মতামত

গণপরিবহনে নারী নির্যাতন ও নারীর ক্ষমতায়নের বাগাড়ম্বর

আপনি নারী চলন্ত বাসে অপরিচিত ধূমপানরত পুরুষ সহযাত্রীকে একবার বলে দেখবেন, সিগারেট টি ফেলে দিন। সেকেণ্ড দেরি করবে না উত্তর দেবে, প্রাইভেট গাড়িতে যান। আপনি আশা করবেন আশেপাশে কেউ দাঁড়াবে এই বে আইনি বিষয়টির প্রতিবাদ করে আপনার পক্ষে? হতাশ হবেন। দেখবেন কেউ আপনার পক্ষ নিচ্ছে না। নৈতিকতার জায়গা থেকেও নয়। দায়িত্বের জায়গা থেকেও নয়। বরং সবাই হো হো করে হেসে ওঠবে আর আপনি হবেন উপহাসের পাত্রী।

Advertisement

গণপরিবহনে যাত্রী হয়রানির এটা এক সামান্য উদাহরণ। খুবই সামান্য। গণপরিবহনে যে নারীরা যাতায়াত করেন তারা জানেন এ খুবই সামান্য হয়রানি। নারীরা ছোটখাটো এসব হয়রানি গায়েই মাখেন না। পুরুষ সহযাত্রীরা হয়তো ঠাসাঠাসি দাঁড়ানোর সময় ইচ্ছে করে কনুইটা গোঁতা দিয়ে রাখলেন নারীর বুক ঘেঁষে। কেউ হয়তো নামার সময় ইচ্ছে করে হাতটা ঘঁষিয়ে গেলো নারী দেহের কোন নাজুক অংশ। একটু ভদ্রস্থ হয়ে বসলে যেখানে নারী সহযাত্রী টি নির্বিঘ্নে বসতে পারে সেখানে হয়তো পুরুষ সহযাত্রী এভাবে বসবে যে নারী সহযাত্রী টি নিজেকে সংকুচিত করতে করতে আসন থেকে পড়ে গিয়েও শেষ রক্ষা নেই।

এসব তো নিত্য সওয়া। ঘর থেকে বের হওয়া নারীদের প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে এসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে ঘর থেকে বের হওয়াই বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হবে। যে লক্ষ্যে নিয়ে যার ঘর থেকে বের হওয়া সেই লক্ষ্য অভিমুখী আদৌ দৌড়ানো যাবে না।

অতএব কী দরকার প্রতিবাদের, কোনরকমভাবে গা বাঁচিয়ে এইসব নোংরা স্পর্শের স্মৃতি ঝেরেঝুরে দিন চালিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু এই সয়ে সয়ে চালিয়ে যাওয়া আজ আমাদের নারীদের এমন এক স্থবির অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে যে সামনেপিছনে সংকুচিত করে করে নিজের অস্তিত্বই আর রক্ষা করার কোন সুযোগ খোলা নেই। এসব যৎসামান্য উত্যক্ত করা হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন মরণ সমস্যা।

Advertisement

হয়তো এ সমস্যা আগেও ছিলো। হয়তো প্রকটই ছিলো। প্রচারের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের অগোচরে থেকে যেতো। এবং হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্য প্রচারের কারণে আমাদের গোচরিভূত হচ্ছে দ্রুত। আমরা জানছি তাই দৃশ্যমান হচ্ছে ভয়াবহতা। কিংবা হয়তো ছিলো না। নানা বিপরীত অনুষঙ্গ এই প্রবণতাকে উৎসাহিত করছে। অবাধ পর্ণগ্রাফি কিংবা দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড কে উল্লেখ করা যায় উল্লেখযোগ্য 'প্রেরণাদায়ক' হিসেবে।

ইতিবাচক প্রেরণাদায়ক শব্দটি তার প্রচলিত মর্মার্থ মিথ্যে করে এখানে উন্মোচিত হয়েছে এক জঘন্য জৈবিক বৃত্তির উন্মেষের কারণ হিসেবে। নইলে কেনো ইদানীং গণপরিবহনে নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণ প্রচেষ্টা এমনকি ধর্ষণের পর হত্যার মতো ঘটনাও ডালভাত হয়ে ওঠেছে!

গাজীপুর শালবনে ঘাড় মটকে মেরে ফেলা বহুল আলোচিত রূপার কথা বাদ দিয়ে এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকে চোখ ফেরাই। 'লাব্বায়েক' বাসের ভেতরে লেদার টেকনোলজির ছাত্রী, 'তুরাগ' বাসে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, মা নেমে যাবার পর মেয়েকে আটকে দেয়া ভিকারুন্নেসার ছাত্রী টিফিন বক্সের আঘাতে পরিবহন শ্রমিককে আঘাত করে যে আত্মরক্ষা করেছে,কিংবা ইডেন কলেজের সেই ছাত্রী যার ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে আটক করা হয়েছে দুই অপরাধী পরিবহন শ্রমিককে।

খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনা। এই ভয়াবহ অনিরাপত্তা যেনো নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে গণপরিবহনে। এই অবস্থা কী একদিনে তৈরি হয়েছে? নিশ্চই না। জাতীয় জীবনে ক্রমবর্ধমান নৈতিক অবক্ষয়, প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার মতো মূল্যবোধ এর অভাব আজ জাতিকে এই ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

Advertisement

পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকেরা যে অশিক্ষিত, নৈতিকতার শিক্ষাহীন সমাজ থেকে আগত সে সমাজে জৈবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ তাদের ব্যক্তিগত দৃঢ়তার কাছে কিছু অসম্ভব বটে। কিন্তু যে দেশের অধিকাংশ নাগরিকই একই শ্রেণির সামান্য উপরে নিচেই বসবাস করে, সে দেশে নারীর এই অনিরাপত্তা শেষ পর্যন্ত নারীদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? যেখানে সামাজিক বিবর্তনের ধারায় নারীর ঘর থেকে বাইরে এসে পেশাজীবী হয়ে ওঠা আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা সম্প্রতি জানাচ্ছে শতকরা ৯৪% নারী গণপরিবহনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর কারণ কী? এ থেকে উত্তরণেরই বা পথ কী? উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা দুর্দান্ত এক আন্দোলন গড়ে তুলেছে গত দুইদিনে। জ্বালাও পোড়াওহীন এক অভিনব প্রতিবাদ। তারা তাদের সহপাঠী নির্যাতিত হওয়া তুরাগ পরিবহনের একাধিক বাস আটকে দিয়েছে তাদের ক্যাম্পাসে।

পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন মানুষ সামনে গিয়ে প্রতিরোধে রুখে দাঁড়ায়। এখন খুব বেশি প্রয়োজন রাষ্ট্রযন্ত্রের সদিচ্ছা। রাজনৈতিক বক্তৃতায় নারীর ক্ষমতায়ন বলে মুখে ফেনা তুলা রাষ্ট্র যন্ত্র যদি বিচার নিশ্চিত করে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে না তোলে তো এসব মধ্য আয়, উন্নয়নশীলতা সব বাগাড়ম্বরে পর্যবসিত হবে।

লেখক : নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/আরআইপি