বিশেষ প্রতিবেদন

আজও আঁতকে ওঠেন রানা প্লাজার সেই রেশমা

‘জ্ঞান ফেরার পর শুনি, পাশে কে যেন পানি পানি বলে চিৎকার করছেন। দেয়াল চাপায় পা আটকে গিয়েছিল মানুষটির। আমিই তো তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি তখন। কই পাব পানি! এরপর কোনদিন যে তার চিৎকার থেমে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি। পরে কোনো একসময় অন্ধকারে হাতড়িয়ে তার কাছে গেলাম। গায়ে হাত দিতেই আঙ্গুল দেবে গেল। মরে পঁচে গেছে। গন্ধ শোঁকার শক্তিও ছিল না আমার।’

Advertisement

বলছিলেন, সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসলীলার জীবন্ত সাক্ষী রেশমা বেগম। ভবন ধসের ১৭ দিন পর বিশাল ধ্বংসস্তূপ থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। রেশমার উদ্ধারের ঘটনা ছিল মানব ইতিহাসের একটি বিস্ময়।

সুস্থ হওয়ার পর পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ রেশমার চাকরির ব্যবস্থা করেন। চাকরির জন্য মধ্যস্থতা করেন রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া তৎকালীন সাভার ক্যান্টনমেন্টের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী।

মৃত্যুকূপ থেকে বেঁচে আসা রেশমা দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা মনে করে আজও আঁতকে ওঠেন। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে ১৭ দিনের বিভৎস্য ঘটনা নিয়ে গতকাল সোমবার রাজধানীর কালাচাঁদপুর নিজ বাড়িতে জাগো নিউজ’র মুখোমুখি হন তিনি। এর আগে গত বছরও তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন >> লাশের দেহে আঙুল দেবে গেল : রেশমা

রানা প্লাজা ধসের সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে রেশমা বলেন, ‘রানা প্লাজার তিন নম্বর ফ্লোরে কাজ করতাম। ঘটনার আগের দিন লাঞ্চের সময় বাসায় ফিরব বলে সকালে না খেয়েই বের হই। ভবনে আসার পর অনেককে আলোচনা করতে দেখলাম। কেউ বলছেন, এতদিনের পুরান ভবন, সহজে ভাঙবে না। আবার কেউ কেউ কাজ না করেই বের হয়ে গেলেন। ভয়েই তারা বের হচ্ছিলেন। আমরাও চলে এলাম।’

‘পরের দিন যথারীতি কাজে গেলাম। দেখলাম, একটি বিম্বের পলেস্তারা খসে গেছে। বসরা কাজ করার নির্দেশ দিয়ে বলল, সমস্যা নাই, সবাই কাজ শুরু করে দাও। কাজ শুরু করার পরপরই বিদ্যুৎ চলে যায়। পরে জেনারেটর চালু হলো। সেটাও কয়েকবার বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিদ্যুৎ আসে।’

‘এর মধ্যে অনেকে ওপরে তাকিয়ে দেখেন, ছাদে ফাটল ধরেছে। তখন সবাই কাজ বন্ধ করার জন্য হৈ-চৈ শুরু করেন। একপর্যায়ে সবাইকে ছুটি দেয়া হয়। সবাই হুড়োহুড়ি করে গেটের কাছে যাওয়া শুরু করেন। ভিড়ের কারণে আমি অপেক্ষা করছিলাম। ভাবছিলাম, রাস্তা কিছুটা ফাঁকা হলে বের হব।’

Advertisement

রেশমা বলেন, ‘যেখানে কাজ করি, সেখান থেকে উঠে জুতা হাতে নিতেই পাশের আরেকজন আমাকে ডাক দেয়। ওর কারণেই বিলম্ব। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ভবন ভেঙে পড়ে। এরপর আর কী হয়েছে, তা বলতে পারব না। কে মরল, কে বাঁচল- কিছুই বলতে পারব না।’

কাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে রেশমা বলেন, ‘ওই মাসেই কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এর আগেও ওখানে চাকরি করেছি। পরে চাকরি ছেড়ে দেই। এরপর আবারও যোগ দেই। মাসে ছয় হাজার টাকা পেতাম। প্রথমে ওভারলুকের কাজ করতাম। পরে ফিনিশিংয়ে যোগ দেই।’

