বিশেষ প্রতিবেদন

বীথিকে দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে দিত না মালিকের ৫ ছেলে

ছোটবেলায় মা হারানোর পর বাবা ময়নাল হোসেন আরেকটি বিয়ে করেন। এর পরই বিভীষিকাময় অধ্যায়ের শুরু বীথি ও সাথীর জীবনে। তখন বীথির বয়স ১২ আর সাথীর ৮। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আর থাকা হয়নি বাবা ও সৎ মায়ের সঙ্গে।

Advertisement

পাশের ঘরের ভাড়াটিয়া ড্রাইভার আঙ্কেল সেলিম মিয়া তাদের নিয়ে যান তার মালিকের বাসায়। মালিকের স্ত্রী অসহায় দু'জনকে আশ্রয় দেন। একই বাসায় দু’বোন গৃহপরিচারিকার কাজ করে টানা ৮ বছর। দুই বোনের জমানো অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় লাখ। পরে বিশ বছরের বীথি এক শুভাকাঙ্খির পরামর্শে আরও ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে ২০১৫ সালের মার্চে ৮৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বনানীর এক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে লেবাননে যান। সেখানে গৃহপরিচারিকার কাজে তাকে পাঠানো হয়। কিন্তু এজেন্সির লোকেরা তাকে অফিসের কাজ করার কথা বলে তাদেরই বাসার একটি কক্ষে থাকতে দেয়। ওই দেশে কাজে যোগদান করতে সময় লাগে বলে তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রেখে দৈহিক ও শারীরিক নির্যাতন চালায়।

তিন মাস পর এক বাসায় কাজ দেয়া হয়। সেখানকার চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ। মালিকের ৫ ছেলের নির্দেশে রাতে সে দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে পারতো না। কথা না শুনলে চালাতো শারীরিক নির্যাতন। এভাবে এক বছরের বোবা কান্না শেষে ২০১৬ সালের মার্চে বীথি দেশে ফিরে এসেছেন। ছদ্মনামের এই নারী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বিচার দিয়েছেন। সম্প্রতি বীথি এসেছিলেন অভিবাসী নারীকর্মীর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অধিকার ও ক্ষমতায়নের কৌশল নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠানে। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে।

জাগো নিউজকে বীথি বলেন,‘আল্লাহ যেন কোনো বোনকে এমন সর্বনাশা বিদেশে না নেন। সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ গড়তে লেবাননে গেছিলাম। মনে করেছিলাম নিজে বড় হয়ে সংসার গড়ব এবং ছোট বোনকে সুন্দর করে বিয়ে দেব। লেবানন আমার সব শেষ করে দিছে’বলে কাঁদতে শুরু করেন ভুক্তভোগী ওই নারী। কেবল বীথিই নয় এমন নির্যাতনের শিকার হাজারও অভিবাসী। প্রবাসে নারী কর্মী গমনের সংখ্যা বাড়লেও কমছে না যৌন হয়রানি ও দৈহিক নির্যাতন। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সুরক্ষায় দেশে বিদেশে সভা সেমিনার সিম্পোজিয়াম হলেও কমছে না হয়রানি। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকেই দেশে ফিরে আসছেন। মান-সম্মানের ভয়ে অনেকে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হলেও মুখ খোলেন না। আর বিচার চেয়ে আমলাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরা অনেক নারীদের পক্ষেই সম্ভব না। যে কারণে অভিবাসী নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির সঠিক চিত্র কারও জানা নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইওএম) ২০১৬ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বিদেশ ফেরত ১০১ জন নারী শ্রমিকের মতামতের ভিত্তিতে একটি স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করে। এতে দেখা যায়, প্রতি তিনজনের দু’জন অভিবাসী নারী শ্রমিক তাদের নিয়োগকর্তা দ্বারা কোনো না কোনো নির্যাতনে শিকার। এ নির্যাতনকে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএমএসএ) অন্য একটি স্টাডি অনুযায়ী, লেবাননে কর্মরত ৭৭ জন নারীই তাদের নিয়োগকর্তা দ্বারা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকও রয়েছেন।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলেও ১৯৭৬ সালে শ্রম অভিবাসন শুরু হয়। ওই সময় অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৭৮ জন। বর্তমানে ১শ’টিরও বেশি দেশে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন বাংলাদেশি অভিবাসীরা। আর ১৯৮০ সাল থেকে মূলত পুরুষের পাশাপাশি বৈশ্বিক শ্রমবাজারে সীমিত আকারে নারীদের পদচারণা শুরু হয়। প্রথম দিকে নারীরা ডাক্তার, নার্স ও শিক্ষকতা পেশায় প্রবাসে যান। পরে বিশেষায়িত ছাড়াও অনেক ধরনের পেশা যুক্ত হয় নারী অভিবাসনে। বিদেশে যাওয়া নারীরা হয়রানির শিকার হওয়ার বেশ কিছু ঘটনার সূত্র ধরে সরকার অদক্ষ নারী শ্রমিকদের অভিবাসনে কখনও আংশিক আবার কখনও পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০০৩ সালে সরকার অল্প দক্ষ নারী শ্রমিকদের অভিবাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের মধ্যে নারী অভিবাসীদের হার ছিল মাত্র এক শতাংশ। ২০০৩ সালে নারী অভিবাসনে কিছু নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে নারী অভিবাসীদের হার গিয়ে দাঁড়ায় ৫ শতাংশে। এরপর থেকে এই ধারা ক্রমবর্ধমান। ২০১৬ সাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান ৭ম।

