ফিচার

কী ঘটেছিল সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিলে

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল স্মরণকালের ভয়াবহতম প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০-১২ ফুট পানির তোড়ে কক্সবাজার, চকরিয়াসহ উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে প্রায় ২ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটে। অজস্র বাড়ি-ঘর, পশু-পাখি ও ফসলাদি ধ্বংস হয়। সেই দিনের ভয়াবহতার কথা জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী হাবীব রেজা আহমদ-

Advertisement

২৯ এপ্রিল ১৯৯১ সালের এই দিনে আমি গ্রামীণ ব্যাংকের চকরিয়া চিংড়ি ফার্মের একজন কর্মকর্তা হিসেবে প্রত্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চল চকরিয়াতেই কর্মরত ছিলাম। সকাল থেকে রৌদ্রোজ্জ্বল পরিষ্কার আকাশ। তেমন খারাপ কিছুই দেখতে পাইনি। আবহাওয়ার খবর অনুযায়ী এমন কোনো লক্ষণও বুঝতে পারিনি। দুপুর তিনটার পর থেকে হালকা বাতাসের ঝাপটার সাথে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়।

এরপর সময় যতই গড়ায় বৃষ্টির ধারা আর বাতাসের গতিবেগ পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। চিংড়ি খামারের পানিও ক্রমান্বয়ে ফুলতে থাকে। ততক্ষণে খামার থেকে বাঁধের আইল ধরে প্রায় চার কিলোমিটার দূরবর্তী লোকালয়ে ফিরে আসার মতো অবস্থা আর ছিল না। সরকারিভাবে প্রদত্ত ৩০০ একরের খামারটি ৩টি ইউনিটে ভাগ করা ছিল। অফিস ও ১ নম্বর ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন মূল ফার্ম ম্যানেজার প্রিন্সিপাল অফিসার আবদুল মান্নান, ২ নম্বর ইউনিটের ব্যবস্থাপক ছিলেন সিনিয়র অফিসার অমূল্য বড়ুয়া বাবু এবং ৩ নম্বর ইউনিটের ব্যবস্থাপক ছিলাম সিনিয়র অফিসার হিসেবে আমি।

প্রতিটি ইউনিটের দূরত্ব ছিল প্রায় অর্ধ কিলোমিটার। আমার আওতাধীন ব্যাংক কর্মচারী ও খামারের শ্রমিক মিলে আমরা প্রায় ৩০ জন ৩ নম্বর ইউনিটে ছিলাম। আমার ইউনিট অফিসটি ছিল সদ্য নির্মিত শক্ত বাঁশ, বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনিযুক্ত ঘর। প্রতিটি ইউনিটেই এরকম ৩০-৩৫ জন করে কর্মরত ছিল।

Advertisement

সন্ধ্যার পর থেকে আমাদের ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ করতে থাকে। সাথে বাতাসের বেগ ও বৃষ্টির জোরও সমানতালে বাড়তে থাকে। অবাক করার বিষয়, খুব অল্প সময়ে ঘরের ভেতর পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। রাত নয়টার মধ্যেই ঘরের সিলিং পর্যন্ত পানি চলে আসে। আমরা এতগুলো মানুষ যাই কোথায়? মাঝারি আকারের একটি ঘর। উপায়ান্তর না দেখে সবাই ঘরের বাঁশের তৈরি সিলিংয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি। বাতাসের গতি অধিক বেগবান হতে থাকে। একে একে সিলিংয়ের উপরের ছনের ছাউনি হাওয়ার তোড়ে কোন সুদূরে ভেসে চলে যায় বুঝতে পারিনি। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরাসরি শরীরে এসে বিঁধে। এতো সজোরে বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে আঘাত করছিল যেন সোনামুখী সুঁই সরাসরি শরীরে বিঁধে যাচ্ছিল। আর বৃষ্টির পানিগুলো যেমন খুব ঠান্ডা ছিল; তেমনি ছিল তেঁতো স্বাদযুক্ত।

