তিন বছর আগের ঘটনা। ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিলেন অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. লিটন (৪০)।
Advertisement
এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে গেছে। বৃষ্টি থামছে না। তার মতো আরও কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্স চালক বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর পাজাকোলা করে এক যুবককে তার স্বজনরা জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলেন। শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে একাধিক ক্ষত। সেই ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরছে। তার একটি হাত চামড়ার সঙ্গে ঝুলে রয়েছে। অবস্থা সংকটাপন্ন। পাশে দু’জন নারী চিৎকার দিয়ে কাঁদছেন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে দ্রুত রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। ততক্ষণে বৃষ্টির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।
স্বজনরা অ্যাম্বুলেন্স চালকদের খোঁজ করতে শুরু করলেন। জরুরি বিভাগের সামনে কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে কথা বললেন। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কেউই যেতে রাজি হলো না। কয়েকগুন বেশি ভাড়ায়ও তারা যেতে রাজি নন। স্বজনরা বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন।
এমন সময় তাদের সামনে গিয়ে লিটন বললেন, রোগী নিয়ে আসেন। রোগীসহ তার ৫ স্বজনকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো অ্যাম্বুলেন্স। গাড়ির গতির সঙ্গে বাতাসের গতিবেগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রমের পর কাল বৈশাখী ঝড় শুরু হয়। শুরু হয় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতও। প্রচণ্ড ঝড়ে সড়কের উপর গাছ উপড়ে ও ডাল ভেঙে পড়ছিল। কিছু দূর পর পর অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে উপড়ে পড়া গাছ ও ভাঙা ডাল সরিয়ে চলতে হচ্ছিল পথ। নিরাপদ কোথাও আশ্রয় নেয়াও সম্ভব ছিল না। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই রোগীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কায়। স্বজনরা ততক্ষণে রোগীর বেঁচে ওঠার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু লিটন মোটেও ভরসা হারাননি। গাড়ির গতি বেগ বাড়িয়ে দেন তিনি।
Advertisement
অবশেষে রাত ৪টার দিকে তারা পৌঁছান ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীকে। রোগীর স্বজনরা ভাড়া মিটিয়ে দিলেও পঙ্গু হাসপাতালে অপেক্ষা করছিলেন লিটন। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, রোগীর একটা হাত রাখা সম্ভব হয়নি। তবে রোগী এখন আশঙ্কামুক্ত। খবর শুনে রোগীর স্বজনরা আবেগ আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরে লিটনকে। পুরনো স্মৃতি হাতড়ে কথাগুলো বলছিলেন লিটন। তিনি বলেন, সেই দিনের স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি। রোগীকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর পর যখন সুস্থ হওয়ার খবর শুনি, তখন শান্তি পাই। কেউ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলে তার মুখটা দেখে বুকটা ভরে যায়।
লিটন বললেন, ১৯ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছি। এরকম অনেক ঘটনা আছে। বলেই আরেকটি ঘটনা বলতে শুরু করলো। চার বছর আগের ঘটনা। মেডিকেলের সামনে বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক কামরুল মিয়ার স্ত্রী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বরিশাল মেডিকেলের চিকিৎসকরা রোগীকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলেন। তখন ঢাকায় অবরোধ চলছিলো। অবরোধের কারণে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের খবর আসছিলো। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সেও নাকি ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। এমন খবরে কোনো চালক ঢাকায় যেতে চাচ্ছে না। কামরুল মিয়ার অনুনয় বিনয়ও মন গলাতে পারছেন না চালকদের। এবারও এগিয়ে এলেন লিটন। কামরুল মিয়া ও তার স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই রাজধানীর পান্থপথ পর্যন্ত পৌঁছে যান তারা। পান্থপথে পিকেটারদের বাধার মুখে পড়ে তার অ্যাম্বুলেন্স। কিছুটা দূরেই যানবাহনে ভাঙচুর করা হচ্ছে। তাই সামনে আর গাড়ি এগোচ্ছে না। আনেকগুলো গাড়ি আটকা পড়েছে। পেছন দিকে যাওয়ারও উপায় ছিল না। রোগীর অবস্থা আরও খারাপের দিকে। শেষ পর্যন্ত সড়কে দুই চাকা আর ফুটপথের উপরে দুই চাকা উঠিয়ে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চালাতে শুরু করলেন লিটন। পিকেটারদের বাধা এড়িয়ে রোগীকে পৌঁছে দিলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। তারপর বরিশালে ফিরে এলেন।