আরও পড়ুন >> রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : সংস্কারের সুফল তৈরি পোশাক খাতে

ভবন ধসের পরের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওই সময়ের কোনো কথাই মনে ছিল না। কতদিন পর জ্ঞান ফিরেছে, তাও বলতে পারব না। একেবারে অন্ধকার ছিল। কিছুই দেখা যেত না। আমার পাশে আরেক ভাই দুই দেয়ালের মাঝে আটকা পড়েছিলেন। তার চিৎকার শুনতে পেতাম। যেহেতু আমার শরীরের কোনো অংশই চাপা পড়েনি, সে কারণে আমি একটু নড়াচড়া করতে পারতাম। বেঁচে থাকা পাশের ভাই আমার কাছে পানি চাইত। আমি বলতাম, পানি তো নাই। তার যে পা আটকা পড়েছিল, সেটি ছাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করত। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু বের করতে পারিনি। পুরো স্থানটি ছিল অন্ধকারে ঢাকা।’

‘বসার জায়গাটুকুও ছিল না। শুয়ে শুয়েই নড়াচড়া করতে হতো। এভাবে শুয়ে শুয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বসার মতো সামান্য জায়গা পাই। অনেকেই আশপাশ থেকে বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করছিল। পাশে আটকা পড়া মিজান ভাই পানি পানি করে চিৎকার করতেন। হঠাৎ একদিন তার চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। একসময় কাছে গিয়ে গায়ে হাত দেই। হাতের আঙুল যেন দেবে গেল। পরে বুঝলাম অনেক আগেই মারা গেছেন’- বলছিলেন রেশমা।

‘কোনো ভয়-ডর ছিল না। মাথায় কোনো কাজও করছিল না। আজও মনে হলে আঁতকে উঠি।’

লাশের গন্ধ বের হচ্ছিল কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে রেশমা বলেন, ‘কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোনোকিছুই দেখতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টা করেছি সেখান থেকে বের হওয়ার। যখন পারিনি, তখন হতাশ হয়েছি। মনে হয়েছে, আমার আর বের হওয়া হবে না।’

‘জীবন বাঁচানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছি’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমি যেখানে আটকা পড়ে ছিলাম, সেখানে অনেক ইটের ভাঙা টুকরা ছিল। সেগুলো সরাতাম। প্রচুর গরম লাগত, ঘেমে যেতাম। পানির পিপাসায় বুক ফেটে যেত।’

আরও পড়ুন >> অভিযোগ গঠনেই আটকা রানা প্লাজার মামলা

‘কয়েক দিন পর হাতের কাছে একটি কাঁচি পাই। মাথার কাছে কাপড়-ভর্তি অনেক কার্টন ছিল। সে সময় মাথায় কাজ করল, কাঁচি দিয়ে কাটা যায় কিনা? কাঁচি দিয়ে কার্টন কাটতে শুরু করলাম। কিন্তু কেটে শেষ করতে পারলাম না। যতই কাটি ততই কাপড়ের স্তূপ সামনে আসে। ফের আগের জায়গায় ফিরে আসি, সেই লাশের কাছে।’

দুঃসহ সেই স্মৃতি হাতড়ে রেশমা আরও বলেন, ‘সে সময় প্রচুর ঘুম হতো। অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। আবার ইটের ভাঙা টুকরা সরাতাম। ইট আর কাপড় সরাতে সরাতে একসময় একটু ফাঁকা জায়গা পেলাম। সেখান দিয়ে নিচে এলাম। সেখানে একটু ফাঁকা ও প্রশস্ত জায়গা ছিল।’

‘কিন্তু সেখানেও কোনো আলো ছিল না। একদিন হঠাৎ সেখানে আলো আসে। উদ্ধারের আগে আলোর দেখা পাই। তবে সেখানকার ফ্লোরে প্রচুর পানি ছিল। পচা পানি নাকি ময়লা পানি, তা এখন মনে করতে পারছি না। পিপাসার কারণে সব ভুলে গিয়েছিলাম।’

সে সময়ের স্মৃতি এখন কতটুকু তাড়া করে- এমন প্রশ্নের জবাবে রেশমা বলেন, ‘সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে পড়লে স্থির থাকতে পারি না। অনেক কষ্ট হয়। যদিও ছোট বেলা থেকে কষ্ট করেই বড় হয়েছি।’

