মা-মাটি দেশ আর শেকরের টান। এ দেশের আকাশ বাতাসে বেড়ে উঠা। সব কিছুই তার চেনা জানা। তারপরও স্বামীর চাপে আর অভাবের তাড়নায়, মনের ক্ষোভে আর্জিনা স্বামী সন্তানকে নিয়ে ভারত যেতে নিবন্ধন করেছিলেন। কিন্ত, এরপর থেকেই মানুষিকভাবে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। কি করবে ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক সময় তার বোধোদ্বয় ঘটে মাতৃভূমির প্রতি। এরপরই স্বামীর সঙ্গে জেদ করে ভারত যাওয়া থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন তিনি। শত কষ্টেও থেকে যেতে চান নিজ দেশে। এ মাটিতেই মরতে চান তিনি।কুড়িগ্রাগের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের ফুলকুমার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মন্ডলের মেয়ে আর্জিনা বেগম। প্রায় ৮ বছর আগে ভারতীয় গাঁওচুলকা ১৪৩ নং ছিটমহলের বাসিন্দা বাদলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে অনামিকা খাতুন বৃষ্টি (৬) জন্ম নেয় তাদের সংসারে। ছিটের মধ্যে বাদলের বাড়ি ভিটেসহ জমি রয়েছে ২ বিঘা ৮ শতক। ফেরি আর কৃষি কাজ করে ৫ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় স্বামী বাদলকে। ভারত সরকারের ছিটমহলবাসীদের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা শুনে স্বামী শহীদুল ইসলাম বাদল এক প্রকার জোর করেই ভারত যাবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং রেজিস্ট্রেশন করে। প্রথম দিকে স্বামীর সিদ্ধান্তে মত দিলেও সময় যত গড়াচ্ছিল তা মেনে নিতে পারেন নি আর্জিনা। এক প্রকার জেদ করেই স্বামীর অমতেই রেজিস্ট্রেশন প্রত্যাহার করে নেন তিনি। আর্জিনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, সংসারে অভাবের কারণে ভারতের লোভনীয় প্যাকেজের জন্য হেডকাউন্টিং শুরুর ৫ম দিনেই ভারত যেতে নিবন্ধন করি। তাছাড়া ভারতে গিয়ে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আত্মীয়তার বন্ধন বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই নিজের মাতৃত্বের টানে নিবন্ধনের দু’দিন পরেই নাম তুলে নেই।আর্জিনার শ্বশুর মহির উদ্দিন জানায়, ছেলের সিদ্ধান্তে হতবাক আর ব্যথিত হয়েছিল পরিবারের সবাই। কারণ এখানে যে জমি জমা আছে তাতে কোনো রকম জীবন চলে যায়। নতুন পরিবেশে কি করবে তাই হতাশ হয়ে ছিলাম। এখন বাড়ির সবাই খুশি। ছেলে বাদলের মতামত পরিবর্তনের জন্য। আর্জিনার বাবা মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মন্ডল জাগো নিউজকে জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। মেয়ে ও জামাই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আমাদের দরিদ্র পরিবারে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। আফসোস হতে থাকে দেশ স্বাধীন করে কি লাভ হলো? অভাবের তাড়নায় আজ মেয়েকে যেতে হচ্ছে দেশ ছেড়ে। শেষ পর্যন্ত জন্মভূমির টানেই জামাই-মেয়ের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে জীবনের পড়ন্ত মূহুর্তে এসে মনের মধ্যে শান্তি ফিরে আসে এই যোদ্ধার।প্রতিবেশি তাহের (৪৪) ও রহমান মিয়া (৫৫) জানান, আমরা তাদের বুঝিয়েছি অভাবে পড়ে মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার দরকার নেই। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, বাংলাদেশ ইউনিটরেশন কার্ড, ফ্ল্যাট বাড়ি আর কর্মসংস্থানসহ ভারত সরকারের দেয়া নানা সুযোগ সুবিধা সত্ত্বেও ভারতীয় ছিটমহলের বেশির ভাগ মানুষ শেষ পর্যন্ত নাড়ির টানেই বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবহেলিত ছিটবাসীর উন্নয়নের আলাদা কোটা তৈরির দাবি জানান ছিট আন্দোলনের এই নেতা। ৬৮ বছরের মানবেতর জীবন-যাপনের সমাপ্তি ঘটানোর মাহেন্দ্রক্ষণে যারা মাতৃত্বের টান আর আত্মীয়তার বাঁধনে অধিকাংশ ছিটবাসী বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে থাকার মত ব্যক্ত করেছেন। সরকার তাদের ভাগ্যন্নোয়নে কার্যকারি পদক্ষেপ নেবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিটবাসীর। কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলের প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষের মধ্যে ভারত যাচ্ছেন মাত্র ৩১৭ জন মানুষ। জনগণনা শুরুর আগে ধারণা করা হয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ ভারতে যেতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১১১টি ছিটমহলে মাত্র ৭৭৯ জন মানুষ ভারতে যাবার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এদের মধ্যে ১৬৩ জন মুসলিম এবং বাকিরা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এমএএস/পিআর
Advertisement