ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকায়ই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। আর এ শব্দদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি লোপ পেয়েছে, যার মধ্যে ২৬ শতাংশই শিশু। বুধবার আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর ধানমণ্ডি আবাহনী মাঠের সামনে ‘শিশুর সঠিক বিকাশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ’- এ স্লোগান সামনে রেখে শিশু সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শব্দদূষণ নিয়ে কম কথা হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে দূষণ কমবে তো দূরের কথা বরং দিন দিন তা বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় শব্দদূষণ বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।
Advertisement
সমাবেশে ওয়ার্ক বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সকাল ৮টা থেকে ৯টা রাজধানীর ফার্মগেটে শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১২৯ দশমিক ৮, হাজারিবাগে ১২৯ দশমিক ৬, পল্টন মোড়ে ১১১ দশমিক ৬, শাহবাগে ১১৩ দশমিক ২ এবং শাহাজাহানপুরে ১২৭ দশমিক ৮ থাকে। অন্যদিকে বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ফার্মগেটে সর্বোচ্চ ১৩২ দশমিক ৪, হাজারিবাগে ১৩২ দশমিক ৮, পল্টন মোড়ে ১২৫ দশমিক ৭, শাহবাগে ১২৬ দশমিক ৭ এবং শাহজাহানপুরে ১০৯ দশমিক ৩ মাত্রা থাকে। শব্দদূষণের এ মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি।
শব্দদূষণ বন্ধে প্রতিবেদনে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- সরকারি ও বেসরকারি অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে যথাযথভাবে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ বাস্তবায়ন, বিধিমালার সংজ্ঞানুযায়ী চিহ্নিত জোনগুলোয় (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট স্থাপন, শব্দের মানমাত্রানুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেয়া, হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ, হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি ও চালকদের শব্দ সচেতনতার স্তর যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান, গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, সড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি, জেনারেটর এবং সব ধরনের যন্ত্রপাতি ও মেশিনের মানমাত্রা নির্ধারণ, শব্দের মানমাত্রা হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ, শিল্পকারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রদান না করা, অনুমতি ছাড়া সভা-সমিতিসহ যে কোনো অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ, কমিউনিটিভিত্তিক কমিটি করে শব্দদূষণ সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের বিষয়ে তদারকির দায়িত্ব প্রদান, সর্বসাধারণের মাঝে শব্দদূষণের ক্ষতি-প্রতিকার এবং বিদ্যমান আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
এদিকে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো হলে গাড়িসহ তা জব্দের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু এরপরও হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো বন্ধ হচ্ছে না। রাজধানী ঢাকা নানা দিক থেকেই বাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার এই শব্দদূষণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দুঃখজনক হচ্ছে, সারাদেশে যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে সরকারি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছে না কেউ। বরং দেশের অধিকাংশ যানবাহনেই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণভাবে মানুষ ৪০ থেকে ৪৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দই ভালো শুনতে পায়। তার চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তিসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ যানবাহনে এখনো ব্যবহার হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন। যা ১০০ ডেসিবলেরও বেশি মাত্রার শব্দ সৃষ্টি করে থাকে।
Advertisement
মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহারে মাত্র ১০০ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে জরিমানা মাত্র ১০০ টাকা হওয়ায় গাড়ির চালকরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। তাছাড়া অনেক চালক আইনে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধের বিষয়টি জানেও না। মানুষের শ্রবণ সীমার স্বাভাবিক মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল। যার বেশি হলে শব্দ দূষণে পরিণত হয় যা থেকে মানুষের শরীরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শ্রবণ ক্লান্তি এবং বধিরতা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া যে সকল রোগ হতে পারে তার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, কণ্ঠনালীর প্রদাহ, আলসার, মস্তিষ্কের রোগ, কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস, বদমেজাজ বা খিটখিটে মেজাজ, ক্রোধ প্রবণতা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, রক্তনালীর সংকোচন এবং হার্টের সমস্যা অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ মানুষকে অস্থায়ী বধির এবং ১০০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ মানুষকে স্থায়ী ভাবে বধির করে দেয়। শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে হলে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধের আদেশ যাতে বাস্তবায়ন হয় এ ব্যাপারে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও আমদনি নিষিদ্ধ নয় বা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। তাই আমদানি করা হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন। এ ব্যাপারে আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে আমদানির ওপর। গাড়ির চালককেও সচেতন করতে হবে। শব্দদূষণ থেকে সবাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনুধাবন করতে হবে সেটিও।
এইচআর/এমএস