জাতীয়

কী পারবে নিরাপত্তা পরিষদ, কতটা পারবে বাংলাদেশ?

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য বর্তমানে বাংলাদেশে আছে। তাদের এই সফর চলমান সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারবে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে।

Advertisement

এতে বলা হয়েছে, বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, এটা (ইউএনএসসির প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর) বাংলাদেশের সামনে বিরাট সুযোগ এটা তুলে ধরার যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ‘বড় কোন অগ্রগতি হয়নি এবং মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব’ আছে। তারা বলছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে এটাকে বাংলাদেশের কাজে লাগাতে হবে।

উএনএসসির প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারবে তার সঙ্গে এ প্রশ্নও উঠেছে সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কতটা ভূমিকা নিতে পারবে?

সফরকারী প্রতিনিধিদলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই পাঁচ স্থায়ী সদস্যের প্রতিনিধি রয়েছেন। অপর সদস্যদের মধ্যে বলিভিয়া, গিনি, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, কুয়েত, লেদারল্যান্ডস, পেরু, পোল্যান্ড ও সুইডেনের স্থায়ী প্রতিনিধিগণ এবং আইভরি কোস্টের ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধি রয়েছেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পেরুর প্রেসিডেন্ট গুস্টাভো মেজা-কাদরা।

Advertisement

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা আইওএমের

প্রতিনিধি দলটি গতকাল কক্সবাজারে পৌঁছানোর পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব খুরশিদ আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই ইস্যুটার ওপরে তারা যদি সরেজমিনে সচক্ষে দেখে যান, তারা কী অবস্থায় আছে এবং কী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে এদিকে চলে আসছে - পরবর্তী কার্যক্রমে তাদের (নিরাপত্তা পরিষদের) সুবিধা হবে। আমরা তাদের অবশ্যই বোঝাতে চেষ্টা করবো এই কষ্ট থেকে তাদের (রোহিঙ্গাদের ) মুক্তি দেয়া যায় এবং বাংলাদেশের ওপর যে একটা বোঝা সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।’

২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নতুন করে সহিংসতার পর সীমান্ত পেরিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগেও তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসে । প্রতিনিধি দলের সফরের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে সাবেক কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের এই সফর নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টির গুরুত্ব তারা উপলব্ধি করেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘অবশ্যই তাদের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। কারণ যেহেতু নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। এতদিন নিরাপত্তা পরিষদে দেখেছি কোনো আলোচনাই হচ্ছিল না, পরে আলোচনা হয়েছে, তারপর এক পর্যায়ে নিরাপত্তা পরিষদ প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট ইস্যু করেছে, এখন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং-এর জন্য তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আসছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে তারা বিষয়টার গুরুত্ব উপলব্ধি করে।’

Advertisement

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা সঙ্কট : বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার অস্ট্রেলিয়ার

নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক রোজানা রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, জাতিসংঘের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের সামনে এটি বড় একটি সুযোগ।

তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘ হচ্ছে এমন একটি জায়গা, একমাত্র যে সংগঠন যারা মিয়ানমারকে রাজি করাতে পারে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং নাগরিকত্বের ব্যাপারে। মিয়ানমার কারও কোনও পরোয়া করে না। কিন্তু জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে তার এক ধরনের দায়বদ্ধতা আছে। বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন লেভেলে, এবং এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে জাতিসংঘের মাধ্যমে জিনিসটা সমাধানের চেষ্টা করা। একসাথে এগুলো ডেলিগেটকে পাওয়া এবং তাদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরার খুব বড় একটি সুযোগ।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির মনে করেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ চাইলে ভূমিকা নিতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশকে সেজন্য আরও কূটনীতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি বলছেন, ‘নিউইয়র্কে যখন জাতিসংঘের সদস্যরা কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন তখন এসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকারের বা রাজধানীর প্রভাব বিস্তার করে। সেইসব জায়গায় আমাদের এখন আরও কাজ করতে হবে।’

আরও পড়ুন : মিয়ানমারে নতুন করে সংঘাত, পালিয়েছে আরও কয়েক হাজার

তার কথায়, ‘নিরাপত্তা পরিষদ ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা অন্য কোনো ধরনের চাপ তৈরি করতে পারে মিয়ানমারের ওপর। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য যদি সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেন সেক্ষেত্রে উদ্যোগ সফল হবে, তবে সেটা না হলে আলাপ-আলোচনা থেমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সেই জায়গায় আমাদের সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।’

কিন্তু জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার ভেটো প্রদানের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে বাধার সৃষ্টি করছে, সেখানে জাতিসংঘের অবস্থান কতটা পরিবর্তন হবে?

সে প্রসঙ্গে রোজানা রশিদ বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদে বারবার যে ভেটো দেয়া হচ্ছে চীন বা রাশিয়ার পক্ষ থেকে সেটা কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের অবস্থানকে প্রভাবিত করছে। সেখানে এই ধরনের প্রতিনিধি দল আসা সেটা ইতিবাচক নিদর্শন এবং তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে । জাতিসংঘও কিন্তু বুঝতে পারছে, প্রত্যাবাসনের যে তারিখ দেয়া হয়েছিল, চুক্তি হয়েছিল কোনোটাই কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। জাতিসংঘ প্রথমদিকে যেভাবে আশাবাদী ছিল যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হচ্ছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু মিয়ানমারের সেই সদিচ্ছা আসলে নেই । সে আইওয়াশ করছে সেটা তারা বুঝতে পারছে। ফলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মনোভাব বদলাচ্ছে।’

তিনি মনে করেন এই সুযোগটি বাংলাদেশের কাজে লাগাতে হবে।

আরও পড়ুন : প্রথম রোহিঙ্গা পরিবার ফেরত নিল মিয়ানমার

ইউএনএসসি টিম সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবে। এরপর দু’দিনের সফরে মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। সেখানে তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন।

সূত্র : বিবিসি বাংলা।

এনএফ/এমএস