যাত্রীবাহী দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারান রাজীব। টানা দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন তিনি। রাজীবের হাত হারানোর রেশ কাটতে না কাটতেই বেপরোয়া অপর এক যাত্রীবাহী বাসের চাপায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় গৃহকর্মী রোজির পা।
Advertisement
যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সকাল সকাল রাজপথে নেমেছিলেন লালবাগ জোনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. দেলোয়ার হোসেন। ট্রাফিক আইন অমান্য করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বাস উল্টো পথে চলছিল। বাসটি থামানোর পর পুলিশের সঙ্গে উল্টো তর্কে জড়ান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাসচালক ও হেলপার। একপর্যায়ে চালক বেপরোয়া হয়ে বাসটি চালাতে থাকেন। ওই সময় বাসের চাকায় পিষ্ট হয় ট্রাফিক ইন্সপেক্টর দেলোয়ারের পা। যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে ইন্সপেক্টর দেলোয়ার এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন হাসপাতালে।
আরও পড়ুন : রোজিনা হাসপাতালে : চালকের জামিন
সারাদেশে এভাবে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। চালকদের খামখেয়ালিপনা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতাই এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেনের হাত হারানোর রেশ না কাটতেই একইভাবে গোপালগঞ্জে হাত হারান খালিদ হাসান হৃদয় (৩০) নামে এক পরিবহন শ্রমিক। রাজধানীর বনানীতে বিআরটিসি গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে পা হারান গৃহপরিচারিকা রোজিনা।
Advertisement
শুধু বেপরোয়া গাড়ি পরিচালনাই নয়, সততা ও নৈতিকতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে। সম্প্রতি রাজধানীর বাড্ডায় তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টারও অভিযোগ ওঠে। যদিও পরবর্তীতে শ্লীলতাহানির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ওই বাসের চালক-সহকারী-কন্ডাক্টরকে গ্রেফতার করা হয়।
আরও পড়ুন : আজকের জন্য এই রকম একটি মেয়ে দরকার
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নম্বরধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন রাস্তায় চলছে যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য। অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখের।
রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে, ফলে এসব বাসে দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা, বা কারো জীবন চলে যাচ্ছে। সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্য মতে, সারাদেশে জানুয়ারি, ২০১৮ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ৭৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৮৪১ জনের প্রাণহানী এবং পাঁচ হাজার ৪৭৭ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে সারাজীবনের মতো পঙ্গুত্ববরণ করেন ২৮৮ জন।
Advertisement
আরও পড়ুন : রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্যে জড়িত
এতো নিয়মনীতির পরও কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না বাসের অসম প্রতিযোগিতা, কমানো যাচ্ছে না প্রাণহানী। সম্প্রতি যাত্রীবাহী বাসের ‘বেপরোয়া’ চলাচল নিয়ন্ত্রণে নতুন কৌশল হাতে নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। ট্রাফিকের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের সদস্যরা নিয়মিত নিজের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নজরদারি করবেন বাস, ট্রাক আর প্রাইভেটকারের গতিবিধির ওপর।
আরও পড়ুন : ট্রাফিক অভিযানে প্রতি মিনিটে মামলা
ডিএমপি জানায়, সড়কে কোনো যাত্রীবাহী বাস বেপরোয়া গতিতে চলাচল করলে সঙ্গে সঙ্গে সেটি আটকের ব্যবস্থা করবেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে কর্তব্যরত সার্জেন্টের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রয়োজনে ম্যাজিস্ট্রেট এনে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
এছাড়া ট্রাফিকের চার বিভাগ চারদিন করে মোট ১৬ দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএমপি। ইতোমধ্যে সে কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন : বেপরোয়া গতি : চার বাসচালক-হেলপারের কারাদণ্ড
ডিএমপির ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এস এম মুরাদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে এটি (সড়ক দুর্ঘটনা) একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বেপরোয়া গাড়ি শনাক্তে নজরদারিরও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, মামলাও দেয়া হচ্ছে।’
‘সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা চালক-সহকারী ও বাসমালিকদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। তাদের এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছি’- যোগ করেন তিনি।
আরও পড়ুন : ট্রাফিক পুলিশদের ‘সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার’ করার নির্দেশ
ডিএমপি জানায়, সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিচালিত গত ২০ ও ২১ এপ্রিলের বিশেষ অভিযানে মোট চার হাজার ৮৬৪টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। ৫৩টি গাড়ি ডাম্পিং এবং ৬৫৫টি গাড়ি রেকারিং করা হয়েছে। ১৩ লাখ দুই হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, নিয়মিত অভিযান চলছে। সর্বশেষ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযান চালানো হয়। এতে গাবতলী-সদরঘাট রুটে চলাচলকারী ৮ নম্বর বাসের সহকারী সজিব, নিউভিশন পরিবহনের চালক মামুন, আয়াত পরিবহনের চালক রুহুল আমিনকে এক মাস করে এবং লাব্বাইক বাসের সহকারী স্বপনকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন : ঢাকার রাস্তায় ডিএমপির ৩৬০ ডিগ্রি সার্ভিলেন্স কার
চালকদের এমন বেপরোয়া হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ঢাকার অধিকাংশ বাসের চালকরা মাদকাসক্ত ও অধৈর্য। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এসব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয় বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলতে চাই। কেননা আমাদের সড়কে পরিকল্পিতভাবে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে আমাদের যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ইজারায় প্রতিটি মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দিয়েছে। এতেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে।’
আরও পড়ুন : যানজটই দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে
‘এমন পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে এর নিচে কে পড়লো বা কার হাত-পা হারালো, তা দেখার সময় নেই চালকদের। এখনই এ বিষয়ে কঠোর আইন প্রয়োগ না হলে সামনে আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে’- যোগ করেন তিনি। এআর/এমএআর/এমএস