মতামত

ভার্চুয়ালের তোড়ে অ্যাকচুয়ালের দুর্দশা

পাসপোর্ট সারেন্ডার ইস্যুতে ভার্চুয়াল লড়াইয়ে আপাতত কাবু হয়ে গেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর আগে, প্রচারণা ছিল তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়েছেন। সৌদি আরবের নাগরিকত্ব নেয়ার তথ্যও চাউর ছিল কিছুদিন। দু’টির কোনোটাই তেমন ধোপে টেকেনি। তবে, এবার লন্ডনে স্ত্রী-কন্যাসহ তার পাসপোর্ট সারেন্ডারের প্রচারণাটির বাজার বেশ গরম। গত ক’দিন সকল গণমাধ্যমে এটির কাটতি জমজমাট।

Advertisement

বিশ্বের কোনো কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সম্প্রতি ভার্চুয়ালের জয়জয়কার মাত্রা ছাড়ানো পর্যায়ে। সাজিয়ে-গুছিয়ে কোনো যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়লেই বাজিমাত। বাজার গরম। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তা এখন অব্যর্থ অস্ত্র। পরাজয়ের যেন কোনো ঝুঁকিই নেই। আত্মবিশ্বাসও বেশি।

ভার্চুয়ালে প্রচারিত তথ্য সত্য না মিথ্যা, তা প্রমাণের অপেক্ষা থাকছে না। এর আগেই তা সত্য হিসেবে প্রচারে-প্রসারে উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাচ্ছে। নাজেহাল হয়ে বাদ-প্রতিবাদের শক্তিও হারিয়ে ফেলছে কমজুরি প্রতিপক্ষ। অথবা ততক্ষণে আরেক ইস্যু নিয়ে আসা হচ্ছে বাজারে। ততক্ষণে আগেরটি বাদ দিয়ে নতুনটি নিয়ে যতো মাতবোল। ভার্চুয়াল জগতের এ ক্যারিশমা টের পেয়ে দুর্বল ব্যক্তি-গোষ্ঠিও এখন ঝুঁকছে এ চেষ্টায়। যথাসাধ্য ফায়দাও বা বরকতও পাচ্ছে।

নিজেদের পক্ষে, প্রতিপক্ষের বিপক্ষে প্রতিযোগিতাটি অনেকাংশেই একতরফা। মনগড়াও। প্রতিপক্ষকে কেয়ার বা ধার ধারার দরকারই পড়ছে না। এর মূল কারণ এ প্রতিযোগিতায় অ্যাকচুয়াল বিষয়টিই প্রশ্নাতীত। কখনো সত্যকে ফুলিয়েফাপিয়ে মহাপ্রচার। কখনো আধা সত্যকে পুরো সত্য করার চেষ্টা। কখনো সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ। আবার কখনো আজগুবি-অবান্তর। হাল নমুনায় যে যেদিক দিয়ে পারছে নানা তথ্য, জরিপ, গবেষণা রিপোর্ট, ছবি ছড়ানোর ধূম তুলছে। কখনো বিদেশি কোনো প্রচারমাধ্যম বা সংস্থার বরাত দিয়ে আচ্ছারকমের তথ্যবাজি।

Advertisement

আমাদের ধান, পাট, চাল, ছাগল, গরু কিচ্ছু বাদ যাচ্ছে না। আমাদের আলো-বাতাস, পানি, ড্রেন-টয়লেটও তাদের কাছে সাবজেক্ট। দেশের অর্থনীতি, শিল্প, পরিবেশ নিয়ে জরিপের কোনো শেষ নেই। রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্য্য, বাসযোগ্যতা নিয়েও একেবারে সাংঘর্ষিক তথ্যসমৃদ্ধ জরিপ নজরে পড়ছে। মার্কিনিরা বাংলাদেশে এসে ক্যান্সারের ওষুধ কিনতে লাইন ধরে- এমন তথ্যও বাদ যাচ্ছে না। রাজনৈতিক বড় দু’দলের নানা তথ্য, দুই নেত্রীর জনপ্রিয়তা নিয়ে তথ্যও কম নয়। ভার্চুয়ালে পরস্পরকে ঘায়েল করার এ যুদ্ধে কেউ ঠকছে না। সবাই জয়ী হচ্ছে। আজ হারলেও কাল জিতছে বেশি লাইক, কমেন্টস, শেয়ারে।

