বিশেষ প্রতিবেদন

আজও মালিকে বন্দী শ্রমিকের জীবন

রাশেদ খান মেনন। সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি । মন্ত্রী, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়। আদর্শবাদী রাজনীতির কারিগর বলে পরিচিতি তার। আদর্শের কাছে নতি শিকার না করে বহুবার দল ত্যাগ করেছেন, দল গড়েছেন। সাম্যবাদী রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় নিয়েই বাম রাজনীতিতে তার দীর্ঘ পথচলা। মহান মে দিবস প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি জাগোনিউজ-এর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

Advertisement

জাগো নিউজ : শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহান মে দিবস। ১৩২ বছর আগে অধিকার আদায়ে রক্ত দিলেন শ্রমিকরা। শ্রমের মর্যাদা নিয়ে এখন কি বলবেন?

রাশেদ খান মেনন : হাজার বছরের বঞ্চনা আর শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। শ্রমঘণ্টা প্রতিষ্ঠায় শ্রমিকরা যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে শিকাগো শহরের তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখে। লাখো শ্রমিকের সমাবেশে শিকাগোর হে শহর জনসমুদ্রে রূপ নেয়। বিক্ষোভ রোধে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে ১০ শ্রমিককে হত্যা করে। এটি ছিল শ্রমিক আন্দোলনের পবিত্রতম পথিকৃত। যুগে যুগে, দেশে দেশে শ্রমের মর্যাদা রক্ষার যে লড়াই তা মূলত দিবস থেকেই রক্ষা। দুঃখজনক হলেও সত্য আজও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি। শ্রমিককে আজও আমরা মর্যাদা দিতে পারিনি।

জাগো নিউজ : আট ঘণ্টা শ্রমের জন্য শ্রমিকের রক্ত দেয়া। আজও শ্রমঘণ্টা অধরা।

Advertisement

রাশেদ খান মেনন : শ্রমিকের রক্ত পানি করা শ্রমে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রমের ক্ষেত্র বেড়েছে। শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন হচ্ছে, বিধান হচ্ছে। সবাই অধিকার নিয়ে কথাও বলছে। কিন্তু আজও শ্রম ঘণ্টা প্রতিষ্ঠা পায়নি। অথচ মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে শ্রমঘণ্টা কমিয়ে এনে আট ঘণ্টায় নির্ধারণ করা। দাবি ছিল, আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা ঘুম এবং বাকি আট ঘণ্টা বিশ্রাম-বিনোদনসহ অন্যান্য কাজ করা। কিন্তু একজন দিনমজুর কতক্ষণ শ্রম দিচ্ছেন, তা নিজেও জানেন না। আট ঘণ্টা নামেমাত্র বিধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওভারটাইমের কথা বলা হলেও তা কোনো দেশেই সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে মানা হচ্ছে না। অর্থাৎ মালিকের সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পায়। শ্রম এবং মজুরি নির্ধারণে মালিকের সিদ্ধান্তই সর্বেসর্বা। আজও মালিকে বন্দী শ্রমিকের জীবন।

জাগো নিউজ : আন্দোলন করছেন শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী বলবেন?

রাশেদ খান মেনন : পাকিস্তান আমলে আমরা মহান মে দিবস পালন করতে পারিনি। মে দিবস পালনের দাবিতে হরতাল-অবরোধ করতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা মে দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করতে থাকি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালন করা হয় এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। শ্রমের মর্যাদায় এটি একটি বড় ঘটনা। তবে এরপরেও আমি বলব, মে দিবস পালন যেন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই আটকে আছে। শ্রমিক আজও শোষিত হচ্ছে। ন্যূনতম অধিকার আদায় নিয়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে, রক্ত দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্র, সমাজ আজও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

জাগো নিউজ : শত চ্যালেঞ্জে ঘেরা শ্রমিক জীবন। এই মুহূর্তে কোন চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব দিবেন?

Advertisement

রাশেদ খান মেনন : প্রযুক্তির উন্নয়নে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। এটিই এখন শ্রমিকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তিগত একটি উদ্ভাবনের কারণে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছে। অথচ এটি নিয়ে বিশ্ব নেতাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে কী বলবেন?

রাশেদ খান মেনন : প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন বাংলাদেশেও। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিশ্বে এখন বিস্ময়। শ্রমের বাজারেও ডিজিটাল অগ্রগতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কিন্ত প্রযুক্তির এই সময়ে শ্রমিকরা কিভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, তা নির্ধারণ করতে পারেনি সরকার। এতে করে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছেন। যেমন আগে প্রেসের সঙ্গে বহু শ্রমিক জড়িত ছিলেন। কম্পিউটার আর ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর এই শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ছেন। ডিজিটাল শ্রমে তারা তাল মেলাতে পারছেন না। অর্থাৎ ডিজিটাল বৈষম্যে শ্রমিকরা।

জাগো নিউজ : ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন করছেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

রাশেদ খান মেনন : গ্রামের দরিদ্র পরিবারের লাখ লাখ নারী শ্রমিক পোশাক খাতে শ্রম দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। এটি একটি শ্রম বিপ্লব বলে মনে করি। অথচ আজও এই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির জন্য রাস্তায় নামতে হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেয়া সময়ের দাবি বলে মনে করি।

জাগো নিউজ : বৈষম্য দূর করতেই জোটভুক্ত হলো আপনার ওয়ার্কার্স পার্টি। কী ভূমিকা রাখতে পারলেন গত দশ বছরে?

রাশেদ খান মেনন : আমরা সরকারে আছি বটে, কিন্তু মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করতে মাঠেও আছি। আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। আবার সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনেও সম্পৃক্ত। সরকারের জনবিরোধী সব নীতির বিরোধিতা করছি সংসদে দাঁড়িয়ে। আমাদের বিরোধিতা এবং সমালোচনা কোনো না কোনোভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বটে।

এএসএস/ওআর/বিএ