বাতাসের বেগ আরও প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেল। থেমে থেমে আরও গতি সঞ্চার করে ঘরটির উপর আঘাত হানছিল। এদিকে সিলিংয়ের অর্ধ হাত নিচেই কালো পানি। পানি এতো জোরে ওলট-পালট হচ্ছিল যেন কয়েকশ’ হাতি এতে দাপাদাপি করছিল। ঠান্ডায় সবার জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক করছিল। শীতে, ভয়ে কেউ কেউ প্রস্রাব করছিল। সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজেও প্রস্রাব করেছিলাম। মনে হচ্ছিল, ঘরটি যেভাবে এদিক-ওদিক জোরে-সোরে নড়ছে; যে কোনো মুহূর্তে কাত হয়ে পড়ে গেলেই আমাদের সলিলসমাধি ঘটবে। সবাই উচ্চস্বরে কলেমা শরীফ, খতমে ইউনুস ও আযান দিচ্ছিল। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য সবাই মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছিলাম। মা-বাবা, প্রিয়জনের কথা স্মরণ করে মাঝে মাঝে কারো কান্নার রোল শোনা যাচ্ছিল। আমি হতভাগা ভাবছিলাম- মাত্র তো বিয়ে করেছি, বেচারি এতো তাড়াতাড়ি বিধবা হবে!

হে জীবন ও মরণের মালিক, রহম করো। ক্ষমা করো পাপী বান্দাকে। বাবা-মা, ভাই-বোন সবার কথা স্মরণ করে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। মনে মনে এও ভাবছিলাম, মরণের পর লাশটা কোথায় ভেসে যাবে আপনজনরা কেউই হয়তো খুঁজে পাবে না। লাশের জানাজা, দাফন হবে কিনা, জানি না। উফ, ঠান্ডা আর সহ্য হয় না। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। সারা শরীর, কাপড় ভিজে চুপসে আছে। আল্লাহকে ডাকছি তো ডাকছি। ঘরের বেড়া, ছাউনি কিছুই নেই। শুধু কাঠামোটা নড়বড়ে অবস্থায় পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। সবার ধারণা, এ অবস্থায় ঘরটি টিকে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরাও টিকে থাকবো।

দয়াময়ের অশেষ কৃপায় রাত তিনটার পর থেকে বৃষ্টি ও বাতাসের গতি ধীরে ধীরে পরিশ্রান্ত যোদ্ধার ন্যায় শিথিল হতে থাকে। পরবর্তীতে জানতে পারি, রাত আড়াইটা পর্যন্ত ঝড় ও বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার বা তার বেশি, যা স্মরণকালের ইতিহাসে বিরল! বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের পর ভোরের আকাশে আলোর রেখা ফুটে ওঠে।

Advertisement

বেঁচে থাকার আনন্দে চারদিকে চোখ বুলাই। একি! বুকটা হাহাকার করে ওঠে। যতদূর চোখ যায়, থইথই পানি। সব সমান। বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা, অফিস কিছুই দৃষ্টিতে আসছে না। সবার মুখে একই কথা- হায় হায়, আমরা ছাড়া হয়তো আর কেউ বেঁচে নেই। সকাল নাগাদ ঘরের ভেতরের পানি কমে কোমর পর্যন্ত দাঁড়ায়। আমরা সিলিং থেকে নেমে পানি ভেঙে খামারের বাঁধ ধরে ১ নম্বর ইউনিটের মূল অফিসের দিকে যেতে থাকি। হাঁটার কোন জো নেই। বাঁধের উপর হাজারো ধ্বংসস্তূপ!

