিএনপি-আওয়ামী লীগের এসব ঠুনকো ইস্যু আমাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। জনগণের অধিকার ধামাচাপা দেয়ার জন্যই এমন হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। পুঁজিবাদের জন্য নয়। পাকিস্তানের গোলামি থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল ভারত বা আমেরিকার গোলামির জন্য নয়।
সমাজের কেউ আজ নিরাপদ নন। সবদিকেই খুন, ধর্ষণ, অপহরণ আর দুর্নীতি। বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থেকে যতবার বক্তব্য দিয়েছেন, বেশির ভাগ বক্তব্যেই তিনি বলেছেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনলাম। আমার কম্বল গেল কই?’
Advertisement
বঙ্গবন্ধু সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ তারই দল এবং কন্যা আজ ক্ষমতায়। কম্বল চুরি নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টু শব্দটিও করছেন না। অথচ পিতার কাছ থেকে কন্যার শিক্ষা নেয়ার কথা ছিল।
জাগো নিউজ : আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কিনা?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকবে কিনা- সেটাই ভাবছি।
জাগো নিউজ : গতবার সুযোগ ছিল কিন্তু অংশ নেননি…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : গতবারের নির্বাচনের বিষয় ছিল আলাদা। সবাই তার প্রেক্ষাপট জানেন।
এবার ৯০ ভাগ প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে না বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। জামানতের টাকা বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা হচ্ছে। আবার ভোটার তালিকার একটি সিডি নেয়ার জন্য ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেতমজুর জীবনেও এত টাকা একসঙ্গে দেখেননি। এত টাকা ৯০ ভাগ মানুষের কাছে কল্পনার বিষয়। অর্থাৎ ৯০ ভাগ মানুষকে নির্বাচনের বাইরে রাখার পরিকল্পনা হচ্ছে।
বড়লোকরাই প্রার্থী হতে পারবেন এবং আমজনতা কোনো কোটিপতি দ্বারা প্রভাবিত হবেন। এটিকে তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলে না। সবাই ভোট দিতে পারলেই তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলে। ভোটারদের যেমন ভোট প্রয়োগের সুবিধা দিতে হবে, তেমনি প্রার্থীকেও।
জাগো নিউজ : আপনারা এর প্রতিবাদ করেননি?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : হ্যাঁ, বলেছিলাম। নির্বাচন কমিশন যুক্তি দিয়ে বলেন, জামানত না বাড়ালে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। বেশি সংখ্যক প্রার্থী হলে ব্যালটে জায়গা দেয়া নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
জাগো নিউজ : আপনারা কী বললেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আমরা বলেছি, প্রার্থীর আয়ের ওপর জামানত নির্ধারণ করেন। তখন তারা থমকে গেলেন। জবাব দিলেন না।
রাষ্ট্র ব্যবস্থা এভাবেই তৈরি করে রাখা হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের অধিকার শুধু খর্বই করা হচ্ছে। কাগজে লেখা আছে, সকলের অধিকার সমান। তবে এই এই শর্ত প্রযোজ্য।
জাগো নিউজ : নির্বাচন নিয়ে আপাতত কী ভাবছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমরা মাঠে আছি। ১৮ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সারাদেশে পদযাত্রা হবে। এরপর জাতীয় সম্মেলন হবে। নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও আছে।
যদি আমাদের দাবি মানা না হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে শামিল হব কি হব না, তা পরবর্তীতে বিবেচনা করে দেখব। তবে আমরা যদি এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি, তাহলে আর দ্বিমুখী নির্বাচন হবে না। আমরা বামপন্থীরা বিকল্প বলয় গড়ে তুলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করব।
জাগো নিউজ : কোনো জোটভুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা আছে কিনা?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সিপিবি ও বাসদ জোট তো আছেই। নির্বাচনের আগে আরও কোনো শক্তির সঙ্গে আসন নিয়ে বোঝাপড়ার দরকার হলে সেটাও বিবেচনা করব।
জাগো নিউজ : আওয়ামী লীগ বা বিএনপির জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো ভাবনা আছে কিনা?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আওয়ামী লীগ-বিএনপির জোটে শরিক হওয়া অসম্ভব। আমাদের আন্দোলনই হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতির বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলে জোট করতে পারে। আমরা তাদের সঙ্গে জোট করব! কল্পনাতেই আসে না।
অনেকেই বলে সিপিবিও বিরোধী দল, বিএনপিও বিরোধী দল। তাহলে জোট হতেই পারে। বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে ‘ডানপন্থা’ অবস্থান থেকে। আমরা বিরোধিতা করি ‘বামপন্থা’ থেকে। একই অবস্থান থেকে বিএনপিরও বিরোধিতা করি। এই প্রশ্নেই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র সঙ্গে আমাদের কোনো ঐক্য হবে না।
এএসএস/এমএআর/এমএস