‘প্রথম যখন এ পথে আসি, তখন শরীরের দাম ভালো ছিল। রাতভর কাজ করতাম। বেশ আয় হতো। এখন শরীরে ভাটা পড়েছে। পুরুষ মানুষ তো মনের চাইতে শরীরের খবর বেশি রাখে। শরীর ভেঙে পড়েছে। চাহিদাও কমেছে। দিন যাচ্ছে, শরীরের দামও কমছে।’
Advertisement
মে দিবসের কান্না। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক নারীর বেদনা ভরা আকুতি। নামেই কর্মী। যৌনকর্মী রত্নার শরীর এখন আগের মতো সায় দেয় না। যৌনকর্ম যে পেশা না, পেশা হয়ে উঠতে পারে না, সমাজ কোনোদিনই তার স্বীকৃতি দেবে না, তা রত্নাও জানে। নইলে রাত চারটার দিকে অন্ধকার চোরা গলিতে টিপে টিপে পা ফেলা কেন অসহায় এই নারীর!
রাজধানীর মিরপুর রোডে মেট্রোরেলের ধুম কাজ হচ্ছে। সড়কের মাঝে কংক্রিটের দেয়াল তুলে কাজ হচ্ছে রাতভর। দিনে জ্যামে আটকা থাকা যানবহন রাত ভারি হলেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মে দিবসের আবহ কাজ করছিল ভোর রাত থেকেই। সড়কে পরিবহন কম। অন্ধকার তখনও কাটেনি। মসজিদে মসজিদে মোয়াজ্জিন ফু দিয়ে মাইক চেক করছেন। মিরপুর-১০ থেকে কাজীপাড়ার দিকে আসতেই ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে এক নারীর দেখা। যানবাহন হালকা থামিয়ে কেউ নজর ফেলছেন, কেউ টল করছেন নারীকে।
বাইকে দাঁড়িয়েই কথা। পরিচয় পেয়ে সড়কে নেমে এসে আলাপ জুড়লো। বাড়ি নেত্রকোনায়। বাবা-মা পাকিস্তানে থাকতেন। জন্ম পাকিস্তানেই। পরে দেশে ফেরা। দুই ভাই পাকিস্তানেই থাকেন। আরও দুই ভাই থাকেন সৌদি আরবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরলেও ফের পাকিস্তানে ভাইয়ের বাড়িতে যান কিশোরী বয়সে। সেখানেই ভাইয়ের বন্ধুর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে। স্বামীও বাংলাদেশি। এরমধ্যে বাবা-মায়ের মৃত্যু হয়। কিছুদিন পর দেশে ফিরে স্বামীর সঙ্গে গার্মেন্টে চাকরি নেন। দু’জনের চাকরিতে সচ্ছলতা ফিরে আসে সংসারে। নেত্রকোনা থেকে মামাতো বোনেও এসে গার্মেন্টে যোগ দেয়। থাকেন রত্মার কাছেই।
Advertisement
এই মামাতো বোন-ই সর্বনাশের পত্তন গড়ে রত্নার। রত্নার স্বামীর সঙ্গে ভাব জমতে থাকে মামাতো বোনের। এর আগে রত্নার ঘরে এক ছেলে সন্তানও জন্ম নেয়। সন্তান কোলে থাকা অবস্থায় স্বামী রত্নার মামাতো বোনকে নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই যে সুখ পাখি উড়াল দিলো, আজও অধরা রত্নার।
দুঃখের সাগরে যখন ডুবুডুবু তরী, তখন আরও এক ঘা আসে জীবনে। নেত্রকোনা যাবার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন রত্না। মাথা ভর্তি শেলাই। শেলাইয়ের দাগ কপালে এসে ঠেকছে। দুর্ঘটনার পর আর ফেরা হয়নি চাকরিতে। সাত বছরের ছেলে কুমিল্লা দাউদকান্দি মাদরাসায় পড়ে। শরীর বেচা আয় থেকেই ছেলেকে মাসে ৭ হাজার করে টাকা দিতে হয়। ভাইয়েরাও আর খবর রাখে না রত্মার।
অসীম দরিয়ায় বেঁচে থাকা ৩৫ বছর বয়সী রত্নার একমাত্র সম্বল জীর্ণসার শরীরটুকু-ই। তাও এখন আর আগের মতো কাজ করে না। গলার হাড্ডি বেরিয়ে আসছে প্রায়। চোখ গর্তে ঢুকে যাওয়া। চুলে কোনকালে সাবান-শ্যাম্পু পড়েছিল, তা হয়তো দিনগুণেও বলতে পারবে না। সারারাত জেগে মাত্র একজন খদ্দের মিলেছিল আজ। গলিমুখে বৃষ্টিভেজা পথে কাজ করেছেন বলে, জামা-কাপড় অর্ধভেজা তখনও।
জীবনকথা বলতে গিয়ে চোখও ভিজে উঠল রত্নার। গর্তে ঢোকা চোখে দু’ফোটা জল আলো-আঁধারের মাঝেও আড়াল করতে পারল না। আলাপ না ফুরাতেই পূর্ব আকাশে মহান মে দিবসের আভা ফুটে উঠল।
Advertisement
এএসএস/এমআরএম/এমএস