মতামত

আরও একটি সমাবর্তন ভাষণ

কয়েক সপ্তাহ আগে আমি এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। বিভ্রান্ত একটি তরুণ দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর সেদিন প্রথম একটি বড় অনুষ্ঠানে গিয়েছি। পাস করে যাওয়া ছেলেমেয়েদের জন্য সেদিন খেটেখুঁটে একটা ভাষণ লিখে নিয়েছিলাম।

Advertisement

তাদেরকে যে কথাগুলো বলেছিলাম, সেই কথাগুলো আসলে আমি অন্যদেরও বলতে চাই, এখানে সেই সুযোগটি নিচ্ছি! ভাষণটি ছিল এ রকম-

আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা,আজকের এই দিনটি এবং এই মুহূর্তটি নিঃসন্দেহে তোমাদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। আজকে তোমরা এই অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র বা ছাত্রী হিসেবে এবং এই সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে তোমরা এখান থেকে বের হয়ে আসবে কর্মজীবনে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত একজন মানুষ হিসেবে। তোমাদের জন্য দিনটি একই সঙ্গে আনন্দের এবং দুঃখের। এটি দুঃখের একটি দিন। কারণ, একজনের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এবং সেই জীবনটি আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হতে যাচ্ছে! এটি আনন্দের একটি দিন। কারণ, আজকে তোমরা তোমাদের জীবনের একটি অধ্যায় শেষ করে নতুন একটি জীবনে প্রবেশ করার সনদ পেয়েছো।

আজকের এই ক্ষণটি তোমাদের জন্য আনন্দের বা দুঃখের যাই হোক না কেন, আমার জন্য নিঃসন্দেহে এটি নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের দিন। এই মঞ্চ থেকে সামনে উপস্থিত শত শত গ্র্যাজুয়েটের আনন্দিত এবং গৌরবোজ্জ্বল মুখের যে দৃশ্যটি দেখা যায়, তার মতো সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। আমাকে সেই সুন্দর দৃশ্যটি উপহার দেওয়ার জন্য তোমাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। শুধু তাই নয়, আমি যদি শিক্ষকসুলভ অভ্যাসের কারণে তোমাদের অকারণ উপদেশ দিয়ে এবং গুরুতর নীতিকথা শুনিয়ে ভারাক্লান্ত করে না ফেলি, তোমরা সম্ভবত আজকের এই দিনটির সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও স্মরণ রাখবে- এটি আমার জন্য অনেক বড় একটি পাওয়া।

Advertisement

এই যে আমার সামনে তোমরা শত শত গ্র্যাজুয়েট উজ্জ্বল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছ এবং আমি এই অসাধারণ দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে আছি, আমি কিন্তু শুধু একটা সুন্দর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে নেই, আমি কিন্তু একটা বিশাল সম্পদের ভাণ্ডারের দিকে তাকিয়ে আছি। ২০০০ সালে যখন নতুন মিলেনিয়াম শুরু হয়েছিল, তখন পৃথিবীর সব জ্ঞানী-গুণী মানুষ অনেক চিন্তাভাবনা-গবেষণা করে বলেছিলেন, এই নতুন সহস্রাব্দের সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। মাঠের ফসল বা নদীর মাছ নয়, তেলের খনি বা সোনার খনি নয়, ইলেকট্রনিকস বা যুদ্ধাস্ত্রের ইন্ডাস্ট্রি নয়, সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান! গত চার বছর তোমরা অনেক পরিশ্রম করে সেই জ্ঞান অর্জন করেছ বলেই আজকে তোমরা এখানে উপস্থিত হয়েছ। আমার সামনে তোমরা আসলে বিশাল একটি জ্ঞানের ভাণ্ডার- যার অর্থ, তোমরা আসলে বিশাল একটি সম্পদের ভাণ্ডার! মাটি খুঁড়ে একটা সোনার খনি কিংবা একটা গ্যাসফিল্ড খুঁজে পেলে যে রকম দেশের সম্পদ বেড়ে যায়, আজকে তোমরাও ঠিক সে রকম একটি সোনার খনির মতো বা গ্যাসফিল্ডের মতো দেশের সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছ। সত্যি কথা বলতে কি, তোমরা তার চেয়েও বেশি। কারণ সোনার খনি কিংবা গ্যাসফিল্ডের একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে। তোমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নেই, তোমরা কত বড় সম্পদ হবে, সেটি নির্ভর করছে তোমাদের সৃজনশীলতার ওপর, তোমাদের স্বপ্নের ওপর, সেই স্বপ্নকে তোমরা কতটুকু সামনে নিয়ে যাবে তার ওপর।

তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আমাকে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সে হিসেবে আমার দায়িত্ব কর্মজীবনে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে তোমাদের খানিকটা সাহায্য করা। সে কাজটুকু আমি কতটুকু পারব জানি না; তাই সে পথে অগ্রসর না হয়ে আমার এই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে সত্যগুলো আবিস্কার করেছি, তার কয়েকটি তোমাদের জানিয়ে দিই। আজ থেকে কয়েক যুগ পরে তোমরা হয়তো নিজেরাই বিষয়গুলো আবিস্কার করবে। আমি সেই বিষয়গুলো এখনই জানিয়ে দিয়ে তোমাদের খানিকটা সময় বাঁচিয়ে দিই। আমি পৃথিবীর সব মানুষকে এক ধরনের সরলীকরণ ফর্মুলা দিয়ে দু’ভাগে ভাগ করেছি। এক ভাগ হচ্ছে- যারা সবকিছুতে আগ্রহী এবং উৎসাহী। তারা নিজের ঘাড় পেতে দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারা নিজের খেয়ে শুধু বনের মোষ নয়, বনের বাঘ-ভাল্লুক-গণ্ডার তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা যেটুকু করা সম্ভব তার চেয়ে বেশি করার চেষ্টা করে। তারা সবকিছুর নেতৃত্বে থাকে, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাদের ওপর দিয়ে যায় এবং তাদের জীবনে সাফল্যের তালিকা থেকে ব্যর্থতার তালিকা অনেক বেশি।

আমার সরলীকরণ ফর্মুলার দ্বিতীয় ভাগের মানুষেরা আগ্রহহীন, উৎসাহহীন এবং নির্লিপ্ত। তারা নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা করে না বলে তাদের জীবনে কোনো ব্যর্থতা নেই। তারা দায়িত্ব নিতে চায় না, নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী নয়, বড়জোর অন্যের আদেশ-নির্দেশ পালন করে জীবনটি কাটিয়ে দিতে চায়! তোমরা যদি প্রথম ভাগের আগ্রহী-উৎসাহী মানুষ হয়ে থাক, তোমাদের অভিনন্দন। তোমরা জীবনে অসংখ্যবার ভুল করবে, তোমরা অসংখ্যবার ব্যর্থ হবে। অসংখ্যবার তোমাদের আশা ভঙ্গ হবে। কিন্তু তোমরা জীবনের আনন্দের তীব্রতা অনুভব করবে এবং তোমরাই এই পৃথিবীর নেতৃত্ব দেবে। আর তোমরা যদি দ্বিতীয় ভাগের আগ্রহহীন, উৎসাহহীন নির্লিপ্ত মানুষ হয়ে থাক তোমাদের বলব, এই জীবনের সব আনন্দ কিন্তু তোমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, জীবন উপভোগ করার তীব্র আবেগ কিন্তু তোমরা উপভোগ করতে পারবে না। তোমরা কি লক্ষ্য করেছ, আমি কিন্তু একবারও মেধাবী শব্দটি ব্যবহার করিনি? আমার কাছে মেধাবী শব্দটির কোনো গুরুত্ব নেই। যে আগ্রহী, উৎসাহী এবং যে পরিশ্রম করতে রাজি আছে, আমার কাছে তার গুরুত্ব অনেক বেশি। যদি আমাকে আমার জীবনে কখনও খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করতে হয়, আমি কিন্তু একশ’জন মেধাবী মানুষ খুঁজে বেড়াব না, আমি একশ’জন আগ্রহী, উৎসাহী এবং পরিশ্রমী মানুষ খুঁজে বের করব।