ভার্চুয়ালে নানা জরিপে সরকারের আকাশ ছোঁয়া সাফল্যের প্রচারণার ঠিক উল্টোটাও চলছে। এ সরকারের কারণে দেশের মহাসর্বনাশের নানা খবরে মানুষ মাথায় হাত দিয়ে ফেলছে। বিভিন্ন দলকে জেতানো-হারানোর ভার্চুয়াল এ গেমে মানুষের গরজ কম হলেও আগ্রহ কম নয়। আলোচনা-সমালোচনা প্যাঁচালি হিসেবে চমৎকার। জরিপ পয়দা ও প্রচারকারী সংস্থাগুলোর কদর বাড়ছে। জরিপ মন মতো হলে একপক্ষ বেদম খুশি। ধুমছে প্রচার। অন্যপক্ষের তখন একমাত্র দায়িত্ব দ্রুত পাল্টা তথ্য প্রচারের এন্তেজাম। ফেসবুকসহ গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক তাজা তথ্য বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের করা বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শতব্যক্তির তালিকায় প্রধানমন্ত্রীর ২১ নম্বর আসনের খবর। নিউ ইয়র্কভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনটির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এই তালিকায় রয়েছে বিশ্বের দুই বিশেষ শাসক ট্রাম্প ও কিমের নামও। তারা যথাক্রমে এক নম্বর ও চার নম্বর প্রভাবশালী। আরেক নব্য শাসক সৌদী প্রিন্স সালমানকে রাখা হয়েছে পাঁচ নম্বরে। তালিকায় একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ নম্বরে। আরেকদিকে লেখা হয়েছে- তাঁর শাসনে মানবাধিকারের অবস্থা বাজে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বলপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটছে। সমালোচনা বা ভিন্নমত বরদাশত করে না। আবার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় প্রশংসা করা হয়েছে। ১০০ প্রভাবশালীর এই তালিকাভুক্তি আমাদের পক্ষে না বিপক্ষে? যে যার মতো বগল বাজাচ্ছেন। প্রভাবশালীর এ তালিকায় একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে জায়গা হয়েছে ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি ও অভিনেত্রী দীপিকা পাড়কোনেরও। এর আগে গেলোবার ফোর্বস ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় শেখ হাসিনার অবস্থান ছিল ৩০ এ। এছাড়া, ম্যাগাজিনটির ‘রাজনীতিতে বিশ্বের ২২ জন ক্ষমতাধর নারী’-র তালিকায় শেখ হাসিনা ছিলেন নবম অবস্থানে। লোকাল রাজনীতিতে এগুলোকে ভ্যালুএবল করে প্রচার করা হয়েছে। একে উপলক্ষ করে সভা-সমাবেশ, সংবর্ধনার আসরও জমেছে।

এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের এমন শিরোপার বিপরীতে চেষ্টা করা হয়েছে লন্ডন পরবাসী বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে হঠাৎ সুপার-ডুপার বানানোর। প্রথমে ছড়ানো হয়েছে তাকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বানানোর তথ্য। পরে কারেকশন দিয়ে বলা হয়েছে- না অধ্যাপক নয়, বক্তা। আইনি জটিলতার কারণে তিনি অধ্যাপনার অফার নিতে না পেরে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়েছেন বিশ্বখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।

কয়েকটি পেজ থেকে ছড়ানো এ তথ্যে লাখ লাখ লাইক পড়েছে। শেয়ারও হয়েছে প্রচুর। এসব পেজ কারা চালান, লাইক-শেয়ার কারা দেন? তাদের পরিচয় ও ঘরানা কারো না বোঝার কথা নয়। এ ভার্চুয়াল প্রচারণা বাজারে থাকতে থাকতেই নতুন ডামাডোল বিশ্বে তারেক রহমানের তরুণ নেতৃত্বে দ্বিতীয় সেরা নির্বাচিত হওয়া। এর মর্মকথা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী দক্ষ তরুণ নেতৃত্বের ‘টপ-২০’ তালিকা করেছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘গালফ নিউজ’। এই তালিকায় দক্ষ নেতৃত্বে প্রথমেই রয়েছেন বর্তমান সৌদি যুবরাজ। আর দ্বিতীয় অবস্থানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তৃতীয় ভারতের রাহুল গান্ধী।

Advertisement

তালিকাটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এবং ছেলে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম ২০ নম্বর স্থানে। তারেক রহমানের বিষয়ে বলা হয়, তিনি প্রায় এক যুগ দেশের বাইরে থেকেও নেতৃত্বগুণে দলের সংকটের সময় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন। লন্ডন থেকে নিয়মিত দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি অন্যতম বৃহৎ এই দল পরিচালনা করছেন।

