স্বপ্ন মানুষকে বড় করে, আবার মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় হয়। দুটো কথাই নিজের জীবনে সত্যি করেছেন মো. অলিউল্লাহ সজীব। আপাদমস্তক একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী। চলচ্চিত্রে কেউ কেউ থাকেন যারা আগে ব্যবসাটাকে দেখেন, তারপর শিল্পচর্চার কথা ভাবেন। আবার কেউ এর বিপরীতও হন। চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি অনুরাগ থেকেই এর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত হন, সেখান থেকে ব্যবসায়ের পথ তৈরি করে নেন। এই মানুষটি সেই দলের। একদিন স্কুল-কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখতেন। এরপর পড়াশোনা ও পেশার খাতিয়ে পাড়ি দেন কানাডায়। কিন্তু সিনেমার নেশা তার যায়নি। নিজের দেশের বাংলা সিনেমা তিনি বিদেশের মাটিতে বসে দেখতে না পারার আফসোস করতেন খুব। দেখতেন নানা ভাষার চলচ্চিত্র কানাডার হলে মুক্তি পায়। কিন্ত বাংলাদেশের সিনেমা আসে না। সেই আফসোস একদিন মনের ভেতর নতুন এক উদ্যম জন্ম দিলো। তিনি ভাবলেন, বিদেশের মাটিতে বসেই বাংলাদেশিরা সিনেমা হলে উপভোগ করবেন দেশের সিনেমা। সেই ব্যবস্থা তিনি নিজেই করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ইচ্ছেশক্তি, পরিকল্পনা, পরিশ্রম, কৌশল আর মেধা থাকলে সাফল্য আসবেই। তিনিও সফল হলেন। আজ বাংলাদেশের সিনেমা বিদেশে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় এবং নির্ভরতার নাম স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো। সেই প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা মো. অলিউল্লাহ সজীব। থাকেন কানাডায়।
Advertisement
আজ ৩ মে বাংলাদেশী সিনেমার আন্তর্জাতিক পরিবেশক স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো’র দুই বছর পূর্তি হতে চলেছে। ১১ নম্বর ছবি হিসেবে ২৭ এপ্রিল কানাডায় মুক্তি পেয়েছে স্বপ্নজাল। ৪ মে মুক্তি পাচ্ছে আমেরিকায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় জাগো নিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলেছেন মো. অলিউল্লাহ সজীব। মনজুর আলমের ক্যামেরায় তার সঙ্গে ছিলেন লিমন আহমেদ
জাগো নিউজ : চলচ্চিত্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না আপনি। তবুও চলচ্চিত্র নিয়ে ব্শিাল এই আয়োজনের ভাবনা কেমন করে এলো?
সজীব : চলচ্চিত্রের মানুষ আমি ছিলাম না সত্যি, কিন্তু শৈশব থেকেই সিনেমার প্রতি দারুণ ভালোবাসা ছিলো আমার। বিদেশি ছবি যেমন ঘরে বসে দেখেছি, প্রচুর বাংলা ছবিও দেখতাম। হলে গিয়ে দেখতাম। বাংলাদেশের প্রায় ৩০ টির মত হলে বিভিন্ন সময়ে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আছে আমার। নায়ক রুবেলের কারাতে আমার খুব ভালো লাগতো। সালমান শাহ এর তো বলা যায় অন্ধ ভক্ত ছিলাম। একটা সময় দেখলাম আমাদের ছবিগুলো আর চলছে না। ভালো ছবি হচ্ছে না। হল কমে যাচ্ছে। শুনতে লাগলাম ব্যবসা নেই। আমি ভাবতাম কেন ভালো সিনেমা হচ্ছে