তোমরা সবাই নিশ্চয়ই হুমায়ূন আহমেদের নাম শুনেছ। সম্পর্কে সে আমার অগ্রজ- সে তার জীবনে অনেক কিছু লিখেছে। কোনো একটি জায়গায় সে লিখেছিল, একটা কচ্ছপের আয়ু তিনশ’ বছর অথচ একজন মানুষের আয়ু মাত্র ষাট-সত্তর বছর, খোদার এটি কোন ধরনের বিচার? হালকা কৌতুকের ঢঙে বলা এই বাক্যটি কিন্তু আসলেই চিন্তা করে দেখার বিষয়। কচ্ছপ তার সরীসৃপের মস্তিস্ক নিয়ে খাওয়া আর বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কী-ইবা করতে পারে? তার তুলনায় একশ’ বিলিয়ন নিউরনের তৈরি আমাদের মস্তিস্ক কী অসাধারণ একটি ব্যাপার। আমার দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা অনুভব করতে পারি, আমরা কল্পনা করতে পারি, স্বপ্ন দেখতে পারি, এমনকি যেটি নেই সেই বিমূর্ত চিন্তাও করতে পারি। একশ’ বিলিয়ন আলোকবর্ষ বিস্তৃত এই দৃশ্যমান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রায় এক ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সির মধ্যে মিল্ক্কিওয়ে নামে আমাদের গ্যালাক্সির সাদামাটা একটি নক্ষত্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকা গ্রহগুলোর পৃথিবী নামের একটি নীলাভ গ্রহের লাখ লাখ প্রাণীর ভেতর হোমোস্যাপিয়েনস নামে একটি প্রাণী হয়ে আমরা এই পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য সমাধান করার দুঃসাহস দেখিয়েছি। কাজেই আমরা কীভাবে আমাদের এই মূল্যবান জীবনটি অপব্যবহার করতে পারি? প্রকৃতি আমাদের ৬০ থেকে ৭০ বছর কর্মক্ষম হয়ে বাঁচতে দিয়েছে- এর প্রতিটি মুহূর্ত কি আমাদের সুন্দর করে বেঁচে থাকা উচিত নয়? উপভোগ করা উচিত নয়? প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে আমাদের জীবন উপভোগ করব?

Advertisement

আমি দাবি করি, জীবনকে উপভোগ করার রহস্যটি আমি আমার মতো করে সমাধান করেছি। তোমরা কি সেটি আমার কাছে জানতে চাও? সেটি হচ্ছে, কেউ যদি নিজের জীবনকে উপভোগ করতে চায়, তাহলে তাকে অন্যের জন্য কিছু করতে হবে। বাংলাদেশ এখন আর দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাপীড়িত ভঙ্গুর অর্থনীতির একটি দেশ নয়, এটি অর্থনীতির মহাসোপানে পা দিয়েছে। আমি আমার ছাত্রজীবন শেষ করে যে বাংলাদেশে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলাম, সেখানে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১১০ ডলার। বিশ্ববিখ্যাত অর্থনৈতিক সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’ জানিয়েছে, এখন বাংলাদেশে তোমাদের মাথাপিছু আয় ১৭৫২ মার্কিন ডলার। তখন অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার, এখন তার আকার ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছি আমাদের শিক্ষকরা আমাদের পরিস্কার করে বলে দিয়েছিলেন, পাস করার পর দেশে আমাদের কোনো চাকরি নেই। এখন গত বছর দেশ-বিদেশে ২৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমাদের স্বপ্ন দেখার কোনো সুযোগ ছিল না, তোমাদের এই বাংলাদেশ নিয়ে তোমরা স্বপ্ন দেখতে পারবে। কারণ যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারস এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, সামনের বছরগুলোতে পুরো পৃথিবীতে যে তিনটি দেশ খুবই দ্রুতগতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখবে তার একটির নাম বাংলাদেশ।

কাজেই আমার সামনে তোমরা যারা বসে আছ, তারা বাংলাদেশের একটি প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসেছ, তোমরা একটুখানি পরিশ্রম করলেই নিজের জীবনের জন্য চমৎকার একটি কাজ খুঁজে পাবে। নিজের দায়িত্ব নিতে পারবে, নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে। কিন্তু যদি সেখানেই থেমে যাও তাহলে কিন্তু জীবনকে উপভোগ করার আনন্দটি পাবে না। যদি জীবনকে উপভোগ করতে চাও তাহলে অন্যের জন্য কিছু করতে হবে। এই মুহূর্তে কথাগুলো তোমাদের বিশ্বাস নাও হতে পারে; কিন্তু যখন জীবন সায়াহ্নে পৌঁছাবে তখন কিন্তু তোমার কতগুলো বাড়ি, কতগুলো গাড়ি আর ব্যাংকে কতগুলো টাকা জমা হয়েছে তার হিসাব করবে না, তুমি হিসাব করবে অন্যদের তুমি কতটুকু দিয়েছ। সমাজকে কী দিয়েছ, দেশকে কী দিয়েছ! পৃথিবীকে কী দিয়েছ?

