জগতে অনেক সম্পর্কই ইতিহাস হয়ে আছে। যেসব পাঠ করতে গেলে বা গল্পছলে শুনতে গেলে মুগ্ধতায় পেয়ে বসে। তেমনি মধুর সম্পর্ক ছিলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে। দুজনের বয়সের পার্থক্য ছিলো ষাট বছর। তবুও অনেক কিছুই মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলো তাদের সম্পর্কে। কবিগুরুর সান্নিধ্য সত্যজিৎকে সমৃদ্ধ করেছিলো।
Advertisement
দুজনেই জন্মেছিলেন মে মাসে। রবীন্দ্রনাথের ৭ তারিখ আর সত্যজিতের ৫ তারিখে। দুজনেই বাঙালি হিসেবে জয় করেছিলেন বিশ্ব। একজন পেয়েছিলেন সাহিত্যের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদার স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার, অন্যজন জয় করেছিলেন চলচ্চিত্রের সবচেয়ে দামি অস্কার পুরস্কার।
পারিবারিকভাবে ঠাকুর পরিবার আর রায় পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের সুন্দর সম্পর্ক ছিল। সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। আর পিতা সুকুমার রায় ছিলেন বিশ্বকবির পরম স্নেহভাজন।
সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যপার ছিলো। তবে দুজনের দেখাটা বিখ্যাত হয়ে রইলো কবিগুরুর জন্যই। তখন সত্যজিতের ১০ বছর বয়স। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার প্রথম দেখা শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায়। সত্যজিতের মা সুপ্রভা রায় পুত্র সত্যজিৎকে নিয়ে গিয়েছিলেন গুরুর আশীর্বাদ নেবার জন্য। সত্যজিৎ রবি ঠাকুরের সামনে একটা অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খাতার উপর তাৎক্ষণিক সই না করে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি উত্তরায়ণে।
Advertisement
পরদিন এসে খাতাটা নিয়ে যেতে বললেন সত্যজিৎকে। তিনি এলেন। সকালবেলা রবীন্দ্রনাথ ফেরত দিলেন সে খাতা। সেখানে লেখা ছিলো- ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।।’ এই কবিতাটি কবিগুরুর বহুল জনপ্রিয় একটি কবিতা হয়েছিলো পরবর্তীতে।
রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিতের সম্পর্ক এখান থেকেই শুরু হয়। এরপর সারাটা জীবন কবিগুরুর জীবনবোধ, সাহিত্য, ভাবনা-দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৩৭ সালে সত্যজিতের মা রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে নিজ পুত্রকে বড় করতে ভর্তি করেন শান্তিনিকেতনে। সত্যজিতের বয়স তখন ১৬।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু অবধি তিনি শান্তি নিকেতনেই কবিগুরুর স্ব-স্নেহে বেড়ে ওঠেন এবং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অনেক পরে সত্যজিৎ যখন চলচ্চিত্রকার হিসেবে আবির্ভূত হন, তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য একে একে বেছে নেন রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস।
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু গানও ব্যবহার করা হয়েছিল। তার মধ্যে ‘কথাচিত্রে রবীন্দ্রনাথ’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘ঘরে-বাইরে’,‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজংঘা’, ‘মহানগর’, ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ’, ‘অশনি সংকেত’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘জন-অরণ্যে’, ‘আগন্তুক’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হয়েছে।
Advertisement
১৯৪৫ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চলচ্চিত্র-রূপ লেখেন সত্যজিৎ। কিন্তু তখন ছবিটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। নির্মাণে তখন তার কাঁচা হাত। এর প্রায় ৪০ বছর পর তিনি নতুন করে চলচ্চিত্ররূপ লিখে ছবিটি তৈরি করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি কবিগুরুর তিনটি ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘তিন কন্যা’।
একই বছর তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। ১৯৬৪ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেন ‘চারুলতা’। বলার অপেক্ষা রাখে না, কবিগুরুর এইসব গল্প-উপন্যাস নিয়ে নির্মিত সত্যজিতের ছবিগুলো বাংলা চলচ্চিত্রের আর্কাইভে সেরা সংযোজন হয়ে আছে।
বলা হয়ে থাকে যে সত্যজিতের সবচেয়ে নিখুঁত চলচ্চিত্রের নাম চারুলতা। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পদক, বার্লিন ও মেক্সিকো চলচ্চিত্র উত্সবে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়। সত্যজিৎ এরপর বড় পুরস্কার পান ‘ঘরে বাইরে’র জন্য, এটি ১৯৮৪-তে ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে পুরস্কার পায়। সত্যজিত্ তাঁর সারাজীবনের কাজের জন্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার অস্কার পেয়েছিলেন।
এলএ/আরআইপি