না? কেন সিনেমা চলছে না? আমি দেখতাম বিদেশে ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক সিনেমা যেমন তামিল, তেলেগু সিনেমাও বেশ দাপটের সাথে চলে। অথচ আমাদের এত সুন্দর সিনেমার দেশ, আমাদের ছবি নেই। আমি ভাবতাম যদি বিদেশে আমাদের দেশের সিনেমার বাজার তৈরি করা যায় তবে সিনেমা শিল্পটা দাঁড়ানোর ভরসা পাবে। কারণ সিনেমা নিয়ে একটা প্যাশান আমার মধ্যে ছিলো। আর প্রবাসী হওয়ায় লক্ষ করতাম দেশের সিনেমা দেখার জন্য পাগল সবাই। কিন্তু সেই সুযোগটা নেই। পুরনো ছবিগুলো টিভিতে দেখা যেত বা ইউটিউবে। কিন্তু হলে দেখতে না পারার আক্ষেপ সবার মনেই ছিলো। মাঝেমাঝে কিছু সিনেমা বিশেষ আয়োজন করে দেখানো হতো। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখার যে মজা সেটা ছিলো না। এইসব ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই বিদেশের সিনেমা হলে দেশের সিনেমা মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করবো। প্রবাসী দর্শকের ইচ্ছেটাও পূরণ হবে, বিদেশে দেশের সিনেমার বাজারও তৈরি হবে।
Advertisement
জাগো নিউজ : আজকের স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো গড়ে তোলাটা নিশ্চয় ‘ভাবলাম আর হয়ে গেল’- এমন সহজ কিছু ছিলো না। এর পেছনের গল্পটাও শুনতে চাই.....
সজীব : মোটেও সহজ ছিলো না। অসহায়ের মতো ঘুরাঘুরি করেছি এখানে ওখানে। প্রথমেই কানাডায় বাঙালি কমিউনিটিতে খোঁজ নিলাম এই ব্যাপারে কেউ কেনো উদ্যোগ নিয়েছিলো কী না। দেখলাম যে সিনেমা হল বা অডিটোরিয়াম ভাড়া করে ২/৩ টি শো দেখানো হয়েছে কয়েকটি বাংলাদেশি সিনেমার কিন্ত প্রপার মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল রিলিজের ধারে কাছেও কেউ যায়নি। তাই শুরু করতে হলো নিজেকেই, সম্পূর্ণই নতুন অভিজ্ঞতায়। রিসার্চ করে দেখলাম যে বিদেশে সিনেমা রপ্তানির মূল বিষয়টা হচ্ছে দর্শক। হল মালিক সিনেমা চালিয়ে লাভবান হলে সে সিনেমা চালাবেই। তামিল তলেগেু ছবিই আমাকে সেই উপলব্ধিটা দিলো। কারণ এগুলো এমন কোন অস্কার উইনিং কোয়ালিটির সিনেমা না কিন্তু এদের প্রচুর দর্শক আছে। তখন ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশে। ছবির পরিচালক শিহাব শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো। তিনি বললেন ছবিটার প্রদর্শনী করাবেন কানাডাতে। আমিও চেষ্টা করলাম। যেহেতু এর আগে কমিউনিটি থেকে শুধু বিশেষ প্রদর্শনীই করা হয়েছে, আমাকেও অনেকটা বাধ্য হয়ে শুরুতে সে পথেই হাঁটতে হল। তবে এর মাঝেও আমি ভাবলাম, প্রদর্শনী যখন করবই কানাডার সবচেয়ে বড় মাল্টিপ্লেক্স চেইন, ‘সিনেপ্লেক্স এন্টারটেইনমেন্টে’ই করব। কিন্তু জানেন, শেষ পর্যন্ত সেটাও পারিনি। আমাদের কমিউনিটির কিছু প্রধান ব্যক্তিবর্গের রেসপন্স করতে দেরি করায় সেটা বাতিল হয়ে গলে। কষ্ট পেয়েছিলাম শিহাব শাহীন ভাইকে কথা দিয়ে রাখতে না পারায়। বলা যায়, ওই ব্যর্থতাটাই আমাকে সফল করে দিলো।
জাগো নিউজ : বেশ ইন্টারেস্টিং তো। সেটা কেমন.....?