আরও পড়ুন >> রানা প্লাজা ধসের পরও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেনি পোশাকশিল্প

উদ্ধারের আগ মুহূর্তের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘নিচের ফ্লোরে আর কোনো লাশের দেখা পাইনি। ওই মুহূর্তে নড়াচড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলাম। শরীর আর চলছিল না। কাচ ভাঙায় কখন হাত কেটেছে, কখন পা কেটেছে, বুঝতে পারিনি। বারবার মায়ের কথা, ভাই-বোনদের কথা মনে পড়ত।’

‘হঠাৎ একদিন মাইকের আওয়াজ শুনতে পাই। কখন রাত, কখন দিন পার হচ্ছিল, কোনোকিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একসময় ওপরের ছিদ্র দিয়ে আলো দেখতে পাই। হয়ত ধ্বংসস্তূপগুলো সরিয়ে রাখা হচ্ছিল। তখনই আলোর দেখা মিলল।’

‘আমি চিৎকার করলাম। কিছুক্ষণ পর ময়লা পড়ে ছিদ্র আবারও বন্ধ হয়ে গেল। ওই স্থান থেকে আমি একটু সরে আসলাম। কিছুক্ষণ পর আবারও ওই ছিদ্র দিয়ে আলো দেখতে পেলাম। পাশ থেকে লাঠির মতো একটি পাইপ সংগ্রহ করলাম। ওই পাইপ ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। এভাবে কতক্ষণ পার হলো জানি না। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে লাঠিটা নাড়িয়ে যেতে থাকি।’

আরও পড়ুন >> ‘তহবিলে টাকা আছে কেউ নিতে আসে না'

‘একসময় ওপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম। কেউ যেন এসে বলল, স্যার এখানে মনে হয় কোনো জীবিত আছে।’

‘একজন এসে ছিদ্র দিয়ে চিৎকার করে আমার নাম জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, আমাকে খাবার দিন? তারা প্রথমে পানি, বিস্কুট আর জুস দিল। বলল, চিন্তা করো না। তোমাকে জীবিত উদ্ধার করা হবে। আমি আমার মা-বাবার নামও তাদের জানালাম।’

‘জীবিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিতের পর আপনাকে উদ্ধার করতে কত সময় লেগেছিল’- এমন প্রশ্নের জবাবে রেশমা বলেন, ‘কতক্ষণ লেগেছিল, ঠিক বলতে পারব না। ওই সময় তো সময়ের কোনো ধারণা ছিল না, শরীরও চলছিল না।’

‘ভাঙা দেয়াল কেটে আমাকে বের করা হলো। উদ্ধারকারীরা একটি লাইট দিয়ে আমাকে সরে যেতে বলেন। আমি সরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। মেজর মোয়াজ্জেম স্যার ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে বের করে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে আমাকে সিএমএইচে নেয়া হয়।’

শেষ সময়ের স্মৃতিচারণ করে রেশমা বলেন, ‘ওই সময় অনেক কিছুই ভেবেছি। শেষের দিকে আর মনে হয়নি যে, আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারব! আমাকে কেউ আর উদ্ধার করতে পারবে না- এমনই মনে হতো সবসময়। কিন্তু শেষমেষ আল্লাহর রহমতে বেঁচে ফিরলাম।’

২০১০ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন রেশমা। হেমায়েতপুরে বড় বোনের বাসায় ওঠেন। সেখানে থেকে গার্মেন্টসে চাকরি, পরবর্তীতে দুর্বষহ স্মৃতি।

আরও পড়ুন >> কাজ করতে পারছেন না রানা প্লাজায় আহত ৪৮ শতাংশ শ্রমিক

ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা রেশমার বাবার কথা তেমন মনে নেই। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বড় ভাই ও মা দিনাজপুর থাকেন। বাকি সবাই এখন ঢাকাবাসী। স্বামী মোবাইলের দোকান দিয়েছেন গেল বছর। দুই বছরের কন্যা রেবা আর স্বামী রাব্বিকে নিয়ে এখন বেশ ভালো আছেন তিনি।

এএসএস/এমএআর/বিএ