বিশেষ প্রতিবেদন

বীমা নেই পোশাক শ্রমিকদের

আইনে শ্রমিকদের গ্রুপবীমা বাধ্যতামূলক করা হলেও তিন বছর ধরে কোনো বীমা কোম্পানিতেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের গ্রুপপবীমা করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে শ্রমিকদের বীমা দাবির টাকা দেয়া হচ্ছে বলে দাবি করছে পোশাক কারখানার মালিকদের প্রধান দুই সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)।

Advertisement

সংগঠন দু’টির দাবি, দাবির টাকা পরিশোধে বীমা কোম্পানিগুলো নানা ধরনের টালবাহানা করে। তাই বীমা কোম্পানিতে বীমা না করে অন্যভাবে শ্রমিকদের বীমার টাকা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তারই অংশ হিসেবে সরকারে সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে শ্রমিকদের বীমা দাবির টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালাতে এমন সুযোগ রাখা হয়েছে। সে জন্য রফতানির বিপরীতে পাওয়া অর্থের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে।

তবে ‘বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫’-তে শ্রমিকদের কল্যাণ ও আপদকালীন সুবিধার জন্য প্রতিটি রফতানি কার্যাদেশের বিপরীতে প্রাপ্ত মোট অর্থের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু পোশাক শ্রমিকদের গ্রুপবীমা করতে হবে না এমন কোনো বিধান শ্রম বিধিমালাতে যুক্ত করা হয়নি। বরং কেন্দ্রীয় তহবিলের মাধ্যমে অনুদান হিসেবে গ্রুপবীমার প্রিমিয়াম দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

শ্রম বিধিমালায় শতভাগ রফতানিমুখী শিল্প সেক্টরে ক্রেতা ও মালিকের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় তহবিল গঠনের বিষয়ে ২১৪(১)(ক) ধারায় বলা হয়েছে, রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যাদেশের বিপরীতে প্রাপ্ত মোট অর্থের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ তহবিলে জমা দিতে হবে।

Advertisement

তহবিলের অর্থ ব্যবহারের বিষয়ে ২১৫(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘তহবিলে জমাকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট সেক্টরের সুবিধাভোগীগণের দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু বা স্থায়ী অক্ষমতা অথবা শরীরের কোনো অঙ্গহানী হইলে এককালীন অনুদান হিসাবে প্রদান করা হইবে এবং সুবিধাভোগীর সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ সংক্রান্ত অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা যাইবে।’

আর ২১৫(৬) ধারায় বলা হয়েছে, উপ-বিধি (৩) এ উল্লিখিত হিসাব হইতে প্রাপ্ত অর্থ আইনের অধীনে কারখানা বা প্রতিষ্ঠান হইতে প্রাপ্ত অন্যান্য আইনানুগ সুবিধার অতিরিক্ত হইবে। উপ-বিধি (৩)-এ বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় তহবিলের অধীনে সুবিধাভোগী কল্যাণ হিসাব এবং আপদকালীন হিসাব নামে দুটি হিসাব খুলতে হবে।

আর আপদকালীন হিসাব থেকে সুবিধাভোগীদের গ্রুপ বীমার বাৎসরিক প্রিমিয়ামের অর্থ অনুদান হিসেবে দেয়া যাবে বলে ২১৫(৮)(খ) ধারায় বলা হয়েছে।

অপরদিকে ২০১৩ সালের সংশোধিত শ্রম আইনের ৯৯(১) ধারায় বলা হয়েছে ‘যে সকল প্রতিষ্ঠানে অন্যূন ১০০ জন স্থায়ী শ্রমিক কর্মরত রহিয়াছেন, সেইখানে মালিক প্রচলিত বীমা আইন অনুযায়ী গ্রুপবীমা চালু করিবেন।’

Advertisement

আর ৯৯ (২) ধারায় বলা হয়েছে ‘বীমা দাবীর টাকা এই আইনের অধীন শ্রমিকের অন্যান্য প্রাপ্যের অতিরিক্ত হইবে; তবে শর্ত থাকে যে, শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বীমা দাবী আদায় মালিকের দায়িত্ব হইবে এবং মালিক উক্ত বীমা দাবী হইতে আদায়কৃত অর্থ পোষ্যদের সরাসরি প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’