সজীব : সেটা হলো ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবির প্রদর্শনীর জন্য ‘সিনেপ্লেক্স এন্টারটেইনমেন্ট’র সেলস ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলো। পরে তাকেই সাহস করে মনের কথাটা জানালাম যে আমি কানাডাতে বাংলাদেশি সিনেমা হলিউড, বলিউড সিনেমার মত কমার্শিয়ালি মুক্তি দিতে চাই। সে আমাকে হেল্প করলো। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করিয়ে দিলো। তাদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানতে চাইলো দর্শক চাহিদা আছে কী না, কী ছবি মুক্তি দিতে চাই। আমি জানালাম দর্শক আছে। সেইসঙ্গে ‘অস্তিত্ব’ ছবির ডিটেইলস পাঠালাম। মজার ব্যাপার হলো তখন সবেমাত্র অনন্য মামুনের এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে ‘যেখানেই বাঙালি সেখানেই বাংলাদেশি সিনেমা’ স্লোগান নিয়ে। তাই আমি এই ছবিটাকেই বেছে নিলাম বিদেশে বাঙালিদের কাছে মুক্তি দেয়ার জন্য। এভাবেই স্বপ্নের শুরু, স্বপ্নের পূরণ।
Advertisement
জাগো নিউজ : অনেক কাঠখড় আপনি পুড়িয়েছেন। ছবির মুক্তির প্রথম দিনের উপলব্দিটা কেমন ছিলো জানতে চাই....
সজীব : এর ভাষা নেই। আজও আমি সেই দিন ও সেই অনুভূতিগুলোকে টের পাই। যখন দেখলাম বিদেশের সিনেমা হলের সামনে আমার দেশের সিনেমার পোস্টার ঝুলছে সেই অনুভূতি ছিলো অসাধারণ। তখন আমাদের প্রমোশনটা ছিলো দেশপ্রেমের চেতনায়। আমরা দেখেছি দেশের সিনেমা দেখতে প্রবাসীরা দারুণ সাড়া দিয়েছিলো। আমি প্রতি শোতে গিয়ে গিয়ে দর্শক গুনতাম। দেখতাম কতজন এলো। প্রথমে দশ জন, এরপর বিশ জন, এভাবে ধীরে ধীরে অনেক দর্শক। এরপর মুসাফির, শিকারী, আয়নাবাজি, প্রেমী ও প্রেমী, পরবাসিনী, নবাব, ঢাকা অ্যাটাক, হালদা, গহীন বালুচর মুক্তি দিয়েছি আমরা। এখন চলছে ‘স্বপ্নজাল’।
জাগো নিউজ : এখন পর্যন্ত কোন ছবিগুলো দিয়ে সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন?
সজীব : এখানে বলে রাখা ভালো প্রথম ছবি হিসেবে ‘অস্তিত্ব’ মোটামুটি সাড়া ফেলেছিলো। কিন্তু পরের ছবি ‘মুসাফির’ আমাদের হতাশ করলো। আসলে তখন বলিউডের ‘সুলতান’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো। আমাদের দর্শকরা ‘মুসাফির’ রেখে ‘সুলতান’ দেখল। সেই মন্দার ভাব ‘শিকারী’ ছবির প্রথম সপ্তাহেও থাকলো। আমরা দেখছিলাম শাকিব খানের এই ছবিটা বাংলাদেশে দারুণ চলছে, কিন্তু কানাডায় চলছে না। মনটা খারাপ হয়ে এলো। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘুরে দাঁড়ালো ছবিটি। দর্শক হলে আসতে শুরু করলো। তারপর থেকে মোটামুটি সবগুলো ছবিই দর্শক পেয়েছে। তবে আয়নাবাজির কথা আমি জীবনেও ভুলবো না। ছবিটি প্রথমদিন থেকেই হাউজফুল ছিলো। প্রথম ৩ দনিরে নয়টি শো এর ৭ টি ছলি হাউসফুল। কানাডার ‘সিনেপ্লেক্সে এন্টারটইেনমন্টে’ কর্তৃপক্ষের কাছে তখনই মূলত বাংলাদিশে সিনেমার পায়ের নিচের মাটি শক্ত হয়ে যায়। ‘আয়নাবাজি’ ছবিটি আমাকে দারুণ অনুপ্রেরণা দিলো। আমাকে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখালো। কানাডার টরন্টোতে ছবিটি টানা