‘পা হারিয়ে টানা আটদিন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে বারবার আঁতকে উঠত রোজিনা। প্রথম কয়েক দিন জানত না যে তার পা নেই। যখন জানল তখন থেকেই বলত, যে আমার পা কেড়ে নিয়েছে দেখবেন ঠিকই সে সবার সামনে ঘুরে বেড়াবে। আর আমি ঘরে বন্দী হয়ে থাকব। সে সবসময় বলত যেন অপরাধীর শাস্তি হয়। তার একটাই ইচ্ছা ছিল যেন অপরাধীর শাস্তিটা নিজ চোখে যেতে পারে। কিন্তু কই আর শাস্তি হলো, উল্টো মেয়েটার প্রাণটাই চলে গেল। তার স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে গেল।’
Advertisement
এভাবেই কথাগুলো জাগো নিউজকে বলছিলেন রোজিনার চাচা সুরুজ মিয়া। ভাতিজির মৃত্যুর পর বারবার এ কথাগুলো বলছিলেন তিনি। অন্যান্য স্বজনদের মতো সুরুজ মিয়াও মেনে নিতে পারছেন রোজিনার মৃত্যু। তার কাছে রোজিনা ছিল অন্য আট-দশটা মেয়ের চেয়ে আলাদা।
তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, রোজিনা অভাব অনটনে বড় হলেও তার ছিল অসাধারণ গুণাবলী। সে অন্যের বাসায় কাজ করে নিজের পাশাপাশি পরিবারও চালাত। যে বাসায় সে কাজ করত সেখানে সবাই তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখত। কখনও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি ওই পরিবার। সবাই প্রসংশা করত। কিন্তু এত ভালো মেয়ে এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে তা কেউ ভাবতে পারিনি। একথা বলতেই কণ্ঠ যেন ধরে আসছিল তার।
তিনি বলেন, ‘এখানে (ঢামেকে) আনার আগে পঙ্গু হাসপাতালে সে সব সময় বলত আমার জীবন শেষ হয়ে গেলে কাকা। কিন্তু অপরাধীর কোনো শাস্তি হবে না। দেইখেন সে বাহিরে ঘোরাঘুরি করবে। দেইখেন এমন ঘটনা শুধু ঘটতেই থাকবে। কিন্তু শাস্তি হবে না। রোজিনার কথাই সত্যি হলো। অপরাধীর শাস্তি তো হলো না। কোনো ক্ষতিপূরণও পেলো না পরিবার। এটা কেমন বিচার?’
Advertisement
রোজিনার বাবা রসুল মিয়া বলেন, ‘যে মেয়ের ওপর ভরসা কইরা আমরা চলতাম, সেই মেয়ে আমাদের সাগরে ভাসিয়ে চইলা গেল। আমার এ মেয়েটা সবার চেয়ে আলাদা ছিল। জ্ঞানবুদ্ধিও ভালো ছিল। কিন্তু আমরা গরিব হওয়ায় তারে পড়াশোনা করাইতে পারিনি। টাকার অভাবে এক বাসায় কাজে দিছিলাম রোজিনারে। সেখান থেকে আমাদের জন্য টাকাও পাঠাতো। নিজেও চলত। কিন্তু তার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর যেন সব এলোমেলো হয়ে গেছে। মেডিকেলে দিনরাত অপেক্ষায় থাকতাম মেয়ে সুস্থ হলে বাসায় নিয়ে যাবো। কিন্তু তা আর হইল না। মেয়েকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি ঠিকই তবে সে আর আমাদের ঘরে আসবে না।
কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘শুনছি মেয়েকে সরকারি একটা গাড়ি মাইরা দিছে। কিন্তু কই সরকার তো আমাদের পাশে দাঁড়াইল না। যে চালক এ কাজ করছে সেও নাকি জামিন পাইয়্যা বাহিরে ঘুইরা বেড়াইতাছে। আমি এর বিচার চাই। যেন আর কোনো বাবাকে সন্তান হারাইতে না হয়।’
উল্লেখ্য, গত ২০ এপ্রিল আত্মীয়ের বাসায় থেকে ফেরার পথে রাত ৮টার দিকে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে বিআরটিসির বাস (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৫৭৩৩) ধাক্কা দেয় রোজিনাকে। এতে রোজিনা রাস্তায় পড়ে গেলে বাসটি তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে তার পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর তাকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান পাঁচদিন চিকিৎসা নেয়ার সময় কিডনিজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।
এ জন্য ২৫ এপ্রিল তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর তাকে ঢামেকের বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে রাখা হয়। ২৬ এপ্রিল বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে তার চিকিৎসায় ৯ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ওইদিন তার পায়ের ক্ষতস্থান ড্রেসিংসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরে দিন ২৭ এপ্রিল তার অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত ঢামেকের প্রধান আইসিইউর ১ নম্বর বেডে নেয়া হয়। সেখানে রোববার (২৯ এপ্রিল) সকাল ৬টার দিকে তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিলে কৃত্রিম শ্বাসনালী দেয়া হয়। তবে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা উপেক্ষা করে না ফেরার দেশে চলে যান রোজিনা।
Advertisement
রোজিনার এমন মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জাগো নিউজকে বলেন, তার ব্লাড ইনফেকশনটার কারণেই মূলত মৃত্যুটা হয়েছে। এ ধরনের ইনফেকশন ক্রাশের ঘটনায় হয়ে থাকে। তার শরীরের অন্যান্য সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ইনফেকশনটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। তার এমন মৃত্যুতে চিকিৎসকরা শোকাহত।
তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় সর্বোচ্চ বিচার হওয়া উচিত। প্রতিদিন ঘটছে এমন ঘটনা। রাজিব, রোজিনা, হৃদয় কিংবা রাসেল সবাই এমন নির্মমতার শিকার। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে অথচ অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। এজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।
রোজিনার মরদেহ দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢামেক থেকে নিজ বাড়ি ময়মনসিংহের দোবাউড়া থানার ঘোষগাঁও এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিকেলে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন রোজিনার দুলাভাই।
এসএইচ/এএইচ/আরআইপি