রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে শনিরআখড়া ব্রিজের (আন্ডার পাস) ঢালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম সড়কের মুখে ভোর ৬টা হতেই একজন-দুইজন করে আসতে থাকেন তারা। সূর্য যখন মুঠি মুঠি আলো ছড়িয়ে পূর্ণোদ্যমে দিনের যাত্রা শুরু করে তখন সংখ্যায় শ’পাঁচেক হয়ে যান। তাদের কারও হাতে কোদাল, কারওবা হাতে কর্নি, টুকরি-তাগার, রঙের বালতি অথবা হাতুরি-বাটাল।
Advertisement
তারা সবাই দিনমজুর, শ্রম বিক্রি করে ঘোরে জীবনের চাকা। সেই শ্রম বিক্রির জন্য প্রতিদিন ক্রেতার আশায় এখানে এভাবেই ভিড় জমান তারা।
এসব দিনমজুরের কেউ রাজমিস্ত্রী, কেউবা কাঠমিস্ত্রী, মাটিকাটা শ্রমিক, রঙমিস্ত্রী অথবা ইট, বালু ও রড টানা শ্রমিক। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টি-বাদলের মৌসুম হওয়ায় এখন নির্মাণ কাজ কমে গেছে। সেই সঙ্গে কমেছে শ্রমিকদের চাহিদাও। সপ্তাহে তিন-চার দিন ও মাসে ২০ দিনের বেশি কাজ পান না তারা। তাই অভাবকে সঙ্গী করে কষ্টেসৃষ্টে জীবন চলছে তাদের।
জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, মগবাজার, মিরপুর, নতুনবাজার, মানিকনগর, নয়াবাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এ ধরণের শ্রম বিক্রির বেশ কয়েকটি অস্থায়ী বাজার আছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
Advertisement
সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শ্রমিকরা এখানে অবস্থান করেন। যারা কাজ করাবেন তারা এসে দরদাম করে শ্রমিক নিয়ে যান। কাজের জন্য তাদের বহু দূর-দূরান্তে পর্যন্ত যেতে হয়।
রোববার সকাল ৮টার দিকে গিয়ে দেখা গেছে, শত শত শ্রমিক সেখানে ভীড় জমিয়েছেন। তাদের কেউ দাঁড়িয়ে আছেন, আবার জিনিসপত্র কাছে রেখে বসে আছেন কেউ। কাজের জন্য শ্রমিক প্রয়োজন এমন কোনো লোক আসলেই, অনেকে ঘিরে ধরছেন তাকে। তবে ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম।
বিভিন্ন শ্রেণির কয়েক জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজমিস্ত্রীদের দৈনিক মজুরি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাঠমিস্ত্রীদের ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, রঙমিস্ত্রীদের ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং মাটিকাটা ও ইট-বালি টানা শ্রমিকদের ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের আব্দুল জলিল (৭৩) সেই পাকিস্তান আমল থেকেই রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘২৫ থেকে ৩০ বছর ধইরা দেখতাছি এইহানে পেত্যেকদিন শ্রমিকরা আহে। এখন শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বাইরা গেছে, কিন্তু কাম বারে নাই। ৪০০-৫০০ শ্রমিক এইহানে আহে। এর অর্ধেক প্রতিদিন কাম পায় না।’
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘শীতের দিনে মানুষ বাড়ি-ঘরের কাম করে, তখন শ্রমিকের চাহিদা থাহে। বৃষ্টির দিনে কাম কইম্মা যায়। কয়েকদিন ধইর্যা কাম খুব কম।’
রোববার সকালে হঠাৎই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। জোর ঠাণ্ডা বাতাসে বৃষ্টি নামার আভাস। সবার থেকে আলাদা হয়ে একটু দূরে হাতে কর্নি ও তাগার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজমিস্ত্রী সোহেল। কিছুটা বিষন্নতা লেপ্টে আছে তার চোখেমুখে। কথা বলতে খুব বেশি আগ্রহ নেই। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই কী মনে করে যেন কথা বলার উৎসাহ পান। জানান, তার বয়স ৫৫ বছরের মতো। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে। সপ্তাহে ৩-৪ দিনের বেশি কাজ পান না।
বাকি দিনগুলো কীভাবে চলে- জানতে চাইলে তার মনে যেন আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়ে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘খুব কষ্ট অয় বাবা। আমি অত বড় রাজমিস্ত্রী না। শরীলেও আর আগের মত কুলায় না।’
এরপর তিনি বলে চলেন, ‘আমার তিন সন্তান। দুই ছেলে এক মেয়ে। এক ছেলের বয়স ১০ বছর, আরেক ছেলের বয়স ৫ বছর। মেয়ের বয়স ১১ বছর। আগে বউ বাচ্চা নিয়া ঢাকায়ই থাকতাম। কাজের ঠিক-ঠিকানা নাই। একদিন অয় তো তিন দিন অয় না। খরচে আর কুলাইতে পারি না। তাই বউ-বাচ্চাগো আবার দ্যাশে রাইখ্যা আইছি। এখন আমি এক আত্মীয়ের বাসায় খরচ দিয়া থাহি-খাই।’
শ্রমিক ইসমাইল মিয়ার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে, জসিমের ভৈরবে। তারা দু’জনই জানান, মাসে ২০ দিনের মতো কাজ পান। বাকি সময় ওই টাকা বাঁচিয়ে চলতে হয়। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
শ্রমিক জমির আলীর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি বলেন, ‘শীতে কাজ-কাম বেশি থাহে। এখন কম। সামনে আরও কমবো। ম্যাসে যারা থাকে তাগোই এখন কষ্ট অইতাছে। আর যারা ফ্যামিলি নিয়া থাকে তাগো কতা কইয়া লাভ নাই।’
শ্রমিক ইকবাল হোসেন বয়সে তরুণ, গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। তিনি বলেন, ‘গোবিন্দপুরে আমি একটি বাসায় পরিবার নিয়া থাহি। কাম কম পরিবার নিয়া থাকতে কষ্ট অইতাছে ভাই।’
মাটিকাটা শ্রমিক আবু সাঈদ বলেন, ‘যখন কাম থাকে না তখন আমরা ক্যামনে চলি ভাই। সরকার আমাদের তো একটু সাহায্য করতে পারে। তাইলে আমরা ভাল থাকতে পারি।’
আরএমএম/এমএমজেড/এমএস