চার সপ্তাহ চলেছিলো। বলিউডের অনকে বড় ছবির ক্ষেত্রে সাধারণত এমন সাফল্য দেখা যায়। সবমিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার দর্শক ছবিটি দেখেছিলেন। বক্স অফিস আয় ছিলো ৪৮ হাজার ডলার। আমি ভাবলাম যে শুধুমাত্র কানাডা থেকেই যদি ‘আয়নাবাজি’ এত সুপারহিট হয় তবে আমেরিকাতে কেন আমরা বাংলাদেশি সিনেমা দেখাচ্ছি না। সেখানে বাংলাদেশি প্রবাসী কানাডার প্রায় ৭/৮ গুণ। আর মিডল ইস্টে তো আরও বেশি। আমি যোগাযোগ শুরু করলাম ওইসব দেশের প্রধান মাল্টিপ্লেক্স চেইনগুলোর সাথে এবং সফল ও হলাম। কানাডায় ‘আয়নাবাজি’, সবখানে সবখানে বিশেষ করে আমেরিকায় ‘ঢাকা অ্যাটাক’ -কে বাংলাদেশী সিনেমার ব্যবসায়ের গেম চেঞ্জার বলবো আমি। সিনেমা যথাসময়ে না পৌছানোয় নবাব শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে মুক্তি দিতে হয়। সেখানে ভালো চলেছে।
জাগো নিউজ : বর্তমানে কয়টি দেশের সিনেমা হলে আপনারা বাংলাদেশি সিনেমা মুক্তি দিতে পারছেন?
সজীব : বর্তমানে আমরা কানাডার টরন্টো, মন্ট্রয়িল, ক্যালগেরি, উইনিপেগ, এডমন্টন, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটি, লস অ্যাঞ্জেলস, ডালাস, ভার্জিনিয়া ও ফ্লোরিডা, আরব আমিরাতের দুবাই, শারজাহ, আবু ধাবী, আজামান এবং ওমানের মাসকট, সালালাহ, সুর, সোহারে সিনেমা মুক্তি দিচ্ছি। কানাডার ‘সিনেপ্লেক্স এন্টারটেইনমেন্ট’ এর পাশাপাশি আমরা আমেরিকার বিশ্বখ্যাত চেইন ‘রিগ্যাল’, ‘সিনেমার্ক’ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ‘ভক্স’ এর সাথে এনলিস্টেড।
জাগো নিউজ : স্বপ্ন স্কেয়ারক্রোর হাত ধরে ভবিষ্যতে আর কোথায় বিস্তৃত হবে বাংলাদেশি সিনেমার বাজার?
সজীব : বাংলাদেশের সিনেমাকে বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেয়া লক্ষেই স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো যাত্রা শুরু করেছে। সেই যাত্রায় আমরা দিনে দিনে অনেকটা পথ সাফল্যের সঙ্গে এগিয়েছি। সামনে আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। বিশ্বের সব বড় বড় সিনেপ্লেক্সে আমাদের দেশের সিনেমা চলবে। আজকের যেটুকু প্রাপ্তি এটুকু ভাবেননি কেউ। আগামীর সাফল্যগুলোও হবে চোখ ধাঁধানো। হলিউড, বলিউডের ছবির সঙ্গে সমানতালে ব্যবসা করবে আমাদের সিনেমা। সেই সুযোগ আমাদের রয়েছে। কারণ বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশিরা। যারা সিনেমা হলে বসে দেশের সিনেমা দেখতে চায়। এরইমধ্যে আমাদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করছেন। আমরাও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। চলতি বছরেই যুক্ত হবে যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সিনেপ্লেক্সগুলোও। আমরা বিশ্বের সব প্রান্তে আমাদের সিনেমাকে পৌঁছে দেব। তবে এর জন্য সিনেমার মানোন্নয়নের বিকল্প নেই। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে আমাদের ভালো মানের সিনেমা বানাতে হবে।
জাগো নিউজ : সিনেমার মানোন্নয়নে বিশ্বব্যাপী সিনেমার প্রদর্শক হিসেবে আপনার পরামর্শ কী?