এদিকে কামরুল মিয়ার স্ত্রী প্রাণপণ লড়াই করেছেন যমদূতের সঙ্গে। একসময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। সিসিইউ থেকে সাধারণ বেড হয়ে অনেক দিন পর বাড়ি ফিরলেন কামরুল মিয়ার স্ত্রী। এরপর একদিন সস্ত্রীক কামরুল মিয়া লিটনের কাছে এসে হাজির। কামরুল মিয়া হাসতে হাসতে বললেন, সুস্থ হয়ে সে দেখতে চাইছে ওই অ্যাম্বুলেন্স চালককে। যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহায্য করেছেন। তাকে দেখতেই আজ আসা। কামরুল মিয়া লিটনকে বলেছিলেন, সেদিন সাহায্য না পেলে তার স্ত্রীকে হয়তো বাঁচানো যেতো না। লিটন বলেন, রোগীর স্বজনদের মুখে যে হাসি দেখি তাতে মন ভরে যায়। তবে অবরোধের সেই দিনের দুঃসহ সেই স্মৃতি লিটনের মতো কামরুল মিয়ারও মনে দাগ কেটে যায়। অ্যাম্বুলেন্স পেতে বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির ঘটনা কামরুল মিয়াকে পীড়া দিতে থাকে। এর কিছুদিন পর কামরুল মিয়া তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় করেন।
লিটন বলেন, রোগী বহন ব্যবসা নয়, এটা সেবা। মানুষের উপকারের সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ের সংসার চলে যায়।
Advertisement
তবে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে অনেক সময় অনাকাঙ্খিত ঘটনারও সম্মুখীন হতে হয়। মারধরের শিকার হতে হয়েছে কয়েকবার। ৬ বছর আগের ঘটনা। পটুয়াখালী জেলার গলাচিপার এক গ্রামে এক ডাকাতকে ধরে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে গ্রামবাসী। যতদূর মনে পড়ে নাম হবে মো. আবু মিয়া। অবস্থা খারাপ দেখে গলাচিপা হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয় বরিশাল মেডিকেলে। ভর্তির কয়েকদিন পর তার মৃত্যু হয়। লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে আবু মিয়ার স্ত্রী ৩৫শ টাকায় লিটনের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নেন। রওনা হওয়ার আগে গাড়িতে তেল ভরতে ১২শ টাকা দেন। তেল ভরা হলে মৃত আবু মিয়া ও তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে গলাচিপার উদ্দ্যেশে রওনা দেই। আবু মিয়ার গ্রামে গেলে লাশ নামাতে বাধা দেয় গ্রামবাসী। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে লাশ নামাতে গেলে হামলা করে বসে এলাকাবাসী। মারধরে আহত হন অ্যাম্বুলেন্স চালক লিটন। তবে সাহস হারাননি। তখন গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে লিটন বলেছিলেন, বেঁচে থাকতে আবু মিয়া ডাকাতি করে অপরাধ করেছে, তবে এখন সে মৃত। তার শাস্তি সৃষ্টিকর্তা দেবেন। মৃত দেহতো কোনো দোষ করেনি। এখন লাশ দাফন না করে আপনারা (গ্রামবাসী) অপরাধ করছেন। কথা শোনে এক ইউপি সদস্য সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসে গ্রামবাসীকে শান্ত করেন। এরপর দেখা গেল অন্য সমস্যা। লাশ দাফনের টাকা ছিল না আবু মিয়ার স্ত্রীর কাছে। আবু মিয়ার স্ত্রীর দুরাবস্থা দেখে ভাড়া না নিয়ে নিজের জন্য কিছু টাকা রেখে বাকিটা দিয়ে দেন লাশ দাফনের জন্য।
লিটনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে। বাবা লতিফ সিকদার মারা গেছেন ৮ মাস আগে। মা হনুফা বেগম বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের এমএলএসএস।
অভাব অনটনের কারণে লিটনের পড়ালেখা এগোয়নি বেশি দূর। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মায়ের সঙ্গে মেডিকেল সংলগ্ন সরকারি কর্মচারী কোয়ার্টারে।
ছোটবেলা থেকেই লিটন যেন একটু আলাদা। মায়ের চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় বেশি সময় কেটেছে মেডিকেলে। রোগীদের প্রয়োজনে ছুটে যেত খুদে লিটন। রোগী ওঠাতে নামাতে কিংবা ওষুধ কিনে আনার দরকার হলে বা বাইরের দোকান থেকে জরুরি কোনো জিনিসের প্রয়োজন হলে হাজির হতো লিটন। নিজের পকেটের টাকায় দরিদ্র রোগীদের স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দিয়েছেন অনেকবার। রক্ত দিয়েছেন বেশ কয়েকবার।
কিশোর বয়সে মেডিকেলের এক অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাছ থেকে গাড়ি চালানো রপ্ত করেন লিটন। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছেন তিনি। ৫ বছর আগে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেই একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনে ফেলেন।
লিটন বলেন, মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায় তবে কে দাঁড়াবে? আল্লাহ আমাকে যতটুকু সামর্থ্য দিয়েছেন তাই দিয়ে যতদূর পারা যায় অসহায়, সুবিধা বঞ্চিত, দরিদ্র মানুষের পাশে যেন দাঁড়াতে পারি। মানুষের সেবা করার মাঝেই তো শান্তি রয়েছে। স্বপ্ন একটাই ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার। চিকিৎসক বানানোর। অসহায়, সুবিধা বঞ্চিত, দরিদ্র মানুষেরদের যেন চিকিৎসা সেবা দিতে পারে।
লিটনের ব্যাপারে কথা হয় বরিশাল বিভাগীয় অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি রবিন খাঁ’র সঙ্গে। তিনি বলেন, দিন রাত নেই। শহর হোক বা প্রত্যন্ত গ্রাম। খবর পেলেই লিটন ছুটে যান রোগীর ঠিকানায়। তিনি তাদের পৌঁছে দেন হাসপাতালে। ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করেন না। অসহায়, দরিদ্র মানুষ দেখলে তাদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন। বিনা ভাড়ায় অনেক রোগীকে পৌঁছে দিয়েছেন গন্তব্যে। লিটনের মতো ব্যক্তিরা আছেন বলেই সমাজটা এখনও সুন্দর।
এমএএস/আরআইপি