জানা গেছে, পুরুষ অভিবাসীদের চেয়ে নারী অভিবাসীরা কম উপার্জন করলেও নারীরা তাদের আয়ের ৯০ শতাংশ টাকা দেশে পাঠিয়ে দেন। আর পুরুষরা পাঠান আয়ের ৫০ শতাংশ। এই দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ নারীকণ্ঠ ফাউন্ডেশনের পরিচালক ফারহানা রেজা বলেন, নারীরা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্তম্ভ। গার্মেন্টস সেক্টর তো রয়েছেই। অভিবাসী নারীরাও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করে আসছেন। অথচ এখনও বিদেশে গিয়ে নিজ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, বিদেশের মাটিতে প্রতিকার পাচ্ছেন না। অনেকে নির্যাতন সইতে না পেরে দেশে ফিরে আসছেন। আমরা তাদের তেমন সহায়তা দিতে পারছি না।

সম্প্রতি অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নারীরা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও বিষয়টিতে সেখানকার দূতাবাস অফিসগুলোর কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না বলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের দেশের মেয়েরা যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতনের স্থানটা এখানে একটা বিষয়। সেখানে সেই দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতা যদি সে রকম না থাকে আর অ্যাম্ব্যাসি যদি ভূমিকা না নেয়, যদি সেগুলো মনিটর করা না হয় তাহলে এগুলো চলতেই থাকবে। এগুলো কিন্তু আমরা অনেকবার বলেছি। তারপরও সেভাবে কিছুই করা হচ্ছে না বলে জানান সালমা আলী বলেন। সরকার বর্তমানে হংকং থাইল্যান্ডসহ নতুন যেসব দেশে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারীরা তাতে বেশ আগ্রহও দেখাচ্ছেন।

Advertisement

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. নমিতা হালদার জাগো নিউজকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের দেশের মেয়েরা যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হতো এটা সত্যি। কিন্ত এটাও সত্যি যে, এখন এই অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীতে অভিবাসী নারীকর্মীর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অধিকার ও ক্ষমতায়নের কৌশল নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করেছি। সেখানে অনেক চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিকারের কৌশল খুঁজে বের করা হয়েছে।আমরা অভিবাসী নারী কর্মীদের অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়ে সদা সতর্ক।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ থেকে এ পর্যন্ত অভিবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা সাত লাখের কিছু উপরে। ২০১৭ সালে ১ লাখ ২১ হাজার ৯শ’ ২৫ জন দক্ষ ও আধা-দক্ষ বাংলাদেশি নারী কর্মীকে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে সরকার।

আরএম/ওআর/বিএ