সজীব : প্রথমেই বলবো, সিনেমার মত ক্রিয়েটিভ একটা প্রডাক্ট এর কাজ শুরুর আগে একটা প্রপার প্ল্যান প্রস্তুত করা, পর্যাপ্ত রিসার্চ করা যাতে শুটিং শুরু করার আগে ছবি মুক্তির তারিখ নির্ধারণ করা যায়। ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন এর জন্য এটা ভীষণ জরুরি বিষয়। আমাদের দেশের সিনেমার পরিচালকও জানেন না তার ছবিটি কবে মুক্তি পাবে। কিন্তু ব্শ্বি বাজারের একটি সিস্টেম হলো মাল্টপ্লিক্সেগুলো বছরের শিডিউল তৈরি করে রাখে। তারা জানতে চায় কোন ছবিটি কবে রিলিজ হবে। সেক্ষত্রে আমাদেরকে সমস্যায় পড়তে হয়। তাই তারিখ আগে থেকেই নির্ধারণ করা উচিত। দেখবেন হলিউড-বলিউডের বিগ বাজেটের ছবিগুলো মুক্তির তারিখ ঠিক করে তারপর ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি আরও কিছু পরামর্শ দিতে চাই। আমি প্রায় দুই মাস বাংলাদেশে থেকে ইন্ডাস্ট্রিটা ঘুরে ফিরে দেখলাম। আমার কাছে কিছু বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যেমন ছবির কনটেন্ট ভালো ও বৈচিত্রপূর্ণ রাখতে হবে। এটা মাস্ট। গল্প ভালো ও নতুন ধরনরে না হলে ছবি দর্শক দেখবে না। এরপর ভালো গল্পকে ভালোভাবে তুলে ধরতে চাই প্রাঞ্জল ও শক্তপোক্ত চিত্রনাট্য। সিনেমা নির্মাণের সময় আন্তর্জাতিক বাজারের চিন্তাটা মাথায় রাখতে হবে। এতে করে অনেক কিছুই উপলব্ধি করতে পারবেন সিনেমার প্রযোজক থেকে শুরু করে সকল কলাকুশলীরা। প্রচারণায় আরও শক্তিশালী, কৌশলী ও সৃষ্টিশীল হতে হবে। প্রতিটি ছবির জন্য আলাদা একটি ক্রিয়েটিভ টিম রাখতে হবে। এর জন্য আলাদা বাজেট রাখতে হবে। আমাদের শিল্পীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। কাজ চালানোর মত দক্ষতা না, নিজ নিজ দক্ষতায় সেরা হতে হবে। আমি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রশিক্ষণের কোনো চর্চা দেখিনি। শেখার চর্চা বাড়াতে হবে। শিল্পীদের এক্সট্রা অর্ডিনারি ও ইউনিক হতে হবে। অভিনয় তো সে জানবেই কিন্তু বাড়তি কোনো কছিু একটা থাকাটা তার জন্য জরুর। যেমন নায়ক রুবেল ভাই চমৎকার মার্শাল আর্ট পারতেন। এখনকার নায়ক নায়িকাদের এগুলো তৈরি করতে হবে। এবং আবারো বলছি অবশ্যই লক্ষ্য ঠিক করে পরিকল্পনার মাধ্যমে সিনেমা বানানো শুরু করতে হবে।
জাগো নিউজ : একটা বিষয় বলুন, এখন পর্যন্ত আপনার অভিজ্ঞতায় সিনেমা ভালো চলার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো শিল্পী বা পরিচালকের প্রভাব দেখেছেন?