পৃথিবী ধ্বংসের কথা, কেয়ামতের কথা জানি। আজ যেন সত্যিকারভাবে দেখলাম। অনেক বাড়ি-ঘরের চালা, টিন, খাট, আলমারি, কাপড়-চোপড়, গৃহস্থালি আসবাবপত্র ভেঙে-চুরে বাঁধের উপর পড়ে আছে। আবার কিছু পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে। এছাড়া বাঁধের উপর গাছ-গাছালির ডালাপালা, কাঁটা এমনভাবে বিছিয়ে আছে যে, হাঁটতে গিয়ে পা কেটে রক্ত ঝরছিল। তখন এদিকে দেখার আমাদের ফুরসৎ ছিল না। আর একটি বিষয় তাজ্জব লেগেছিল, বাঁধের ধ্বংসাবলীর ফাঁকে ফাঁকে মাঝে-মধ্যেই ভীরু চোখে কিছু সাপ মাথা উঁচিয়ে দেখছিল। সাপগুলোকে দেখে স্বভাবত ভয় পাবারই কথা। কিন্তু না, উপরন্তু আমাদের করুণা হচ্ছিল। কারণ ঝড়ে প্রচুর সাপ, নানারকম পাখি, বিশালাকার মহিষ, গরু, ছাগল, অন্যান্য গৃহপালিত পশুপাখি মারা গিয়েছিল। আমরা নির্ভয়ে সাপের মাথার পাশে পা রেখে অনেক কষ্টে হেঁটে ১ নম্বর ইউনিটে আসি। এসে দেখি, ১ নম্বর ও ২ নম্বর ইউনিটের সব ঘর (টিনের) ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। লোকজন সারা রাত খোলা আকাশের নিচে বাঁধের মাটি কামড়ে পড়েছিল। তাদের গায়ে, মাথায়, মুখে, চুলে কাদাপানি লেগে আছে। ভয়ার্ত চেহারাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, তারা বুঝি এইমাত্র কবর থেকে জীবন্ত লাশ হয়ে উঠে এসেছে। আর আমাদের চেহারার কীরূপ নমুনা ছিল তা তো তারা দেখেছে। তারপরও সবাইকে আল্লাহর রহমতে জীবিত পেয়েছি, এটাই ছিল সবচেয়ে বড় শোকর ও তৃপ্তি।

এরপর সবাই একসাথে চকরিয়া উপজেলা সদরের এরিয়া অফিসের দিকে রওনা হই। পথিমধ্যে প্রথম যে লাশটি আমার চোখে পড়ে, সেটি স্বপ্নের মতো। কোনমতেই ভুলতে পারছি না। খুবই খারাপ লাগল। দেখলাম, একটি ২-৩ বছরের ফুটফুটে কন্যাশিশু ফর্সা গায়ে গোলাপি রঙের ফ্রক পরা অবস্থায় পানিতে উপুড় হয়ে ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে। যেন জলের দোলনায় শিশুটি মনের সুখে দোল খেলায় মেতে আছে। একদম তাজা শরীর। মারা গিয়েছে হয়তো খুব বেশিক্ষণ হয়নি। কোন মায়ের বুক খালি করেছে, কে জানে? এভাবে একে একে শিশু, কিশোর, বয়স্ক অনেক লাশ দেখতে দেখতে চকরিয়া আসি। পথে অনেক বড় বড় গাছপালা ভেঙে পড়ে আছে দেখি। সবচেয়ে বড় হৃদয়বিদারক দৃশ্য, যা দেখে আমার অন্তর হু-হু করে আজও কেঁদে ওঠে, তাহলো ‘গণবিলাপ’!

চকরিয়া আসার পথে আমি দেখেছি, কিছুটা পরই পরই নারীদের দলবেঁধে গলাগলি করে করুণ সুরে গণকান্না বা গণবিলাপ। কারো বাবার জন্য বা মায়ের জন্য বা স্বামীর জন্য বা ভাই-বোন বা সন্তানের জন্য। এ ধরনের গণকান্না দেখার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম। আমরা তো বেঁচে ফিরে আসলাম, আপনজনকে হারিয়ে তাদের এ আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাসও বুঝি কম্পমান হয়! চোখ বুজলে আমি আজও সেই রোনাজারি শুনতে পাই, অন্তরটা ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে।

চকরিয়া থেকে বাড়ি এসে আমি আমার মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কোথা থেকে যে এতো কান্না আমার চোখে এসে ভিড় করে- আমি দীর্ঘ প্রায় একঘণ্টা শব্দ করে কাঁদি। যে শব্দগুলো হয়তো আমার মৃত্যু-দুয়ারে গিয়ে আটকে গিয়েছিল। মায়ের বুকে জীবিত ফিরে এসে হয়তো সেগুলো মুক্তি পেল!

এসইউ/জেআইএম