তোমাদের সমাবর্তনে বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখার জন্য আমাকে যখন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তখন আমি যে মানুষটি ছিলাম, এই মুহূর্তে তোমাদের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছি সেই আমি কিন্তু তার থেকে ভিন্ন। তোমরা হয়তো জেনে থাকবে আমি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছি। কেউ যখন এ রকম একটি অবস্থা থেকে ফিরে আসে, তখন তার জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হতে পারে এবং আমার ধারণা, আমার বেলাতেও সেটি ঘটেছে। অনেক বিষয় যেগুলো আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো হঠাৎ করে সেগুলো আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। আবার অনেক বিষয় যেগুলো আগে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, হঠাৎ করে সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে। যে বিষয়টি আমার কাছে এই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে, সেটি ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আমার ধারণা, আমরা পৃথিবীর একটি ক্রান্তিকালে বসবাস করছি। আমাদের এখন রয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, রয়েছে একজনের মতের সঙ্গে অন্যের মত নিয়ে অসহিষুষ্ণতা। আমাদের বিশ্বাস থেকে ভিন্ন হলেই আমরা ধরে নিই সেটি ভুল। আমরা মনে করি, আমি যে বিষয়টি বিশ্বাস করি সেটাই হচ্ছে একমাত্র সত্যি, অন্য সবকিছু মিথ্যা। আমি তোমাদের সামনে এখানে দাঁড়িয়ে দেখাতে পারব যে, এ ধরনের ধারণা আসলে ভুল।

আমি খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। একটা কাগজে আমি একটা ইংরেজি অক্ষর লিখে এনেছি। আমি তোমাদের সামনে অক্ষরটি তুলে ধরছি এবং তোমরা নিশ্চিতভাবে বলবে এই ইংরেজি অক্ষরটি হচ্ছে – Z। কিন্তু এই অক্ষরটি যদি ঘুরিয়ে অন্য দিক থেকে তোমাদের দেখাই তুমি বলবে- এটি ইংরেজি অক্ষর N. এখন আমি তোমাকে প্রশ্ন করি, অক্ষরটি কী Z নাকি N? কোনটি সঠিক?

তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ দুটিই সঠিক। তুমি কোন দিক থেকে দেখেছ তার ওপর নির্ভর করছে তুমি কোনটি দেখবে! শুধু ইংরেজি এই দুটি অক্ষরের জন্য এটি সত্যি নয়, রাজনীতি, সমাজনীতি বা ধর্মের যে কোনো বিষয় সম্পর্কেও এটি সত্যি। যে ধারণাটি আমি পুরোপুরি সঠিক মনে করি, সেটি আরেকজনের কাছে সঠিক মনে নাও হতে পারে। সে অন্যদিক থেকে দেখছে বলে তার কাছে বিষয়টি অন্যরকম মনে হতে পারে! যদি এটা আমরা মেনে নিই, হঠাৎ করে আমরা আবিস্কার করব আমরা একে অন্যকে অনেক বেশি সহ্য করতে পারছি। যদি মতের বিরোধিতা হয় আমরা কথা বলে, যুক্তি দিয়ে সেই বিরোধিতার সমাধান করব। অনেক সময় সমাধানও করতে হবে না। মতের ভিন্নতা মেনে নিয়েই পাশাপাশি বেঁচে থাকব।

আমাদের কিছুতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে, ভিন্নতা হচ্ছে বৈচিত্র্য এবং সেই বৈচিত্র্যই হচ্ছে পৃথিবীর সৌন্দর্য। পৃথিবীর সব মানুষের ভাষা, ধর্ম, পোশাক, কালচার, জীবন-পদ্ধতি যদি হুবহু এক রকম হতো, তাহলে এই পৃথিবী থেকে নিরানন্দ এবং একঘেয়ে পৃথিবী আর কী হতো?

তোমরা এই দেশের নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মশালটি এখন তোমাদের হাতে। তোমরা কর্মজীবনে কী কর, তার ওপর নির্ভর করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম। তাই তোমাদের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে হবে। মনে রেখো বড় স্বপ্ন না দেখলে বড় কিছু অর্জন করা যায় না!

এই দেশটি তরুণদের দেশ। ’৫২ সালে তরুণরা এ দেশে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে, একাত্তরে সেই তরুণরাই মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করেছে, অকাতরে রক্ত দিয়েছে। আমাদের দেশটি এখন যখন পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে আবার সেই তরুণরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। তোমরা সেই তরুণদের প্রতিনিধি- তোমাদের দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই, আমি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি।

তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা- ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আমাকে নতুন একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

এনএফ/এমএস