একজন রোগীকে সুস্থ করে তুলতে বা বাঁচাতে শুধু চিকিৎসকেরই ভূমিকা থাকে না। এতে জোরালো ভূমিকা রাখেন নার্স, অায়া ও ওয়ার্ড বয়রাও। তবে সবার শুরুতে অবদান থাকে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের। তার কারণেই একজন আশঙ্কাজনক রোগীর দ্রুত চিকিৎসা করার সুযোগ পান চিকিৎসক ও নার্স। তাই জাগো নিউজের এবারের অায়োজন রোগীর জীবন রক্ষাকারী অ্যাম্বুলেন্স চালকদের নিয়ে।
Advertisement
মুমূর্ষু কোনো রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য একমাত্র পরিবহন ব্যবস্থা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দেয়াসহ সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এই অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। এ সত্ত্বেও জীবন বাঁচাতে প্রথম দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনকারী এই অ্যাম্বুলেন্স চালকদের নেই তেমন কোনো স্বীকৃতি। একইসঙ্গে সইতে হচ্ছে পুলিশি আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের হয়রানি। তেমনি একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক টাঙ্গাইলের আব্দুল মালেক (৪৯)। ১৯৯০ সালে টাঙ্গাইলে প্রথম চালু হওয়া অ্যাম্বুলেন্সের প্রথম চালকই তিনি। এ শুধু অর্থ উপার্জনের মোহ নয়, রোগী সেবার নেশায় আসক্ত হয়ে টানা ২৯ বছর যাবৎ অ্যাম্বুলেন্স চালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে নিয়োজিত থাকার ফলে এ পেশার প্রতি অন্তরে কখন যেন একটা ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। যার ফলে ধারাবাহিক ভাবে দিনরাত রোগী টানাসহ পুলিশ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের হয়রানি সহ্য করেও অন্য পেশায় যেতে পারিনি।
টানা ২৯ বছর অসংখ্য মুমূর্ষু রোগী পরিবহনকালে হৃদয় বিদারক বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন তিনি। তেমনই এক হৃদয় বিদারক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০০৪ সালের মাঝামাঝিতে এক সকালে হার্টের রোগে আক্রান্ত ও টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল গ্রামের এক মুমূর্ষ রোগীসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পথে যাত্রা করি। বেলা ১১টার দিকে নবীনগর পৌঁছেও যাই। এমন সময় মুমূর্ষু ওই রোগী হঠাৎ সিটে উঠে বসে তাকে বলে বসেন আমাদের কোথায় নিয়ে যাও? এ প্রশ্নের উত্তরে ওই রোগীকে ঢাকার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য নেয়ার কথা বলতেই তিনি রাগান্বিত স্বরে জানান ঢাকায় যেতে হবে না, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে টাঙ্গাইলে যাও। রোগীর এমন আচরণে হতভম্ব চালকসহ পরিবারের সদস্যরা পুনরায় টাঙ্গাইলের পথে যাত্রা শুরু করেন।
Advertisement
যাত্রা শুরুর বাগেই মুমূর্ষু ওই রোগী চালকের কাছে একটি সিগারেট চান। তার কাছে সিগারেট না থাকার কারণে রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে দোকান থেকে ওই রোগী সিগারেট কিনে পান করেন। সিগারেট পান শেষে আবার যাত্রা শুরুর পথে বাইপাইল সড়কে ওই একটু ঘুমাবেন ও টাঙ্গাইলে পৌঁছানোর পর তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে বলেন। এভাবে গোড়াই নামক স্থানে পৌঁছানোর পর চালক ও পরিবারের স্বজনদের রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্দেহ হলে নিকটস্থ মির্জাপুর কুমুদীনি হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহনের সময় এখনও সেই স্মৃতি তার মনে পড়ে।
এ সময় তিনি আরও জানান, টাঙ্গাইলে বর্তমানে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ৫৩টি। এরমধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ৩১টি অ্যাম্বুলেন্স চলে টাঙ্গাইলে ও ৭টি বিভিন্ন উপজেলায়। এছাড়াও সরকারি ভাবে আরও ১৩টি অ্যাম্বুলেন্স এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
তিনি আক্ষেপ করে জানান, দেশের অন্যান্য জেলায় এ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের ভাড়া বেশি হলেও টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য জেলা প্রশাসনের নির্ধারিত ভাড়া ৩৫শ ৫০ টাকা। তবে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই নিতে হচ্ছে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম ২৮শ থেকে ৩ হাজার টাকা। একই ভাবে পৌর শহরের যেকোনো এলাকায় নামমাত্র ৩-৫শ টাকার বিনিময়ে রোগী পরিবহন করছেন তারা।
এছাড়াও রোগী পরিবহনের মতো এমন মানবসেবায় নিয়োজিত থাকা এই অ্যাম্বুলেন্স চালকদের নেই নিরাপত্তা। প্রায় প্রতিদিনই এ চালকদের সইতে হচ্ছে পুলিশি হয়রানি, স্থানীয় বখাটেদের অত্যাচার আর কতিপয় অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের নির্যাতন। এ কারণে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস সার্ভিসের নির্ধারিত স্ট্যান্ড থাকলেও মানবতার সেবায় নিয়োজিত এই অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের জন্য নেই কোনো স্ট্যান্ড ব্যবস্থা। এমনকি এই অ্যাম্বুলেন্স চালকদের একটি শ্রমিক সংগঠনও গড়ে তুলতে দেয়া হয়নি। এ সত্ত্বেও হাসপাতালের সম্মুখ সড়কের ধারে গাড়ি পার্কিংয়ের মাধ্যমে মানবসেবার নেশায় আসক্ত এই অ্যাম্বুলেন্স চালকরা চালিয়ে যাচ্ছেন রোগী পরিবহন কার্যক্রম।
Advertisement
এফএ/আরআইপি