দেশজুড়ে

নিরাপত্তাহীন পটুয়াখালীর নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা

পটুয়াখালীর গলাচিপা নদীতে ২০১৪ সালের ৩ মে ঝড়ের কবলে পড়ে এমভি সাথিল-১ লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে নারী শিশুসহ ওই লঞ্চে থাকা ১৬ জন যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় তিনটি মামলা হলেও আজ পর্যন্ত তার কোন অগ্রগতি নেই। ফলে অভিযুক্তদের শাস্তিও হয়নি।

Advertisement

জানা যায়, ২০১১ সালের জুন মাসে রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া ও চর মার্গারেট রুটে চলাচলকারী দুইটি যাত্রীবাহি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। ২০০৫ সালের ১৫ মে চরকাজল সংলগ্ন বুড়াগৌরাঙ্গ নদীতে এমএল ‘প্রিন্স অব পটুয়াখালী’ নিমজ্জিত হওয়ার প্রায় শতাধিক যাত্রীর প্রাণহানী ঘটে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি লোহালিয়া নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রায় দেড়শ লোক নিহত হন। চলতি মাসের ১৫ মে দাশমিনা উপজেলার হাজীরহাট এলাকা থেকে ভোলা জেলার ভোলাইশিং চরে যাত্রীবাহী ট্রলার ঝড়ের কবলে পড়ে বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কাটাখালী নামক স্থানে নিমজ্জিত হয়। সে সময় ২০ জন যাত্রীর মধ্যে ১৮ জনকে স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার করলেও আব্দুল খালেক হাওলাদার (৫০) ও সিরাজুল হাওলাদার (৪৫) নামের দুইজন কৃষকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। গত ১০ বছরে পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদীতে ছোট বড় নৌযান মিলিয়ে প্রায় দুইশ নৌডুবির ঘটনা ঘটে।

অপরদিকে, ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি এমভি শাথিল-১ লঞ্চটি প্রথম দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এরপর লঞ্চটির রুট পারমিট বাতিল করে দেয় নৌ অধিদফতর। কিন্তু কাগজ কলমে শাথিলের নাম পরিবর্তন করে শাতিল লিখে ৪৫ দিনের অনুমতি নিয়ে পটুয়াখালী-রাঙ্গাবালী রুটে ফের ওই বছরের ১৩ এপ্রিল চলাচল শুরু করে। এর মাত্র ২০ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৩ মে রাঙ্গাবালী থেকে পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে গলাচিপার কলাগাছিয়া নদীতে দ্বিতীয় বারের মত লঞ্চটি আবারও ডুবে যায়। এতে ওই লঞ্চে থাকা ৫ শিশু, ৭ মহিলা ও ৪ পুরুষ যাত্রী মারা যান। ফলে তৃতীয় দফায়ও দুর্ঘটনার শিকার হয় ওই লঞ্চটি। তবে দুর্ঘটনার পরে মামলা করা হলে লঞ্চ মালিক, লঞ্চের চালক ও মাস্টারকে আসামি করলেও বিআইডব্লিউটির কোনো কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়নি। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তির আওতার বাইরে রয়ে গেছে। সে সময়ে গলাচিপা থানায় ও মেরিন কোর্টে মোট তিনটি মামলা হলেও বর্তমানে তারও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর অধীনে প্রণীত বিধি অনুযায়ী নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ এবং মাস্টার ও চালকের সনদ যাচাই এবং যাত্রীসংখ্যা গণনার পরই সেটি ছাড়ার অনুমতি দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ দায়িত্ব বিআইডব্লিউটির বন্দর এবং নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্দর কর্মকর্তা ও ট্রাফিক ইন্সপেক্টররা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন না।

Advertisement

রাঙ্গাবালীর মৌডুবি এলাকার যাত্রী মো. রফিকুল বলেন, আইজকাইল আকাশের বাও ভাল না। ঠেইক্কা পরাণডা আতে (হাতে) লইয়া লঞ্চে যাই। বাড়ি, জ্যাতাও পোছতে পারি, মরাও পোছতে পারি। অনেক সোময় তো লাশও পাওন যায় না।

বিআইডব্লিউটি সূত্র জানায়, উপকূলের বিভিন্ন নৌরুটে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে ছোট লঞ্চ ও ট্রলার যাত্রী পরিবহন করছে। রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া থেকে গলাচিপার পানপট্টি, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী থেকে ভোলার লালমোহন, গলাচিপা থেকে চরমোন্তাজ, গলাচিপা থেকে মৌডুবী, উলানিয়া থেকে চরমোন্তাজ, গলাচিপা থেকে নিজকাটা, বাউফলের কালাইয়া থেকে চরমোন্তাজ, চর বিশ্বাস, চরকাজল রুটসহ অভ্যান্তরীণ প্রায় ১৫টি রুটে নৌযান চলাচল করছে। এসব রুটে ঝড়ের মৌসুমে ৬৫ ফুটের কম দীর্ঘ নৌযান চলাচলের ওপর অভ্যন্তরীণ কর্তৃপক্ষের নিষেধজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীবাহী নৌযানগুলোকে উত্তাল নদী পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। অথচ ওই সময়ে প্রাণহানী এবং নৌ-দুর্ঘটনা এড়াতে ছোট যাত্রীবাহি লঞ্চ বা ট্রলার চলাচল বন্ধ করে সিট্রাক বা বড় লঞ্চ চলাচল করলে প্রাণহানীসহ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চান সাধারণ যাত্রীরা।

সরেজমিনে বিভিন্ন লঞ্চে দেখা গেছে, সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে (মার্চ থেকে অক্টোবর) উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন রুটে যেসব যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করে এর মধ্যে অধিকাংশ নৌ-যানের ফিটনেস নেই। রয়েছে যান্ত্রিক ক্রটি। অনেক নৌ-যানের আবার রুট পারমিটও নেই। এছাড়াও নদীপথে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি নৌ-যানে লাইফবয়া (পানিতে ভেসে থাকার জন্য), ফায়ার বাকেট, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, বালুভর্তি বক্স, সার্চলাইট, এবং হস্তচালিত পানির পাম্পের ব্যবস্থা রাখার বিধান থাকলেও তা নেই অনেক নৌযানে। ফলে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর সংখ্যা বহু গুণে বেড়ে যায়।

সাধারণ যাত্রীদের দাবি, প্রশাসনের কড়া নজরদারি থাকলে এসব নিয়ম মেনে চলত নৌযানগুলো। ফলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা আরও কমে যেত।

Advertisement

এ বিষয়ে পটুয়াখালী অভ্যন্তরীণ নৌ-বন্দরের সহকারী পরিচালক খাজা সাদিকুর রহমান বলেন, দুই নম্বর সতর্ক সংকেত দেয়া হলে ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের লঞ্চ বা যাত্রীবাহী যেকোনো ধরণের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। লঞ্চ চলাচলে কোনো অনিয়ম নেই।

মহিব্বুল্লাহ্ চৌধুরী/আরএ/এমএস