এই শ্রম আইন মেনে ২০১৪ সালে সোনালী লাইফের সঙ্গে গ্রুপবীমার চুক্তি করে বিজিএমইএ। অবশ্য এই গ্রুপবীমা সব শ্রমিকের জন্য না করে মাত্র ২৫ জনের জন্য করা হয়। নামমাত্র এ গ্রুপবীমাটিও ২০১৫ সালের পর থেকে আর করা হচ্ছে না।

সোনালী লাইফের আগে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডেল্টা লাইফে, ২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মেটলাইফে এবং তার আগে ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জীবন বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে এই গ্রুপবীমার চুক্তি করে বিজিএমইএ। সে সময় অর্থাৎ ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২০ জন শ্রমিকের জন্য গ্রুপবীমার চুক্তি করা হতো।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কোনো বীমা কোম্পানিতে শ্রমিকদের গ্রুপবীমা করা নেই এ কথা ঠিক। তবে শ্রমিকরা বীমা আওতার বাইরে নেই। আমরা নিজস্ব ব্যবস্থায় শ্রমিকদের বীমার সুবিধা দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালা মেনে আমরা রফতানি মূল্যের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেই। সেখান থেকেই শ্রমিকদের বীমা দাবির টাকা দেয়া হয়। কোনো শ্রমিক সাধারণভাবে মারা গেলে ২ লাখ টাকা দেয়া হয়। আর দুর্ঘটনায় মারা গেলে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়।

শ্রম আইনে কোনো প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন শ্রমিক থাকলেই গ্রুপবীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাহলে বীমা কোম্পানিতে বীমা না করার মাধ্যমে এ আইন লঙ্ঘন হচ্ছে কি না? এমন প্রশ্ন করা হলে সিদ্দিকুর বলেন, এই আইন অনুযায়ী অন্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রুপবীমা করতে হবে। পোশাক কারখানার জন্য এটি প্রযোজ্য না। তাই কোনো কোম্পানিতে বীমা না করে আমরা নিজেরাই শ্রমিকদের বীমার সুবিধা দিচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, বীমা কোম্পানিতে গ্রুপবীমা করা হলে দাবির টাকা আদায়ে নানা সমস্যা হতো। বীমা কোম্পানি দাবি পরিশোধে টালবাহানা করতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই। শ্রমিকদের পরিবার দ্রুত বীমা দাবির টাকা পেয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) যুগ্ম-সচিব মনিরুজ্জমান জাগো নিউজকে বলেন, পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিটি রফতানি কার্যাদেশের বিপরীতে প্রাপ্ত মোট অর্থের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই তহবিল থেকেই শ্রমিকদের বীমার টাকা দেয়া হয়। আগে যখন বীমা কোম্পানিতে গ্রুপবীমা করা হতো, তখন শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে এ টাকা দেয়া হতো না।

বিজিএমইএ সভাপতির মতো তিনিও বীমা কোম্পানি দাবির টাকা নিতে নানা টালবাহানা করে উল্লেখ করে বলেন, আপনারা জানেন আমাদের দেশে বীমার টাকা পেতে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই পোশাক শ্রমিকদের বীমার বিষয়টি একটি বিধির মাধ্যমে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের আওতায় আনা হয়েছে।

তবে বীমা কোম্পানিতে গ্রুপবীমা না করার কারণে পোশাক শ্রমিকরা বেকায়দায় রয়েছেন বলে মনে করছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন। সংগঠনটির সভাপতি আমিরুল হক আমিন জাগো নিউজকে বলেন, শ্রমিকরা এখন বেকায়দায় আছে। কোনো বীমা কোম্পানিতে তাদের বীমা করা হচ্ছে না আবার কেন্দ্রীয় তহবিল থেকেও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ বীমা দাবির টাকা দেয়া হচ্ছে না।

এমএএস/এনএফ/বিএ