সজীব : তেমনভাবে বলার মতো কিছু নয়। এখানকার দর্শক সবার আগে সিনেমাটা ভাল কিনা সেটাই গুরুত্ব দেন। তবে কিছু দর্শক এই বিষয়গুলোকেও প্রাধান্য দেন বটে। যেমনটা দেখেছি ‘আয়নাবাজি’ ছবির ক্ষেত্রে চঞ্চল চৌধুরীর আলাদা একটা চাহিদা ছিলো, ‘হালদা’ ছবিতে নির্মাতা তৌকীর আহমেদ, ছবির অভিনয়শিল্পী তশিা, জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিমের অনেক ভক্তরা ছবি দেখতে এসেছেন। প্রথম সিনেমা থেকে ঢাকা অ্যাটাক পর্যন্ত আরিফিন শুভকেও পছন্দ করেন অনেকে। মধ্যপ্রাচ্যে শাকিব খানের একটা বাড়তি জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যায়।
জাগো নিউজ : আপনাদের সিস্টেম সম্পর্কে জানতে চাই এবং আপনাদের মাধ্যমে সিনেমা মুক্তি দিয়ে প্রযোজক কীভাবে লাভবান হবেন?
সজীব : খুবই ভালো প্রশ্ন। প্রথমেই সিস্টেম সম্পর্কে বলি। এটা খুবই সহজ বিষয়। এখানে রাষ্ট্রীয় কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয় না। যে প্রযোজক তার সিনেমা বিদেশে আমাদের মাধ্যমে মুক্তি দিতে চান সেই প্রযোজক বাংলাদেশে আমাদের যে অফিস সেখানে যোগাযোগ করবেন। অফিস যাচাই বাছাই করবে ছবিটি বিদেশে মুক্তির যোগ্যতা রাখে কী না। সেক্ষেত্রে মিনিমাম টু কে রেজ্যুলেশনের ক্যামেরায় ছবিটি শুট করা হতে হবে। এর সাবটাইটেল থাকতে হবে। এইসব গুছানো হলেই ছবিটি আমরা আমাদের যেসব মাল্টিপ্লেক্স রয়েছে সেখানে পাঠাবো। ছবি হলগুলোতে পাঠানো, সেন্সর করানো, এর প্রচার-প্রচারণার সব খরচ আমরাই বহন করবো। প্রযোজককে শুধু ভার্চুয়ালপ্রিন্ট ফি (ভিপিএফ)টা দিতে হয়। আর প্রযোজকের মুনাফা পাবার হিসেবটাও সহজ। রেন্ট্রাক (কমস্কোর) নামে সারা পৃথিবীর বক্স অফিস ডাটাবেজ আছে যেখানে সবগুলো মাল্টিপ্লেক্স রিপোর্ট করে। যেখান থেকে জানা যায় কোন ছবিটি কতো টাকা আয় করেছে। গ্রস বক্স অফসি আয় থেকে ১৩-১৫ শতাংশ (কানাডা ও আমেরিকায় ১৩ শতাংশ। তবে কিছু কিছু দেশে ১৪ এবং ১৫ শতাংশ) ট্যাক্স কেটে রাখার পর যে আয়টা থাকে সেটাকে বলা হয় নটে আয়। তার থেকে কোনো কোনো দেশের মাল্টিপ্লেক্স ৫০ শতাংশ নেয়, কোনো কোনো দেশে নেয় ৫৫ ভাগ। কেউ কেউ আবার ছবি ভালো চললে ২-৪ শতাংশ বোনাস দেয়। আমরা ‘আয়নাবাজি’ চালিয়ে কানাডার ‘সিনেপ্লেক্স’ থেকে ২ শতাংশ বোনাস পেয়েছিলাম। যাক, তো মাল্টিপ্লেক্স তার ভাগ নেয়ার পর যেটা থাকে সেটার ফিফটি ফিফটি আমাদের এবং প্রযোজকের মধ্যে ভাগ হয়। এটা খুবই সহজ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি।
জাগো নিউজ : সিনেমায় প্রযোজনায় এসেছিলো স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো। নতুন কোনো আপডেট আছে কী?
সজীব : আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু নানা কারণে সেটি একটু পিছিয়েছে। তবে নতুন আরো কছিু চিত্রনাট্য তৈরির কাজ চলছে। আমরা কমিকস, মার্শাল আর্ট, ক্রিকেট নিয়ে ছবি করতে চাই।
জাগো নিউজ : বাংলাদশে সফরের অভজ্ঞিতা কেমন? আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
সজীব : রেগুলার ডিস্ট্রিবিউশন এর বাইরে আমরা বিভিন্ন ধরনের ছবি নিয়ে উৎসব করতে চাই। যেমন হূমায়ুন আহমেদ সপ্তাহ, সালমান শাহ সপ্তাহ, নায়করাজ সপ্তাহ, ক্লাসিক মুভি নিয়ে, সাহিত্য র্ধমী ছবি নিয়ে, বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি নিয়ে আলাদা আলাদা উৎসব করবো। ইচ্ছে আছে হলিউড-বলিউড স্টাইলে অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান করার। যেগুলো বিশ্বের দামি শহরগুলোতে অনুষ্ঠিত হবে। ছবি মুক্তির সময় লাল গালিচায় ছবির কলাকুশলীদের সংবর্ধনার আয়োজন করতে চাই। বাংলাদেশ সফরে আমি পরিচালক সমতি, শিল্পিী সমতিসিহ আরও অনকেরে সঙ্গে বসেছি, কথা বলেছি। অনেক পরিকল্পনা করেছি। রুবেল, শাকবি খান, মৌসুমীসহ অনকে তারকার সাথেও শুভচ্ছো বিনিমিয় হয়ছে। তারাও অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। বাচসাস’র সাথে বছরের সেরা সাংবাদিকদের নির্বাচন করে তাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের। বিশ্বের জনপ্রিয় ও বড় মাল্টিপ্লেক্সের চেইন বাংলাদেশে চালু করার প্ল্যান আছে। আশা করছি সামনে অনেক ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে বাংলাদেশি সিনেমার জন্য।
জাগো নিউজ : বিশ্বের অনেক দেশেই সিনেমার বাজার তৈরির পরিকল্পনার কথা জানালেন। কিন্তু প্রতিবেশি দেশগুলো, বিশেষ করে ভারতের বাজার নিয়ে কিছু ভাবছেন না?
সজীব : এখন পর্যন্ত না। কারণ সেখানে সিনেমা রিলিজের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। তাছাড়া ভারতে বেশ কিছু ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি রয়েছে যাদের সঙ্গে মাল্টেিপ্লক্সগুলোর চুক্তি রয়েছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশি সিনেমার ভালো বাজার হতে পারতো। কারণ সাফটা চুক্তিতে সেখানে বাংলাদেশি ছবিগুলো উপেক্ষিত থাকে। কারণ সেখানে সবাই মূল কলকাতার ছবিগুলো বাংলাদেশে চালাতেই বেশি আগ্রহী থাকেন। কোনো ডিস্ট্রিবিউটর প্রতিষ্ঠান ঢাকার ছবিগুলোকে গুরুত্ব দেন না। যার ফলে কলকাতার ভালো ভালো সিনেমার পরিবর্তে ঢাকা থেকে তুলনামূলক কম মান ও বাজেটের ছবিগুলো পাঠানো হয়। সেইসব ছবির না থাকে তেমন প্রচার না হয় হলে প্রদর্শনীর সঠিক ব্যবস্থা। এই জায়গাটিতে আপনাদের ভূমিকা বাংলাদেশি সিনেমার জন্য সুবিধার হতে পারতো বলে মনে করেন না?
সজীব : সত্যি কথা বলতে এভাবে ভেবে দেখা হয়নি। আপনার এই প্রশ্নটিকে আমরা পরামর্শ হিসেবে নিলাম। বাংলাদেশি ছবি কলকাতাসহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা হলে চালানোর ব্যাপারে আমরা পরিকল্পনা করবো।
জাগো নিউজ : শেষবেলায় আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই......
সজীব : আমার জন্ম কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। বাবা তোফাজ্জল হোসেন ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। মা রোকেয়া আক্তার খাতুন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। পড়াশুনা সূত্রে পশো র্ফামাসস্টি। পড়াশুনা সূত্রে পেশা ফার্মাসিস্ট। কানাডায় রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট হওয়ার জন্য সবগুলো পরীক্ষা সাফল্যের সাথে শেষ করেছি। স্ত্রী সুরভী নাজনীন লাকী চাকরি করছেন বাংলাদেশেই, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে।
এলএ/আরআইপি