দলের চেয়ারপার্সনের পর তিনি ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, এখন বলতে গেলে দলে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিএনপির মতো একটি ভাঙনপ্রবণ দলকে দেশের বাইরে থেকে একতাবদ্ধ রাখতে পারা সত্যিই বিস্ময়ের। সজীব ওয়াজেদ জয়ের তালিকায় স্থান পাওয়া নিয়ে বলা হয়, ‘সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ও অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছেন। প্রতিবছর তরুণ নেতৃত্বে ‘টপ-২০’ তালিকা করা হয়। এবারই প্রথমবারের মতো সেই তালিকায় বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ভবিষৎ কাণ্ডারীরা স্থান পেলেন।

এর আগে, দেশের ভার্চুয়াল জগত মাত করা হয়েছে স্বৈরাচার বিষয়ক মেইড ইন জার্মান তথ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম বিশ্বের শীর্ষ স্বৈরাচারের তালিকাভুক্ত করেছে 'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ নামের জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বিএনপি ঘরানা থেকে এটির বেশ প্রচার চলেছে ফেসবুকসহ যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। আংশিক খুশি হয়েছেন স্বৈরাচার হিসেবে পোক্ত অবস্থানের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার ভক্তরা বলেছেন, এরশাদ লোকাল মার্কেটের স্বৈরাচার। আর শেখ হাসিনা একেবারে আন্তর্জাতিক মানের স্বৈরাচার। এরশাদ টিপ্পনি কেটে বলেছেন, আন্তর্জাতিক কোনো মহল বা গবেষণা সংস্থা থেকে তাকে স্বৈরাচার বলা হলে তিনি আত্মহত্যা করতেন।

ভার্চুয়ালের তথ্য অ্যাকচুয়াল কি-না সেই প্রশ্নের সময়ই নেই। এরপরই না সুযোগ, পক্ষ, মিত্র, সমর্থক জোগানো। ততক্ষণে আক্রান্তদের একান্ত বিলাপ বা ভার্চুয়ালকে গালমন্দ করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকছে না। বাস্তবতা বুঝতে পেরে এ অভিযাত্রায় পেছানো রাজনৈতিক দল বিএনপিও এখন ভার্চুয়ালের সারথী। কয়েক ইস্যুতে এরইমধ্যে তারা সাফল্যও পেয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের চেয়ে বেশি আগুয়ান জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা।

কওমী মাদ্রাসা ঘরানার লোকজনও ব্যাপক উদ্যমে নিজেদের সক্ষম করার চেষ্টায় নেমেছে। অন্যদের চেয়ে কোনো কোনো ইস্যুতে ভার্চুয়ালে বেশি সক্ষমতার সাক্ষর রাখছেও তারা। অন্যদিকে বাংলাদেশে এই ডিজিটালের পর্দা উম্মোচনকারীমহল ইদানিং নিজেরাও আক্রান্ত হতে বসেছে। এতোদিন তারা অনেকটা একতরফা ভার্চুয়াল যুদ্ধ চালালেও সম্প্রতি প্রতিপক্ষও ছেড়ে দিচ্ছে না। পাল্টা তথ্য, ঘটনা ছড়িয়ে কাউন্টার অ্যাটাক করছে। সেদিন এ নিয়ে আর ক্ষোভ চাপা রাখতে পারেননি খোদ বাংলাদেশে ভার্চুয়ালের দিকপাল সজীব ওয়াজেদ জয়।

ফেসবুককে বিপজ্জনক বলেছেন তিনি। রাজধানীতে বিপিও সামিট-২০১৮ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমনই অনুভূতি প্রধানমন্ত্রীপুত্র ও উপদেষ্টা জয়ের। ফেসবুককে বিপজ্জনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী ক্রিস্টিনা একটু পরপরই ফেসবুক চেক করে। আমি এটাকে ফেকবুক বলি। এটা একটা কাল্পনিক, মিথ্যা জগৎ। এর কোনো সীমা নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ব্লক করাও সম্ভব নয়।

ইন্টারনেটে কোনো কিছু ব্লক করে আটকানো যায় না। অথচ আওয়ামী লীগের গর্ব করা দাবি, তাদের হাত দিয়েই বাংলাদেশের ডিজিটাল যাত্রা। মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক তাদেরই অবদান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গর্বের সঙ্গে বলেছেন, ‘ফেসবুক ও টুইটার আমার হাত দিয়ে সৃষ্টি এবং আমার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এই আধুনিক ডিজিটাল যুগের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশে সম্প্রসারিত করেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এখন ভিন্ন কথা। ভিন্ন উপলব্ধি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর