চালকদের বেপরোয়া গতি আর ক্লান্তিহীন পরিবহন পরিচালনায় প্রতিনিয়ত সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। মরছে মানুষ, বরণ করছে পঙ্গুত্ব। কিন্তু নেই কোনো কার্যকর প্রতিকার ব্যবস্থা। ফলে সড়কে পা ফেলার আগেই সাধারণ মানুষের মাঝে প্রাণ কিংবা অঙ্গহানির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
Advertisement
দুর্ঘটনা রোধে মিছিল-মিটিং এমনকি সভা-সেমিনার করেও প্রতিকারে নেই কার্যকর কোনো উদ্যোগ। দুর্ঘটনা রোধে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ না থাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা। সাধারণ মানুষের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।
নেশা করে গাড়ি পরিচালনা, মানসিক বৈপরীত্য ও নৈতিক স্খলন আর খামখেয়ালিপনায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে সড়কের অঙ্গহানি ও প্রাণ হারানোর ঘটনা। সাধারণের মতে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের সুদৃষ্টির অভাব সেই সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আর আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় এসব ঘটনা বেড়েই চলেছে। চালকদের এমন বৈপরীত্য ঠেকাতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
অপরাধ বিশেজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয় না। আবার মামলা হলেও নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘসময় লাগে। ফলে ভুক্তভোগীরা হতাশ হয়ে পড়েন। অন্যদিকে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিতের ক্ষেত্রে কোনো শঙ্কাবোধও করেন না। এ কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব অপরাধ।
Advertisement
গত এক মাসে (এপ্রিল) মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শরীর থেকে অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাজীব, হৃদয়, রোজিনা ও রাসেলের। একেকটি দুর্ঘটনায় যেন একেকটি স্বপ্নের মৃত্যু হয়। বয়সে সবাই ছিলেন তরুণ। তাদের ওপর নির্ভর করেছিল অসহায় ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো। কিন্তু চালকদের বৈপরীত্যে স্বপ্নগুলোর মৃত্যু হলো।
স্বপ্নপূরণের সংগ্রামে লিপ্ত রাজীব আর রোজিনা হয়তো একটু বেশি অভিমান করেছিলেন। কারও আশ্রয়-প্রশ্রয় বা অনুগ্রহ নয়, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন, সেখানেও বাগড়া বাধায় উচ্ছৃঙ্খল চালকদের চরম খামখেয়ালিপনা। অঙ্গহানির পর বেঁচে থাকার স্বাদই তারা যেন হারিয়ে ফেলেন। এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন গোপালগঞ্জের পরিবহন শ্রমিক হৃদয় এবং গাইবান্ধার পলাশবাড়ির একটি ‘রেন্ট-এ-কার’ প্রতিষ্ঠানের প্রাইভেটকার চালক রাসেল।
গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুটি বাসের রেষারেষিতে ঘটনাস্থলে ডান হাত হারান মা-বাবা হারা রাজীব হোসেন (২১)। টানা ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেন তিনি। অবশেষে ১৭ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান। তার মৃত্যুর একদিন পর অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যাত্রীবাহী একটি বাসকে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয় দ্রুতগতির একটি ট্রাক। এতে পরিবহন শ্রমিক খালিদ হাসান হৃদয়ের (২২) ডান হাত ঘটনাস্থলেই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হৃদয় এখনও চিকিৎসাধীন। এরও দুদিন পর অর্থাৎ ২০ এপ্রিল রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকায় বিআরটিসির বাসচাপায় গৃহপরিচারিকা রোজিনা আক্তারের (১৮) শরীর থেকে ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
টানা আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে নিম্নবিত্ত পরিবারের একমাত্র ভরসার স্থান রোজিনাও চলে যান না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুর দিনই অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় এলাকায় হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে গ্রিনলাইন পরিবহনের চাপায় শরীর থেকে বাম পা বিচ্ছিন্ন হয় রাসেল সরকারের। তিনি এখনও চিকিৎসাধীন।
Advertisement
নির্মম এসব ঘটনার পরও থেমে নেই চালকদের বেপরোয়া গতি। গত ১ মে দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পোস্তাগোলা ব্রিজের ওপর একটি সিএনজি অটোরিকশাকে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় মো. হালিম নামে (৪০) এক যাত্রীর ডান পায়ের হাড় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তিনি এখন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন।
হাত-পা হারানো আহত ও নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তারা কেউ এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় অপরাধীর শাস্তি পেতে দেখেননি। এমনকি রোজিনা যখন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, সেই সময় তার পা কেড়ে নেয়া ঘাতক বাসচালক জামিনে বের হয়ে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর খবরও প্রকাশ পায়।
বিষয়টি জানার পর রোজিনার স্বজনরা আরও বেশি হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে থাকলেও শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে তারা আরও বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো এবং ৩৭ শতাংশ চালকের বেপরোয়া মনোভাব। অর্থাৎ সড়কে দুর্ঘটনার জন্য ৯০ শতাংশই দায়ী চালক নিজেই। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলছে, চালকদের প্রশিক্ষিত না করে গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া, তাদের দক্ষতা যাচাই না করা এবং সেই সঙ্গে সড়ক আইনের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবহিত না করেই লাইসেন্স দেয়ায় মূলত এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে।
এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জনের সঙ্গে। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে সেটি একেবারেই অপর্যাপ্ত। আবার ওই ক্ষতিপূরণ আদায়ও খুব কঠিন। যে কারণে অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে, ঘটাচ্ছে নতুন নতুন অঘটন। যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
‘এছাড়া অবকাঠামোগত কিছু সমস্যাও রয়েছে। রাজধানীতে গাড়ির তুলনায় পর্যাপ্ত সড়কও নেই। হাইওয়ে থাকলেও যেভাবে থাকার কথা সেভাবে নেই। রয়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, নিয়ম না মানার প্রবণতাও বেশ। অপরাধের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, তারাও উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না, বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা’- যোগ করেন তিনি।
এসএইচ/এমএআর/বিএ